গতকাল সমকাল-লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশ—একটি রেখাচিত্র by ফারুক চৌধুরী
রাষ্ট্র হিসেবে লাইবেরিয়া আর বাংলাদেশ এতই ভিন্ন যে তা বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি-সময় (লাইবেরিয়া ১৮৪৭) ও প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে দুই দেশের ভাষা ও কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনীতি, সমাজ ও শাসনব্যবস্থা, জনসংখ্যা (লাইবেরিয়া ৩৫ লাখ) ও আয়তন—সবকিছু এতই ভিন্ন যে তা চোখে আঙুল দিয়ে কাউকে দেখাতে হয় না।
তবে গত ১৭ জানুয়ারি, ২০১০ সিয়েরা লিওনের ফ্রি টাউন থেকে লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে লাইবেরিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের ওপর নজর দিচ্ছিলাম। ১৯৮০ সালে লাইবেরিয়ার সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট স্যামুয়েল ডো সেই দেশের প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করলেন। হত্যা করলেন তাঁর অনেক সহযোগীকে। তার কয়েক বছর পর সার্জেন্ট ডো-এর সহকর্মী জেনারেল কিওঙ্কপা, যিনি ডো-এর বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহ কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ভক্ষণ করল স্যামুয়েল ডো-এর অনুসারীরা। আবার তার কয়েক বছর পর একটি অভ্যুত্থানে স্যামুয়েল ডোকে অপসারিত করে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিন্স জনসন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বন্দী স্যামুয়েল ডো-এর কর্তিত কর্ণ চর্বণ করলেন। আরও একজন ক্ষমতা দখলকারী চার্লস টেইলার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এখন ইউরোপে বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি। বর্বর, পৈশাচিক ও নৃশংস ছিল এসব কর্মকাণ্ড। কিন্তু তার তুলনায় আমাদের দেশে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ যে হত্যার রাজনীতির সূত্রপাত হলো, যাতে নিহত হলেন জাতির জনক, নিষ্পাপ শিশু, অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ এবং আরও অনেক অসহায় মানুষ এবং যে হত্যার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় এ দেশে সংঘটিত হলো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান হত্যাকাণ্ডসমেত কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং আরও কত শত হত্যাকাণ্ড—এসব কি লাইবেরিয়ার পৈশাচিকতা, নির্মমতা আর অমানুষিকতার থেকে কোনো অংশে কম? প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই মনে জাগে।
লাইবেরিয়ায় ফিরে যাই। সেই দেশে দুটি বিমানবন্দর রয়েছে। জেমস স্প্রিং এয়ারপোর্ট আর মনরোভিয়া থেকে মোটর পথে প্রায় দেড় ঘণ্টা দূরের রবার্টস এয়ারপোর্ট। এগুলোকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলা কিছুটা চামচিকাকে পাখি বলে আখ্যায়িত করার মতো! সিয়েরা লিওনের লুঙ্গি বিমানবন্দর থেকে ‘এলিসিয়ান’ নামক নাম না জানা একটি এয়ারলাইনের ১৪ আসনবিশিষ্ট একটি বিমানে, যাতে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের ব্যক্তিরও সোজা হয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব, এক ঘণ্টায় লাইবেরিয়ার জেমস স্প্রিং বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। বিমানটির গায়ে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে, ‘আফ্রিকান ড্রিম’-এর মতো স্বপ্নজাগানিয়া বিশেষণটি। তবে দুজন বালসুলভ ইউরোপীয় পরিচালিত ‘স্বপ্ন’, উড্ডয়নকালে যেকোনো মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে, সেই ভীতিটা কাটিয়ে ওঠা কঠিন!
১৯ জানুয়ারি, ২০১০ দেখা করলাম লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি, ডেনমার্কের ঝানু কূটনীতিবিদ, অ্যালেন মার্গারেট লয়ের সঙ্গে। লাইবেরিয়া জাতিসংঘ-নির্ভর একটি দেশ। ক্ষমতা আর দাপটে তাই এই মহিলা, সেই দেশের নির্বাচিত মহিলা প্রেসিডেন্ট অ্যালেন জনসন সারলিফের প্রায় সমকক্ষ। সাক্ষাত্কারে আমার সঙ্গে ছিলেন লাইবেরিয়ায় ব্র্যাকের প্রতিনিধি আব্দুস সালাম। আমার সঙ্গে যদিও এই ভদ্রমহিলার চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না, কাকতালীয়ভাবে তিনি আমার পরিবারের কিছু সদস্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি বললেন, এই ব্যক্তিগত কারণটি ছাড়া আরও দুটি কারণে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। তা হলো লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অবদান এবং সেই দেশে ব্র্যাকের প্রশংসনীয় কর্মতত্পরতা। তিনি বললেন যে ২১ জানুয়ারি মনরোভিয়া থেকে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার দূরে বার্নগায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর বাত্সরিক মেডেল প্যারেডে প্রধান অতিথি হিসেবে অভিবাদন গ্রহণ করবেন। আমি তাঁকে জানালাম যে ব্র্যাকের সফররত প্রতিনিধি হিসেবে আমি এবং ব্র্যাক আন্তর্জাতিকের নির্বাহী পরিচালক আমিনুল আলমও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম মুজিবুর রহমান বীর বিক্রম দ্বারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। যা তাকে বললাম না তা হলো তাঁর যাত্রা যেখানে বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে হবে বড়জোর আধঘণ্টার, আমরা সেখানে যাব অমসৃণ হাড়ভাঙা মোটরপথে অন্তত চারটি ঘণ্টায়। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী ২০০৩ সাল থেকে কর্তব্যরত রয়েছে। এই পর্যন্ত ছয় দফায় প্রায় ১৪ হাজার বাংলাদেশি সেনা লাইবেরিয়ায় শান্তিরক্ষা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। ছয় বছরে আমাদের ১২ জন সেনা সদস্য কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাণ দিয়েছে সেই দেশে। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশি সেনাসংখ্যা বর্তমানে দুই হাজার ৩৫০ জন এবং সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও তারা বিবিধ জাতিগঠন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকেন। তাঁদের সামরিক কর্মকাণ্ড এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, বললেন আমাদের দেখাশোনায় নিয়োজিত ক্যাপ্টেন কায়সার। গত ১০ মাসেই লাইবেরিয়ায় আমাদের সেনাবাহিনী প্রায় ১০০ বোমা আর গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করেছে।
সুদূর লাইবেরিয়ার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের সেনাবাহিনীর ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ’-এর সুরে চৌকস ও দর্শনীয় কুচকাওয়াজ, আমাদের জাতীয় সংগীতের ব্যান্ড বাদন, উত্তোলিত লাল-সবুজের পতাকা, আমাদের সেনাসদস্যদের ব্রতচারী নৃত্য—সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল বিরল আবেগময় একটি অভিজ্ঞতা। প্যারেডের শেষে মধ্যাহ্নভোজে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি এবং অন্যান্য কূটনীতিক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন লাইবেরিয়ার সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিকান্দার আফজাল। তিনি নাইজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল। ১৬২ বছরের স্বাধীনতার পরও এখনো লাইবেরিয়া তাদের সেনাবাহিনীর উচ্চতম পদে দেশের কাউকে নিয়োগ করার ভরসা পাচ্ছে না!
সুদূরের অজানা বিদেশে আমার বয়সের একজন মানুষের জন্য ডাক্তারের সান্নিধ্য মনোবল বাড়ায়। সেই সেনাক্যাম্পে আমাদের সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলো। এঁদের মধ্যে প্রথম দুজন ছিলেন শিশুবিশেষজ্ঞ মেজর জহির এবং গাইনোকলজিস্ট মেজর শাপলা। তাঁদের দুজনকে যখন বললাম যে প্রয়োজনে তাঁরা আমার কোনো কাজেই আসবেন না, মেজর জহির তাতে আপত্তি জানালেন। বললেন, তাঁর হিসাবে ১৫ বছরের কম এবং ৭০-এর বেশি বয়স্ক সবাই শিশু! ‘তথাস্তু’ বলা ছাড়া ৭৬-এ পা দেওয়া আমি কী আর বলি।
এত বছরের গৃহযুদ্ধ দেশটির প্রশাসনিক এবং উত্পাদন অবকাঠামো বিনষ্ট করে দিয়েছে। লাইবেরিয়া বোধকরি একমাত্র স্বাধীন দেশ যেখানে জেনারেটর ছাড়া কোনো সঞ্চালিত বিদ্যুত্ নেই। বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে বেশ কজন জেলা কমিশনারের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হলো। তাঁরা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতোই। মাইনেও তাঁরা নিয়মিত পান না। তবে যেকোনো কাজের জন্য তাঁরা পয়সা আদায় করে থাকেন। দেশটিতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছেন দুই হাজার। এঁদের কর্মসংস্থানের অদূর ভবিষ্যতে কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষই বেকার। অতএব গ্রামেগঞ্জে, কৃষি, খেতখামার আর ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসৃষ্টি অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। লাইবেরিয়ায় হাঁস-মুরগির খামার অথবা গবাদিপশু প্রতিপালনের কোনো রেওয়াজই গড়ে ওঠেনি। সে দেশে একটি অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে যে হাঁস-মুরগির খামার এবং গবাধিপশু পালন কৃষি সম্প্রসারণের অন্তরায়।
লাইবেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দুজন প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রফেসর টমাস একজন আমেরিকান আফ্রিকান। তাঁর চার সন্তানই যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। তাঁর মন পড়ে রয়েছে সেই দেশে। তিনি বেশ কয়েক বছর পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন। দ্বিতীয় জন, জোসেফ সায়এ গোয়ানু একজন আদিবাসী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে ছিলেন তাঁর দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে লাইবেরিয়ার সামাজিক দুর্বলতার রেখাচিত্র ফুটে উঠল। আমেরিকান লাইবেরিয়ান বংশধরেরা মূলত আমেরিকানির্ভর এবং বিপাকে পড়লেই তাঁরা সেই দেশে পাড়ি জমান। এদিকে দেশটিতে যে ১৪টি উপজাতি রয়েছে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন বিদ্যমান এবং তাদের জাতীয়তাবোধ এতই ভঙ্গুর যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলেই তাদের মধ্যে প্রবণতা রয়েছে প্রতিবেশী দেশ গিনি, আইভরি কোস্ট অথবা সিয়েরা লিওনে চলে যাওয়ার। সংকটে লাইবেরিয়ানরা একটি ভাসমান জনগোষ্ঠী। কাগজে-কলমে লাইবেরিয়া ১৬২ বছরের পুরোনো একটি দেশ কিন্তু জাতিসত্তা তাদের মধ্যে এখনো দানা বাঁধেনি।
এই প্রেক্ষাপটে লাইবেরিয়ায় ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড ২০০৮ সাল থেকে পুরোদমেই চলছে। লাইবেরিয়ার ১৪টি কাউন্টির মধ্যে ছয়টিতে এখন ২০টি ব্রাঞ্চ অফিস এবং চারটি এরিয়া অফিস রয়েছে। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন ছাড়াও কর্মসৃষ্টিতে কিছুটা অবদান ব্র্যাক তো রাখছেই। ইতিমধ্যে লাইবেরিয়ায় প্রায় ২৫ জন বাংলাদেশি কর্মীকে সহযোগিতা করছেন ২৫০ জনেরও বেশি লাইবেরিয়ান এবং তাঁদের সংখ্যা বর্তমান বছরেই আরও বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং ব্র্যাক যে সুনাম অর্জন করেছে তাতে চিড় ধরাতে পারে কিছু বাংলাদেশি আদম ব্যবসায়ীর সম্পূর্ণ নীতিহীন অমানবিক কর্মকাণ্ড। মনরোভিয়ায় এদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁদের প্রায় সবাই অভুক্ত অথবা অর্ধভুক্ত অবস্থায় মনরোভিয়ায় অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। কমপক্ষে তাঁদের সাত-আটজন থাকছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের কানিসাইল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য জনৈক বেলাল উদ্দিন এবং নোয়াখালীর রুবেলের ভাড়া নেওয়া একটি বাড়িতে। বছরে সাড়ে তিন হাজার আমেরিকান ডলারে তাঁরা বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন এই আশায় যে লাইবেরিয়ায় তাঁরা একটি শিল্প সংস্থায় বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এখনো তা সম্ভব হয়নি। বহুকষ্টে তাঁরা কয়েকজন অসহায় বাংলাদেশিকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের বাড়িতে।
কীভাবে এসব বাংলাদেশি প্রতারিত হচ্ছেন? কথা বলে বুঝলাম বাংলাদেশে প্রতারক আদম ব্যাপারীদের ‘টার্গেট’ হচ্ছেন অর্ধশিক্ষিত সব মানুষ যাঁরা এও জানেন না যে লাইবেরিয়ার মতো একটি দেশে কর্মসংস্থান প্রায় অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের দালালেরা লাইবেরিয়ার ব্যাপক দুর্নীতি এবং আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। এসব দালাল লাইবেরিয়ায় ঘুষ দিয়ে ভিসা কিনে ঢাকার অসাধু ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে। তারা বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে তা টিকিটের টাকাসমেত মুনাফায় বিক্রি করে। তারা লোক ঠকানো নকল ওয়ার্ক পারমিটও ব্যবহার করে। এদের লাইবেরিয়ান সহযোগীও জুটে গেছে। প্রতারিতদের বলা হয় যে লাইবেরিয়ায় তাদের জন্য মাসে ৫০০-৬০০ আমেরিকান ডলারের চাকরি অপেক্ষা করছে। আসলে তা সবই মিথ্যা। লাইবেরিয়ায় তাঁদের অবস্থা এতই করুণ যে সামান্য ভাতের মাড়ের জন্য তাঁদের মধ্যে বচসা হয়। ইতিমধ্যেই তাঁদের একজন, আরাফাত, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন। দেখে এলাম মাদারীপুরের ফজলু, চট্টগ্রামের ফয়েজ আহমদ, কুমিল্লার সজীব, কুড়িগ্রামের আব্দুল লতিফ, নওগাঁর আজিজ, ঠাকুরগাঁওয়ের আশরাফুল আলী, নোয়াখালীর ফরহাদ এবং আরও অনেকে এভাবে প্রতারিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দালালদের নাম পরিচয় তাঁদের জানা আছে। তাঁরা জানেন যে বিশেষ করে ঢাকার একজন ট্রাভেল এজেন্ট এই প্রতারণায় সক্রিয় রয়েছে। এসব ভাগ্যহতের স্বার্থেই এই মুহূর্তে সেই দালালগোষ্ঠী এবং ট্রাভেল এজেন্টদের নাম প্রকাশ না করাই যুক্তিসংগত হবে। কারণ এখন প্রতারিত ব্যক্তিরা তাঁদের সাধ্যমতো দেশে ফেরার বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এঁরা দেশে ফিরলে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া।
আশা করব এই দুঃখজনক অবস্থা সাময়িক এবং তার স্থায়ী একটি সুরাহা হবে। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশিদের ইতিবাচক ভূমিকার সম্ভাবনার বিশ্বাসেই এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব। মনরোভিয়ায় দেখা হলো সুইডিশ ‘সিডার’ একজন দায়িত্ববান টিম লিডার হিসেবে কর্মরত বেলাল হোসেনের সঙ্গে। পরিচিত হলাম জনাদুয়েক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যারা পুরোনো লোহা লক্কড় ব্যবসায় ভালো করছেন। কিন্তু সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাত্কার ছিল মাত্র ২৪ বছর বয়সী কুমিল্লার মেঘনার একজন উদ্যোমী ব্যবসায়ী, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। যখন একজন বন্ধুর মারফত মনরোভিয়ায় তাঁর চাচার বিনিয়োগ প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখল না, তখন সবে স্কুল পাস করা জাহাঙ্গীর সেই ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নিলেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে, অতিরিক্ত বিনিয়োগ ছাড়াই মনরোভিয়ায়, ‘বি’-ফার্স্ট নামধারী জনপ্রিয় একটি রেস্তরাঁ স্থাপনা করতে সক্ষম হলেন। ‘বি’ হলো ইংরেজিতে বাংলাদেশের আদ্যক্ষর। ‘ফার্স্ট’ মানে হলো তার প্রথম ব্যবসা। রেস্তরাঁটিতে যথেষ্ট উচ্চমানের আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশীয় খাবার পরিবেশিত হয়। রেস্তরাঁর গ্রিল করা রেড স্নাইপার মাছ আর পরোটা গরুর গোশত ইত্যাদি বিদেশিদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। হালেই জাহাঙ্গীর ‘ডেইলি নিডস’ নামের একটি জেনারেল স্টোর চালু করেছেন—শহরের একটি ব্যস্ত এলাকায় এবং তিনি মনরোভিয়ায় আরও দোকান স্থাপন করতে আগ্রহী। আমরা হোটেলটির লবিতে বসে কথা বলার সময় দেখলাম তাঁর শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে লবিটির চলমান কর্মকাণ্ডের ওপর। ‘কেন, আপনি কি এ রকম একটি হোটেল প্রতিষ্ঠা করতে চান?’ আমার প্রশ্ন। উত্তরে জাহাঙ্গীর সাগ্রহে মাথা নাড়লেন।
লাইবেরিয়ায় ব্র্যাক, আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী অথবা সফল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্বন্ধে যে ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, মুষ্টিমেয় অসাধু আদম ব্যবসায়ীর লোভ-লালসা তা ব্যর্থ করতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
লাইবেরিয়ায় ফিরে যাই। সেই দেশে দুটি বিমানবন্দর রয়েছে। জেমস স্প্রিং এয়ারপোর্ট আর মনরোভিয়া থেকে মোটর পথে প্রায় দেড় ঘণ্টা দূরের রবার্টস এয়ারপোর্ট। এগুলোকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলা কিছুটা চামচিকাকে পাখি বলে আখ্যায়িত করার মতো! সিয়েরা লিওনের লুঙ্গি বিমানবন্দর থেকে ‘এলিসিয়ান’ নামক নাম না জানা একটি এয়ারলাইনের ১৪ আসনবিশিষ্ট একটি বিমানে, যাতে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের ব্যক্তিরও সোজা হয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব, এক ঘণ্টায় লাইবেরিয়ার জেমস স্প্রিং বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। বিমানটির গায়ে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে, ‘আফ্রিকান ড্রিম’-এর মতো স্বপ্নজাগানিয়া বিশেষণটি। তবে দুজন বালসুলভ ইউরোপীয় পরিচালিত ‘স্বপ্ন’, উড্ডয়নকালে যেকোনো মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে, সেই ভীতিটা কাটিয়ে ওঠা কঠিন!
১৯ জানুয়ারি, ২০১০ দেখা করলাম লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি, ডেনমার্কের ঝানু কূটনীতিবিদ, অ্যালেন মার্গারেট লয়ের সঙ্গে। লাইবেরিয়া জাতিসংঘ-নির্ভর একটি দেশ। ক্ষমতা আর দাপটে তাই এই মহিলা, সেই দেশের নির্বাচিত মহিলা প্রেসিডেন্ট অ্যালেন জনসন সারলিফের প্রায় সমকক্ষ। সাক্ষাত্কারে আমার সঙ্গে ছিলেন লাইবেরিয়ায় ব্র্যাকের প্রতিনিধি আব্দুস সালাম। আমার সঙ্গে যদিও এই ভদ্রমহিলার চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না, কাকতালীয়ভাবে তিনি আমার পরিবারের কিছু সদস্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি বললেন, এই ব্যক্তিগত কারণটি ছাড়া আরও দুটি কারণে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। তা হলো লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অবদান এবং সেই দেশে ব্র্যাকের প্রশংসনীয় কর্মতত্পরতা। তিনি বললেন যে ২১ জানুয়ারি মনরোভিয়া থেকে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার দূরে বার্নগায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর বাত্সরিক মেডেল প্যারেডে প্রধান অতিথি হিসেবে অভিবাদন গ্রহণ করবেন। আমি তাঁকে জানালাম যে ব্র্যাকের সফররত প্রতিনিধি হিসেবে আমি এবং ব্র্যাক আন্তর্জাতিকের নির্বাহী পরিচালক আমিনুল আলমও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম মুজিবুর রহমান বীর বিক্রম দ্বারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। যা তাকে বললাম না তা হলো তাঁর যাত্রা যেখানে বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে হবে বড়জোর আধঘণ্টার, আমরা সেখানে যাব অমসৃণ হাড়ভাঙা মোটরপথে অন্তত চারটি ঘণ্টায়। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী ২০০৩ সাল থেকে কর্তব্যরত রয়েছে। এই পর্যন্ত ছয় দফায় প্রায় ১৪ হাজার বাংলাদেশি সেনা লাইবেরিয়ায় শান্তিরক্ষা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। ছয় বছরে আমাদের ১২ জন সেনা সদস্য কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাণ দিয়েছে সেই দেশে। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশি সেনাসংখ্যা বর্তমানে দুই হাজার ৩৫০ জন এবং সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও তারা বিবিধ জাতিগঠন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকেন। তাঁদের সামরিক কর্মকাণ্ড এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, বললেন আমাদের দেখাশোনায় নিয়োজিত ক্যাপ্টেন কায়সার। গত ১০ মাসেই লাইবেরিয়ায় আমাদের সেনাবাহিনী প্রায় ১০০ বোমা আর গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করেছে।
সুদূর লাইবেরিয়ার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের সেনাবাহিনীর ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ’-এর সুরে চৌকস ও দর্শনীয় কুচকাওয়াজ, আমাদের জাতীয় সংগীতের ব্যান্ড বাদন, উত্তোলিত লাল-সবুজের পতাকা, আমাদের সেনাসদস্যদের ব্রতচারী নৃত্য—সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল বিরল আবেগময় একটি অভিজ্ঞতা। প্যারেডের শেষে মধ্যাহ্নভোজে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি এবং অন্যান্য কূটনীতিক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন লাইবেরিয়ার সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিকান্দার আফজাল। তিনি নাইজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল। ১৬২ বছরের স্বাধীনতার পরও এখনো লাইবেরিয়া তাদের সেনাবাহিনীর উচ্চতম পদে দেশের কাউকে নিয়োগ করার ভরসা পাচ্ছে না!
সুদূরের অজানা বিদেশে আমার বয়সের একজন মানুষের জন্য ডাক্তারের সান্নিধ্য মনোবল বাড়ায়। সেই সেনাক্যাম্পে আমাদের সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলো। এঁদের মধ্যে প্রথম দুজন ছিলেন শিশুবিশেষজ্ঞ মেজর জহির এবং গাইনোকলজিস্ট মেজর শাপলা। তাঁদের দুজনকে যখন বললাম যে প্রয়োজনে তাঁরা আমার কোনো কাজেই আসবেন না, মেজর জহির তাতে আপত্তি জানালেন। বললেন, তাঁর হিসাবে ১৫ বছরের কম এবং ৭০-এর বেশি বয়স্ক সবাই শিশু! ‘তথাস্তু’ বলা ছাড়া ৭৬-এ পা দেওয়া আমি কী আর বলি।
এত বছরের গৃহযুদ্ধ দেশটির প্রশাসনিক এবং উত্পাদন অবকাঠামো বিনষ্ট করে দিয়েছে। লাইবেরিয়া বোধকরি একমাত্র স্বাধীন দেশ যেখানে জেনারেটর ছাড়া কোনো সঞ্চালিত বিদ্যুত্ নেই। বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে বেশ কজন জেলা কমিশনারের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হলো। তাঁরা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতোই। মাইনেও তাঁরা নিয়মিত পান না। তবে যেকোনো কাজের জন্য তাঁরা পয়সা আদায় করে থাকেন। দেশটিতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছেন দুই হাজার। এঁদের কর্মসংস্থানের অদূর ভবিষ্যতে কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষই বেকার। অতএব গ্রামেগঞ্জে, কৃষি, খেতখামার আর ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসৃষ্টি অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। লাইবেরিয়ায় হাঁস-মুরগির খামার অথবা গবাদিপশু প্রতিপালনের কোনো রেওয়াজই গড়ে ওঠেনি। সে দেশে একটি অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে যে হাঁস-মুরগির খামার এবং গবাধিপশু পালন কৃষি সম্প্রসারণের অন্তরায়।
লাইবেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দুজন প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রফেসর টমাস একজন আমেরিকান আফ্রিকান। তাঁর চার সন্তানই যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। তাঁর মন পড়ে রয়েছে সেই দেশে। তিনি বেশ কয়েক বছর পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন। দ্বিতীয় জন, জোসেফ সায়এ গোয়ানু একজন আদিবাসী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে ছিলেন তাঁর দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে লাইবেরিয়ার সামাজিক দুর্বলতার রেখাচিত্র ফুটে উঠল। আমেরিকান লাইবেরিয়ান বংশধরেরা মূলত আমেরিকানির্ভর এবং বিপাকে পড়লেই তাঁরা সেই দেশে পাড়ি জমান। এদিকে দেশটিতে যে ১৪টি উপজাতি রয়েছে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন বিদ্যমান এবং তাদের জাতীয়তাবোধ এতই ভঙ্গুর যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলেই তাদের মধ্যে প্রবণতা রয়েছে প্রতিবেশী দেশ গিনি, আইভরি কোস্ট অথবা সিয়েরা লিওনে চলে যাওয়ার। সংকটে লাইবেরিয়ানরা একটি ভাসমান জনগোষ্ঠী। কাগজে-কলমে লাইবেরিয়া ১৬২ বছরের পুরোনো একটি দেশ কিন্তু জাতিসত্তা তাদের মধ্যে এখনো দানা বাঁধেনি।
এই প্রেক্ষাপটে লাইবেরিয়ায় ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড ২০০৮ সাল থেকে পুরোদমেই চলছে। লাইবেরিয়ার ১৪টি কাউন্টির মধ্যে ছয়টিতে এখন ২০টি ব্রাঞ্চ অফিস এবং চারটি এরিয়া অফিস রয়েছে। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন ছাড়াও কর্মসৃষ্টিতে কিছুটা অবদান ব্র্যাক তো রাখছেই। ইতিমধ্যে লাইবেরিয়ায় প্রায় ২৫ জন বাংলাদেশি কর্মীকে সহযোগিতা করছেন ২৫০ জনেরও বেশি লাইবেরিয়ান এবং তাঁদের সংখ্যা বর্তমান বছরেই আরও বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং ব্র্যাক যে সুনাম অর্জন করেছে তাতে চিড় ধরাতে পারে কিছু বাংলাদেশি আদম ব্যবসায়ীর সম্পূর্ণ নীতিহীন অমানবিক কর্মকাণ্ড। মনরোভিয়ায় এদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁদের প্রায় সবাই অভুক্ত অথবা অর্ধভুক্ত অবস্থায় মনরোভিয়ায় অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। কমপক্ষে তাঁদের সাত-আটজন থাকছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের কানিসাইল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য জনৈক বেলাল উদ্দিন এবং নোয়াখালীর রুবেলের ভাড়া নেওয়া একটি বাড়িতে। বছরে সাড়ে তিন হাজার আমেরিকান ডলারে তাঁরা বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন এই আশায় যে লাইবেরিয়ায় তাঁরা একটি শিল্প সংস্থায় বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এখনো তা সম্ভব হয়নি। বহুকষ্টে তাঁরা কয়েকজন অসহায় বাংলাদেশিকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের বাড়িতে।
কীভাবে এসব বাংলাদেশি প্রতারিত হচ্ছেন? কথা বলে বুঝলাম বাংলাদেশে প্রতারক আদম ব্যাপারীদের ‘টার্গেট’ হচ্ছেন অর্ধশিক্ষিত সব মানুষ যাঁরা এও জানেন না যে লাইবেরিয়ার মতো একটি দেশে কর্মসংস্থান প্রায় অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের দালালেরা লাইবেরিয়ার ব্যাপক দুর্নীতি এবং আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। এসব দালাল লাইবেরিয়ায় ঘুষ দিয়ে ভিসা কিনে ঢাকার অসাধু ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে। তারা বিদেশ গমন ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে তা টিকিটের টাকাসমেত মুনাফায় বিক্রি করে। তারা লোক ঠকানো নকল ওয়ার্ক পারমিটও ব্যবহার করে। এদের লাইবেরিয়ান সহযোগীও জুটে গেছে। প্রতারিতদের বলা হয় যে লাইবেরিয়ায় তাদের জন্য মাসে ৫০০-৬০০ আমেরিকান ডলারের চাকরি অপেক্ষা করছে। আসলে তা সবই মিথ্যা। লাইবেরিয়ায় তাঁদের অবস্থা এতই করুণ যে সামান্য ভাতের মাড়ের জন্য তাঁদের মধ্যে বচসা হয়। ইতিমধ্যেই তাঁদের একজন, আরাফাত, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন। দেখে এলাম মাদারীপুরের ফজলু, চট্টগ্রামের ফয়েজ আহমদ, কুমিল্লার সজীব, কুড়িগ্রামের আব্দুল লতিফ, নওগাঁর আজিজ, ঠাকুরগাঁওয়ের আশরাফুল আলী, নোয়াখালীর ফরহাদ এবং আরও অনেকে এভাবে প্রতারিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দালালদের নাম পরিচয় তাঁদের জানা আছে। তাঁরা জানেন যে বিশেষ করে ঢাকার একজন ট্রাভেল এজেন্ট এই প্রতারণায় সক্রিয় রয়েছে। এসব ভাগ্যহতের স্বার্থেই এই মুহূর্তে সেই দালালগোষ্ঠী এবং ট্রাভেল এজেন্টদের নাম প্রকাশ না করাই যুক্তিসংগত হবে। কারণ এখন প্রতারিত ব্যক্তিরা তাঁদের সাধ্যমতো দেশে ফেরার বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এঁরা দেশে ফিরলে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া।
আশা করব এই দুঃখজনক অবস্থা সাময়িক এবং তার স্থায়ী একটি সুরাহা হবে। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশিদের ইতিবাচক ভূমিকার সম্ভাবনার বিশ্বাসেই এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব। মনরোভিয়ায় দেখা হলো সুইডিশ ‘সিডার’ একজন দায়িত্ববান টিম লিডার হিসেবে কর্মরত বেলাল হোসেনের সঙ্গে। পরিচিত হলাম জনাদুয়েক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যারা পুরোনো লোহা লক্কড় ব্যবসায় ভালো করছেন। কিন্তু সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাত্কার ছিল মাত্র ২৪ বছর বয়সী কুমিল্লার মেঘনার একজন উদ্যোমী ব্যবসায়ী, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। যখন একজন বন্ধুর মারফত মনরোভিয়ায় তাঁর চাচার বিনিয়োগ প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখল না, তখন সবে স্কুল পাস করা জাহাঙ্গীর সেই ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নিলেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে, অতিরিক্ত বিনিয়োগ ছাড়াই মনরোভিয়ায়, ‘বি’-ফার্স্ট নামধারী জনপ্রিয় একটি রেস্তরাঁ স্থাপনা করতে সক্ষম হলেন। ‘বি’ হলো ইংরেজিতে বাংলাদেশের আদ্যক্ষর। ‘ফার্স্ট’ মানে হলো তার প্রথম ব্যবসা। রেস্তরাঁটিতে যথেষ্ট উচ্চমানের আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশীয় খাবার পরিবেশিত হয়। রেস্তরাঁর গ্রিল করা রেড স্নাইপার মাছ আর পরোটা গরুর গোশত ইত্যাদি বিদেশিদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। হালেই জাহাঙ্গীর ‘ডেইলি নিডস’ নামের একটি জেনারেল স্টোর চালু করেছেন—শহরের একটি ব্যস্ত এলাকায় এবং তিনি মনরোভিয়ায় আরও দোকান স্থাপন করতে আগ্রহী। আমরা হোটেলটির লবিতে বসে কথা বলার সময় দেখলাম তাঁর শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে লবিটির চলমান কর্মকাণ্ডের ওপর। ‘কেন, আপনি কি এ রকম একটি হোটেল প্রতিষ্ঠা করতে চান?’ আমার প্রশ্ন। উত্তরে জাহাঙ্গীর সাগ্রহে মাথা নাড়লেন।
লাইবেরিয়ায় ব্র্যাক, আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী অথবা সফল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্বন্ধে যে ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, মুষ্টিমেয় অসাধু আদম ব্যবসায়ীর লোভ-লালসা তা ব্যর্থ করতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
No comments