আমার ভাষা আমার একুশ-বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষা চর্চা by সৌরভ সিকদার
যেকোনো ভাষা-সম্প্রদায় তাদের প্রতিদিনের ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন ভাষার চর্চা করে থাকে, তেমনি সে ভাষা নিয়ে গবেষণা, অনুবাদ, সম্প্রচার ও প্রকাশনা প্রভৃতিও ভাষা চর্চার মধ্যে পড়ে। যে জাতি তাদের মাতৃভাষার চর্চা যতো বেশি করে তাদের উন্নতির জন্য তা তত সহায়ক হয়।
জার্মানি-জাপানের দিকে তাকালে এ সত্য উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না। বাংলা ভাষা আজ ২৫ কোটি বা তারও বেশি মানুষের ভাষা। এথনোলগ বিশ্বভাষাবিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ১০টি দেশে এই ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। আমাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশেও বিপুল মানুষ বাংলা ভাষার চর্চা করে থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশে যে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাস করে, তারাও নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা, গবেষণা এবং সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এ নিবন্ধে বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষা চর্চার কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে চাই। উল্লেখ্য, প্রবাসী বাঙালিদের বাংলা ভাষার চর্চার চেয়ে আমরা বিদেশের যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা চলছে তাদের একটি তালিকা করার চেষ্টা করেছি, এটি অবশ্যই সম্পূর্ণ তালিকা নয়। বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে আশির দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলা ভাষায় সেরা সেরা ক্লাসিক গ্রন্থ প্রকাশিত হতো মস্কো ও লেনিনগ্রাদ থেকে। প্রকাশিত হতো শিশু, নারীসহ নানা বিষয়ভিত্তিক আকর্ষণীয় পত্রিকা। এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ননী ভৌমিক, হায়াত্ মামুদ, প্রফুল্ল রায়সহ অনেক খ্যাতিম্যান ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়া বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করতেন মাদাম নেভিকোভা, দানিয়ুলচুক, ফেরেব্রিয়ানি প্রমুখ। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এই চর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনায় ভাটা পড়ে।
ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন ও বার্মিংহামে অজস্র বাংলাভাষীর বাস। সেখানকার সরকারি স্কুলগুলোতে যেমন বাংলা শেখার ও চর্চার সুযোগ রয়েছে, তেমনি দৈনিক বাংলা পত্রিকাসহ নানা ধরনের প্রকাশনাও আমরা লক্ষ করি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে থেকেই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষা চর্চা বিভাগের অধীনে বাংলার চর্চা চলছে, চলছে গবেষণাও। আর এ কাজে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করেছেন টিডব্লিও ক্লার্ক, জেডি এন্ডারসন (কেমব্রিজ), জনবোল্টন উইলিয়াম রাদিচে, হ্যানা থমসন প্রমুখ। এরপর বাংলা চর্চা এবং গবেষণার অন্যতম দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানেও কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, হার্ভার্ড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা শিক্ষা দান ছাড়াও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জীবনানন্দ-লালন নিয়েও। যেসব গবেষক এ কাজে জড়িত আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন—চার্লস ফার্গুসন (মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছেন), এডওয়ার্ড সি ডিমেল, কিল্টন বি. সিলি, ব্যাচেনল ভন বমার, রালফ নিকোলাস, ডেভিড কফ ব্যাচেলবাওয়া, ক্যারল সলোমন (সম্প্রতি প্রয়াত), রিকি সলোমন, উইনস্টন ল্যানলি, ক্যারোলিন বাইট, হেনরি গ্লাসি, কেলম্যান প্রমুখ। উল্লেখ্য, আমেরিকার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া, যেখানে বাংলা ভাষার এক নতুন প্রবাসী-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত বাংলা কাগজ, রয়েছে বাংলা রেডিও ও বাংলা চ্যানেল।
কানাডায় জোসেফ ও কনেল, ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসন প্রমুখ বেশকিছু প্রবাসী ব্যক্তি বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পাই প্রবাসী বাঙালিদের এক জনগোষ্ঠী, যারা নিয়মিত বাংলা চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে মানিয়ম মাডার্নসহ শিবনারায়ণ রায় এবং আবু সাঈদ আইয়ুব অবদান রেখেছেন।
এশিয়ার মধ্যে জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা চর্চা আছে। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি বাঙালি তাদের মাতৃভাষার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। নিয়মিত বাংলা বেতার, টিভি ও গ্রন্থপাঠই তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। জাপানে প্রায় ৬০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা চর্চা শুরু করেছিলেন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কে নোরা, কিউকা লিউয়া, উচিদা দম্পতি, হাকিদো মাকিদা এবং বেশ কয়েকজন স্থানীয় এবং বাঙালি গবেষক সেখানে কাজ করছেন। চীনে রেডিও বেইজিং বাংলায় সম্প্রচার করে, চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদ কর্ম।
আমাদের জানামতে, চেকোস্নোভিয়ায় প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশ শতকের বিশের দশকে বাংলা চর্চা শুরু হয়। ভি লেসলি, দুশন জভাভিতেল এবং হান্না পেইনরো হেলটেমেভা এ কাজে অগ্রণী ছিলেন। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে বাংলা চর্চা হয়েছে, হয়েছে গবেষণাও। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মার্টিন কোপমেন প্রমুখ শুরু করলেও এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই বাংলা ভাষা চর্চায় আগ্রহী। তাছাড়া সেখানের প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা ভাষায় নিয়িমিত পত্রিকা ও গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছেন। ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একসময় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ডিগ্রি নিয়েছিলেন বাংলা ভাষায়। এ ছাড়া সেখানে মাদাম আনসারি, ক্যাথরিন থমা, ফাদার দাতিয়েন, জুলে-ব্লক প্রমুখ বাংলা চর্চায় সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
দেশের বাইরে বাংলা ভাষা চর্চা বিষয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে বেশিসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি বাস করলেও সেখানে বাংলা ভাষার চর্চা বা গবেষণা হয় না। ইস্ট লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেট এবং বার্মিংহামে, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে বাংলা ভাষা চর্চা হয় ব্যাপকভাবে। এমনকি কোথাও কোথাও নজরুল সেন্টারও রয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রায় এক শ বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়ায়ও বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে। সেমিনার হয় প্রায় নিয়মিত। নর্থ আমেরিকায় দুই বছর পরপর নজরুল কনফারেন্স হয়। ফ্লোরিডায়ও বাঙালিদের মিলন উত্সবে বাংলা ভাষার চর্চা ও আলোচনা হয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি থেকে আমার জানামতে বাংলা ভাষায় পত্রিকা বের হয়। বিভিন্ন বেতার, টিভি চ্যানেলেও বাংলা ভাষা প্রচারিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কাজেই বাংলা ভাষা এখন বিশ্বময়। মূলত প্রবাসী বাঙালিরা এসবের প্রধান উদ্যোক্তা। মরক্কোতে আরবি ভাষায় নজরুল অনুবাদ হচ্ছে। আমাদের ভাষা-সাহিত্য বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস মনে করি আমি এগুলোকে। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি থাকবে, সেখানেই বাংলা ভাষার চর্চা চলতে থাকবে, তা গবেষণাই হোক আর মুখের ভাষার চর্চা হোক।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা এ নিবন্ধে বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষা চর্চার কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে চাই। উল্লেখ্য, প্রবাসী বাঙালিদের বাংলা ভাষার চর্চার চেয়ে আমরা বিদেশের যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা চলছে তাদের একটি তালিকা করার চেষ্টা করেছি, এটি অবশ্যই সম্পূর্ণ তালিকা নয়। বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে আশির দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলা ভাষায় সেরা সেরা ক্লাসিক গ্রন্থ প্রকাশিত হতো মস্কো ও লেনিনগ্রাদ থেকে। প্রকাশিত হতো শিশু, নারীসহ নানা বিষয়ভিত্তিক আকর্ষণীয় পত্রিকা। এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ননী ভৌমিক, হায়াত্ মামুদ, প্রফুল্ল রায়সহ অনেক খ্যাতিম্যান ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়া বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করতেন মাদাম নেভিকোভা, দানিয়ুলচুক, ফেরেব্রিয়ানি প্রমুখ। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এই চর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনায় ভাটা পড়ে।
ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন ও বার্মিংহামে অজস্র বাংলাভাষীর বাস। সেখানকার সরকারি স্কুলগুলোতে যেমন বাংলা শেখার ও চর্চার সুযোগ রয়েছে, তেমনি দৈনিক বাংলা পত্রিকাসহ নানা ধরনের প্রকাশনাও আমরা লক্ষ করি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে থেকেই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষা চর্চা বিভাগের অধীনে বাংলার চর্চা চলছে, চলছে গবেষণাও। আর এ কাজে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করেছেন টিডব্লিও ক্লার্ক, জেডি এন্ডারসন (কেমব্রিজ), জনবোল্টন উইলিয়াম রাদিচে, হ্যানা থমসন প্রমুখ। এরপর বাংলা চর্চা এবং গবেষণার অন্যতম দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানেও কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, হার্ভার্ড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা শিক্ষা দান ছাড়াও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জীবনানন্দ-লালন নিয়েও। যেসব গবেষক এ কাজে জড়িত আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন—চার্লস ফার্গুসন (মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছেন), এডওয়ার্ড সি ডিমেল, কিল্টন বি. সিলি, ব্যাচেনল ভন বমার, রালফ নিকোলাস, ডেভিড কফ ব্যাচেলবাওয়া, ক্যারল সলোমন (সম্প্রতি প্রয়াত), রিকি সলোমন, উইনস্টন ল্যানলি, ক্যারোলিন বাইট, হেনরি গ্লাসি, কেলম্যান প্রমুখ। উল্লেখ্য, আমেরিকার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া, যেখানে বাংলা ভাষার এক নতুন প্রবাসী-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত বাংলা কাগজ, রয়েছে বাংলা রেডিও ও বাংলা চ্যানেল।
কানাডায় জোসেফ ও কনেল, ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসন প্রমুখ বেশকিছু প্রবাসী ব্যক্তি বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পাই প্রবাসী বাঙালিদের এক জনগোষ্ঠী, যারা নিয়মিত বাংলা চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে মানিয়ম মাডার্নসহ শিবনারায়ণ রায় এবং আবু সাঈদ আইয়ুব অবদান রেখেছেন।
এশিয়ার মধ্যে জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা চর্চা আছে। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি বাঙালি তাদের মাতৃভাষার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। নিয়মিত বাংলা বেতার, টিভি ও গ্রন্থপাঠই তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। জাপানে প্রায় ৬০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা চর্চা শুরু করেছিলেন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কে নোরা, কিউকা লিউয়া, উচিদা দম্পতি, হাকিদো মাকিদা এবং বেশ কয়েকজন স্থানীয় এবং বাঙালি গবেষক সেখানে কাজ করছেন। চীনে রেডিও বেইজিং বাংলায় সম্প্রচার করে, চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদ কর্ম।
আমাদের জানামতে, চেকোস্নোভিয়ায় প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশ শতকের বিশের দশকে বাংলা চর্চা শুরু হয়। ভি লেসলি, দুশন জভাভিতেল এবং হান্না পেইনরো হেলটেমেভা এ কাজে অগ্রণী ছিলেন। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে বাংলা চর্চা হয়েছে, হয়েছে গবেষণাও। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মার্টিন কোপমেন প্রমুখ শুরু করলেও এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই বাংলা ভাষা চর্চায় আগ্রহী। তাছাড়া সেখানের প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা ভাষায় নিয়িমিত পত্রিকা ও গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছেন। ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একসময় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ডিগ্রি নিয়েছিলেন বাংলা ভাষায়। এ ছাড়া সেখানে মাদাম আনসারি, ক্যাথরিন থমা, ফাদার দাতিয়েন, জুলে-ব্লক প্রমুখ বাংলা চর্চায় সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
দেশের বাইরে বাংলা ভাষা চর্চা বিষয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে বেশিসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি বাস করলেও সেখানে বাংলা ভাষার চর্চা বা গবেষণা হয় না। ইস্ট লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেট এবং বার্মিংহামে, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে বাংলা ভাষা চর্চা হয় ব্যাপকভাবে। এমনকি কোথাও কোথাও নজরুল সেন্টারও রয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রায় এক শ বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়ায়ও বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে। সেমিনার হয় প্রায় নিয়মিত। নর্থ আমেরিকায় দুই বছর পরপর নজরুল কনফারেন্স হয়। ফ্লোরিডায়ও বাঙালিদের মিলন উত্সবে বাংলা ভাষার চর্চা ও আলোচনা হয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি থেকে আমার জানামতে বাংলা ভাষায় পত্রিকা বের হয়। বিভিন্ন বেতার, টিভি চ্যানেলেও বাংলা ভাষা প্রচারিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কাজেই বাংলা ভাষা এখন বিশ্বময়। মূলত প্রবাসী বাঙালিরা এসবের প্রধান উদ্যোক্তা। মরক্কোতে আরবি ভাষায় নজরুল অনুবাদ হচ্ছে। আমাদের ভাষা-সাহিত্য বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস মনে করি আমি এগুলোকে। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি থাকবে, সেখানেই বাংলা ভাষার চর্চা চলতে থাকবে, তা গবেষণাই হোক আর মুখের ভাষার চর্চা হোক।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments