আমার ভাষা আমার একুশ-সাধুর বিদায়, কথ্যের জয়ধ্বনি by সৌরভ সিকদার
পৃথিবীর সব দেশে সবকালেই ভাষা পরিবর্তনশীল এবং গতিময়। সময়, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং যুগের এমনকি রাজনৈতিক কারণেও ভাষা বদলায়। আঠারো-উনিশ শতকে ভাষার বদল ছিল খুবই ধীরে, কিন্তু একুশ শতকে প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের অনিবার্য প্রভাবে ভাষার বদল ঘটছে খুব দ্রুত।
এই তো দুই দশক আগেও আমাদের সংবাদপত্র (অধিকাংশ) প্রয়োগ করত ভাষার সাধুরীতি। ক্রমে ক্রমে সেটি সম্পাদকীয় এলাকা অতিক্রম করে সংবাদপত্রের সীমানা পার হয়ে গেল। প্রায় সব দেশেই বা সব ভাষাতেই একসময় ভাষার দুটি রূপ ব্যবহূত হতো। যেমন উচ্চ জার্মান, নিম্ন জার্মান, আরবিতে ‘আল ফুশাহ’ এবং ‘আল কামিয়াহ’। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে একটি ছিল সমাজের উচ্চবর্গের ভাষা অন্যটি নিম্নবর্গের ভাষা। তেমনি আমাদের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলেও প্রচলিত ছিল দুটি রূপ। একটি সাধু, অন্যটি কথ্য বা চলিত। বঙ্কিমচন্দ্র একে বলেছিলেন ‘অপর ভাষা’। একটি লেখা বা সাহিত্যের ভাষা, অন্যটি মুখের ভাষা। আমরা শৈশবে এই সাধু, চলিত বা কথ্য ভাষার পার্থক্য শিখতাম সর্বনাম এবং ক্রিয়াপদের দীর্ঘ ও হ্রস্য রূপের মাধ্যমে। বলা যায়, উনিশ শতকের মধ্য পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে সামন্তপ্রভু, তার দোসর এবং সমাজের উচ্চশ্রেণী নামধারীরা সাধু ভাষায় সাহিত্য রচনা করে নিজেদের অহংকার জাহির করেছেন।
মুখের ভাষা জীবন্ত ভাষা, তা টিকে থাকে এবং পরিবর্তন মেনে নিয়ে এগিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাই ১৯৩৮ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ‘সুয়োরানী ও দুয়োরানী’ গল্পের মধ্য দিয়ে—‘আমার বিশ্বাস সুয়োরানী নেবেন বিদায় আর একলা দুয়োরানী বসবেন সিংহাসনে’। আজ প্রায় এক শ বছর পর রবীন্দ্রনাথের কথা শুধু প্রমাণিতই হয়নি শুধু, সুয়োরানিকে খুঁজতে যেতে হচ্ছে আর্কাইভে। আর দুয়োরানি রাজত্ব করছেন সর্বত্র। অবশ্য কথ্য ভাষার এই সিংহাসন দখল এক দিনে হয়নি। তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা ভাষা’য় লিখেছিলেন—‘বাংলায় লিখিত এবং কথিত ভাষার যতটা প্রভেদ দেখা যায় অন্যত্র ততটা নহে। একটির নাম সাধু অপরটির নাম অপর ভাষা। একটি লিখিবার ভাষা দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা। পুস্তকে প্রথম ভাষাটি ভিন্ন দ্বিতীয়টির কোনো চিহ্ন পাওয়া যাইতো না...লোকে বুঝুক না বুঝুক আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি। অপর ভাষা সেদিকে না গিয়া, যাহা সকলের বোধগম্য, তাহাই ব্যবহার করে।’ বঙ্কিমচন্দ্র নিজে সাধু ভাষা প্রয়োগ করলেও তিনি কথ্য ভাষার পক্ষে যে ছিলেন, তার প্রমাণ প্যারিচাঁদ মিত্র যখন ১৮৫৮ সালে আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশ করেন তখন সাধু ভাষার সন্ন্যাসীরা বাংলা ভাষার জাত গেল বলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র লিখিলেন, ‘সেদিন হইতে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি’, কিছু দিন পর কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতুম প্যাঁচার নকশা রচনা করে কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আরও সাহসের পরিচয় দেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, কথ্য ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন মূলত প্রমথ চৌধুরী, উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগে। তাঁর সবুজপত্র পত্রিকা (১৯১৪) ছিল চলতি ভাষা আন্দোলনের প্রধান মুখপত্র।
উনিশ শতকের শেষার্ধের পুরোটাই সাধু-চলিতের দ্বন্দ্ব চলেছে। সেকালের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে অনেকটা কোমর বেঁধে তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন। তবে বড় কথা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত লেখার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কথ্য ভাষাই—তা যে সংগত ছিল তার কারণ প্রমথ চৌধুরী নিজেই বলে গেছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমে যায় উল্টোটা করতে গেলে মুখে কালি লাগে।’ আমেরিকান পণ্ডিত এবং বাংলা ভাষার গবেষক এডওয়ার্ড ডিমোক ১৯৬০ সালে সাধু ও চলিত ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ৩৯.৫ শতাংশ শব্দ উভয় ভাষায় ব্যবহূত হয়। একই সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, পার্থক্য কমে আসছে উভয় রীতির। ডিমোকের গবেষণার অনেক বিষয়ের সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানীগণ এক মত নন, কিন্তু এটা তো সত্য, পার্থক্য কমতে কমতে আজ শুধু কথ্য ভাষা টিকে গেছে। বাংলা ভাষায় কথ্য রীতির আবির্ভাব বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের আগে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিও এত কাছাকাছি আসেনি পরস্পরের, দরকারও পড়েনি আন্তঃআঞ্চলিক ভাষিক যোগাযোগের। কলকাতার নতুন জীবন ও সভ্যতা-ব্যবসা, শিক্ষা, পেশা, সংস্কৃতি চর্চা বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিকে মুখোমুখি করে দেয়: এবং তাদের কণ্ঠ থেকে উত্সারিত হতে থাকে একটি কথ্য বা চলতি রীতি’ (বাংলা ভাষা)। এভাবেই শিক্ষিত সাহসী লেখকেরা শুরু করেছিলেন ভাষার এই মৌখিক রীতির চর্চা। তাঁরা কৃত্রিমভাবে কোনো কিছু আরোপ করেননি।
একালে নাগরিক কথ্য বাংলা নামে যেমন বিকৃত এবং অন্য ভাষার প্রভাবে উচ্চারণ বদলে যাচ্ছে, চলিত বাংলার প্রচলনে তা ছিল না মোটেই। আমাদের মুখের যে ভাষা আমরা প্রত্যহ ব্যবহার করি, তাতে যদি সাহিত্য রচিত হয়, তাহলে অধিক পাঠক এর স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে—এটা যেমন সত্য, তেমনি বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দাসত্বমুক্ত হয়ে নিজে চলার সরল-মসৃণ পথ তৈরি করে নেবে; নিয়েছেও তাই। উনিশ-বিশ শতকে কথ্য ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল রীতিমতো। কিন্তু একুশ শতকে এসে সাধু ভাষা স্ব-ইচ্ছায় নির্বাসনে গেছে। পরিস্থিতি এখন এতটাই উল্টে গেছে যে, কাউকে আজ ‘আপনি আসিয়াছেন?’ বললে ভাবা হবে বিদ্রূপ করা হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এখনো সাধু ভাষা প্রচলিত আছে—আমাদের সরকারি নথিপত্রে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বিবাহ কিংবা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্রে, জমির দলিলাদি চুক্তিপত্রসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে। ভাষার পরিবর্তনের পালে যে হাওয়া লেগেছে তার সঙ্গে চলতে না পারলে এগুলো একসময় অচল পুরোনো মুদ্রার মতো দুর্লভ সংগ্রহে রূপান্তরিত হবে।
এ বিষয়ে হায়াত্ মামুদ আমাদের বলেন, ‘আমরা যে এখন আদৌ সাধু ভাষা ব্যবহার করি না, এতে কিছুটা হলেও ক্ষতি তো হয়েছেই। আমার বিবেচনায় ভাষার দুটি রূপের পৃথক শক্তি। কোনোটাই খারাপ নয়। যেহেতু এখন চর্চা হচ্ছে না, তাই সাধুর প্রচলন নেই। তবে পুরাতন সাহিত্য পাঠের জন্য সাধু ভাষার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের ভাষার সংবেদনা কমে যাচ্ছে, ফলে ইচ্ছেমতো ব্যবহার চলছে। সাধু ভাষা চলে গেছে কিন্তু আমাদের পাঠ অভ্যাস বাড়েনি। কাজেই যে রীতিতেই হোক পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি জরুরি।’
এক দিন কথ্য ভাষাকে সিঁধ কেটে ঢুকতে হয়েছিল আর আজ সদর দরজা খোলা রাখলেও আমাদের ভাষার ঘরে সাধু-সন্ন্যাসী আসেন না, আমন্ত্রণ করলেও না। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত (২০০১ সালে) ঢাকার একটি স্থানীয় বহুল পঠিত দৈনিক প্রকাশিত হতো সাধু ভাষায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পত্রিকাটিও একদিন ঘোষণা দিয়ে তার মাতৃভাষা (সাধু) ত্যাগ করে কথ্যের দলে ভিড়ে গেল। এক শ বছর পর আমাদের প্রিয় মুখের ভাষা যে বদলে নতুন কোনো ‘সত্য’ ভাষায় রূপান্তরিত হবে না, তা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে জোর করে বলতে পারব না। ভাষার বদল ঠেকানো যায় না। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই ভাষার ধর্ম। তবে এই পরিবর্তনের গতি বুঝতে পারলে ভাষার বিকাশ কিছুটা হলেও প্রভাবিত করা যায়। আমরা কি তার জন্য প্রস্তুত আছি?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মুখের ভাষা জীবন্ত ভাষা, তা টিকে থাকে এবং পরিবর্তন মেনে নিয়ে এগিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাই ১৯৩৮ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ‘সুয়োরানী ও দুয়োরানী’ গল্পের মধ্য দিয়ে—‘আমার বিশ্বাস সুয়োরানী নেবেন বিদায় আর একলা দুয়োরানী বসবেন সিংহাসনে’। আজ প্রায় এক শ বছর পর রবীন্দ্রনাথের কথা শুধু প্রমাণিতই হয়নি শুধু, সুয়োরানিকে খুঁজতে যেতে হচ্ছে আর্কাইভে। আর দুয়োরানি রাজত্ব করছেন সর্বত্র। অবশ্য কথ্য ভাষার এই সিংহাসন দখল এক দিনে হয়নি। তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা ভাষা’য় লিখেছিলেন—‘বাংলায় লিখিত এবং কথিত ভাষার যতটা প্রভেদ দেখা যায় অন্যত্র ততটা নহে। একটির নাম সাধু অপরটির নাম অপর ভাষা। একটি লিখিবার ভাষা দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা। পুস্তকে প্রথম ভাষাটি ভিন্ন দ্বিতীয়টির কোনো চিহ্ন পাওয়া যাইতো না...লোকে বুঝুক না বুঝুক আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি। অপর ভাষা সেদিকে না গিয়া, যাহা সকলের বোধগম্য, তাহাই ব্যবহার করে।’ বঙ্কিমচন্দ্র নিজে সাধু ভাষা প্রয়োগ করলেও তিনি কথ্য ভাষার পক্ষে যে ছিলেন, তার প্রমাণ প্যারিচাঁদ মিত্র যখন ১৮৫৮ সালে আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশ করেন তখন সাধু ভাষার সন্ন্যাসীরা বাংলা ভাষার জাত গেল বলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র লিখিলেন, ‘সেদিন হইতে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি’, কিছু দিন পর কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতুম প্যাঁচার নকশা রচনা করে কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আরও সাহসের পরিচয় দেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, কথ্য ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন মূলত প্রমথ চৌধুরী, উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগে। তাঁর সবুজপত্র পত্রিকা (১৯১৪) ছিল চলতি ভাষা আন্দোলনের প্রধান মুখপত্র।
উনিশ শতকের শেষার্ধের পুরোটাই সাধু-চলিতের দ্বন্দ্ব চলেছে। সেকালের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে অনেকটা কোমর বেঁধে তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন। তবে বড় কথা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত লেখার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কথ্য ভাষাই—তা যে সংগত ছিল তার কারণ প্রমথ চৌধুরী নিজেই বলে গেছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমে যায় উল্টোটা করতে গেলে মুখে কালি লাগে।’ আমেরিকান পণ্ডিত এবং বাংলা ভাষার গবেষক এডওয়ার্ড ডিমোক ১৯৬০ সালে সাধু ও চলিত ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ৩৯.৫ শতাংশ শব্দ উভয় ভাষায় ব্যবহূত হয়। একই সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, পার্থক্য কমে আসছে উভয় রীতির। ডিমোকের গবেষণার অনেক বিষয়ের সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানীগণ এক মত নন, কিন্তু এটা তো সত্য, পার্থক্য কমতে কমতে আজ শুধু কথ্য ভাষা টিকে গেছে। বাংলা ভাষায় কথ্য রীতির আবির্ভাব বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের আগে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিও এত কাছাকাছি আসেনি পরস্পরের, দরকারও পড়েনি আন্তঃআঞ্চলিক ভাষিক যোগাযোগের। কলকাতার নতুন জীবন ও সভ্যতা-ব্যবসা, শিক্ষা, পেশা, সংস্কৃতি চর্চা বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিকে মুখোমুখি করে দেয়: এবং তাদের কণ্ঠ থেকে উত্সারিত হতে থাকে একটি কথ্য বা চলতি রীতি’ (বাংলা ভাষা)। এভাবেই শিক্ষিত সাহসী লেখকেরা শুরু করেছিলেন ভাষার এই মৌখিক রীতির চর্চা। তাঁরা কৃত্রিমভাবে কোনো কিছু আরোপ করেননি।
একালে নাগরিক কথ্য বাংলা নামে যেমন বিকৃত এবং অন্য ভাষার প্রভাবে উচ্চারণ বদলে যাচ্ছে, চলিত বাংলার প্রচলনে তা ছিল না মোটেই। আমাদের মুখের যে ভাষা আমরা প্রত্যহ ব্যবহার করি, তাতে যদি সাহিত্য রচিত হয়, তাহলে অধিক পাঠক এর স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে—এটা যেমন সত্য, তেমনি বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দাসত্বমুক্ত হয়ে নিজে চলার সরল-মসৃণ পথ তৈরি করে নেবে; নিয়েছেও তাই। উনিশ-বিশ শতকে কথ্য ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল রীতিমতো। কিন্তু একুশ শতকে এসে সাধু ভাষা স্ব-ইচ্ছায় নির্বাসনে গেছে। পরিস্থিতি এখন এতটাই উল্টে গেছে যে, কাউকে আজ ‘আপনি আসিয়াছেন?’ বললে ভাবা হবে বিদ্রূপ করা হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এখনো সাধু ভাষা প্রচলিত আছে—আমাদের সরকারি নথিপত্রে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বিবাহ কিংবা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্রে, জমির দলিলাদি চুক্তিপত্রসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে। ভাষার পরিবর্তনের পালে যে হাওয়া লেগেছে তার সঙ্গে চলতে না পারলে এগুলো একসময় অচল পুরোনো মুদ্রার মতো দুর্লভ সংগ্রহে রূপান্তরিত হবে।
এ বিষয়ে হায়াত্ মামুদ আমাদের বলেন, ‘আমরা যে এখন আদৌ সাধু ভাষা ব্যবহার করি না, এতে কিছুটা হলেও ক্ষতি তো হয়েছেই। আমার বিবেচনায় ভাষার দুটি রূপের পৃথক শক্তি। কোনোটাই খারাপ নয়। যেহেতু এখন চর্চা হচ্ছে না, তাই সাধুর প্রচলন নেই। তবে পুরাতন সাহিত্য পাঠের জন্য সাধু ভাষার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের ভাষার সংবেদনা কমে যাচ্ছে, ফলে ইচ্ছেমতো ব্যবহার চলছে। সাধু ভাষা চলে গেছে কিন্তু আমাদের পাঠ অভ্যাস বাড়েনি। কাজেই যে রীতিতেই হোক পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি জরুরি।’
এক দিন কথ্য ভাষাকে সিঁধ কেটে ঢুকতে হয়েছিল আর আজ সদর দরজা খোলা রাখলেও আমাদের ভাষার ঘরে সাধু-সন্ন্যাসী আসেন না, আমন্ত্রণ করলেও না। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত (২০০১ সালে) ঢাকার একটি স্থানীয় বহুল পঠিত দৈনিক প্রকাশিত হতো সাধু ভাষায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পত্রিকাটিও একদিন ঘোষণা দিয়ে তার মাতৃভাষা (সাধু) ত্যাগ করে কথ্যের দলে ভিড়ে গেল। এক শ বছর পর আমাদের প্রিয় মুখের ভাষা যে বদলে নতুন কোনো ‘সত্য’ ভাষায় রূপান্তরিত হবে না, তা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে জোর করে বলতে পারব না। ভাষার বদল ঠেকানো যায় না। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই ভাষার ধর্ম। তবে এই পরিবর্তনের গতি বুঝতে পারলে ভাষার বিকাশ কিছুটা হলেও প্রভাবিত করা যায়। আমরা কি তার জন্য প্রস্তুত আছি?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments