সময়ের প্রতিবিম্ব-লাশ-কফিনের ফাঁদে বিরোধী দল by এবিএম মূসা

একটি লাশ চাই। অতীতকালে যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অথবা গণবিক্ষোভের সময় একটি লাশের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সেই লাশটি কোথা থেকে এল অথবা লাশটি যখন জীবিত ছিল তখন কী ছিল তার পরিচয়, এ নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলত।


এ কারণে পুলিশ অথবা আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত লাশটি কোনোভাবেই যেন আন্দোলনকারীদের হাতে না পড়ে, তাই সেটি গুম করে দেওয়া হতো। নিতান্তই লাশ পাওয়া না গেলে এ ধরনের গুমের খবর রটনা হতো। অপরদিকে, আন্দোলনকারীদের লাশের জানাজা আর দাফনের ভাবনা ছিল গৌণ, মুখ্য ছিল ‘হত্যার বিচার চাই’ অথবা ‘অমুক ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ স্লোগান দিয়ে মিছিল। তাই আমাদের তত্কালীন রাজনৈতিক পরিবেশে একটি বা দুটি লাশের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
কালের পরিক্রমায়, আন্দোলন-বিক্ষোভের বিস্তৃতিতে লাশের সংখ্যা এত বেড়ে গেল, একটি-দুটির গুরুত্বই কমে গেল। এখন সেই লাশের গুরুত্ব নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে ফিরে এসেছে। আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ একটি কফিনের লাশ এখন জাতীয় সংসদে, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে ‘বিশেষ’ আলোচ্য বিষয়। সেই লাশের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে, আমাদের গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলুষিত করে সংসদীয় রাজনীতি চর্চাকে নিম্নপর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। আমাদের গণতান্ত্রিক জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ ও সামাজিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আলোচ্য লাশটি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের। জাতীয় সংসদে এই লাশ অথবা কফিন বাক্স এবং সেটির অস্তিত্ব সব জাতীয় ও জনজীবনের ছোট-বড় সমস্যাকে আড়াল করে দিয়েছে। অথচ বহু দিন পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের প্রত্যাবর্তনের পর সবাই আশা করেছিলেন, সাম্প্রতিককালের পুঞ্জীভূত জনজীবন বিপর্যয়কারী অসংখ্য সমস্যা নিয়ে সংসদে প্রাণবন্ত ও নিবিড় আলোচনা হবে। সাধারণ মানুষ এই একটি কারণেই বিরোধী দলকে সংসদে দেখতে চেয়েছে, বারবার বলেছে সংসদে আসতে। তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে, সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত দুর্ভোগ নিয়ে দিশেহারা, রাষ্ট্র-সরকারের সমস্যা ও সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে বিভ্রান্ত। গ্যাস-বিদ্যুত্, যানজট আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে। শিক্ষাঙ্গনে রক্তস্রোত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি—এমনই আরও অনেক ছোট-বড় সমস্যায় জনমনে ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ তাই বিরোধী দলকে সংসদে চেয়েছে যেন তারা এসব নিয়ে সরগরম আলোচনা করে। তাঁরা সরকারের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরবেন এবং ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে সমাধানের নিজস্ব চিন্তাধারা সংসদে পেশ করবেন। তাঁরা সাম্প্রতিককালের কয়েকটি গুরুতর রাষ্ট্রীয় সমস্যা সংসদে আলোচনা করবেন, যা ইতিমধ্যে সর্বত্র সাধারণ্যে আলোচিত হচ্ছে। সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে সম্পাদিত কথিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক। দেশের স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে এসব চুক্তি-সমঝোতার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে কুহেলিকা। কথিত কুহেলিকা, বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে দূরীভূত হবে—এমনটিই হচ্ছে জনগণের স্বাভাবিক ভাবনা।
অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে, সরকারের তরফ থেকে জনগণকে স্বচ্ছতার সঙ্গে সব বলা হচ্ছে না, তাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে। এ সবই সংসদে দুই পক্ষের আলোচনা বা বাগিবতণ্ডার মাধ্যমে দূর হবে। বিরোধী দল গণমাধ্যমে আর বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে, ‘এই সরকার দেশের সর্বনাশ করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে সব বিকিয়ে দিয়েছেন বলে শুধু ‘গেল-গেল’ আওয়াজ তুলেছেন, যদিও ‘কী গেল’ তা পুরোপুরি বলছেন না, হয়তো নিজেরাও জানেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনেক পেয়েছি, কিছু দিইনি। জয় করে এসেছি।’ আশা করা গিয়েছিল, বিরোধী দল সংসদে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর হারানো-প্রাপ্তি বিশ্লেষণ দাবি করবে। সংসদে একটি প্রাণবন্ত আলোচনার ঝড় বইয়ে দেবে।
বাস্তবে তা হলো না, একটি লাশ নিয়ে সংসদে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, মনে হলো বিরোধী দলের কাছে ওপরে বর্ণিত সব সমস্যা নিয়ে আলোচনার চেয়ে একটি লাশের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ সংসদে আলোচনার আরও বিষয় আছে। বিদ্যুত্ ও গ্যাস নেই অনেক দিন ধরে। শিক্ষাঙ্গনে একটির পর একটি লাশ পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের ভূমিকা এবং অপরাজনীতিতে জনগণ শঙ্কিত। বিরোধী দল সংসদে সেই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি করবে। রাষ্ট্র-পরিচালনায় সরকার ও মন্ত্রী তাঁদের ব্যর্থতার সাফাই অথবা কৈফিয়ত দেবেন অথবা প্রকৃত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। সে সবই চাপা পড়ে গেল একটি লাশ আছে কি নেই, সেই অশালীন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের আড়ালে। জিয়া উদ্যানের কবরের কফিনের অস্তিত্ব সংকটের নিচে চাপা পড়ে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানহোল থেকে উদ্ধারকৃত এক অভাগার লাশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে পড়ে থাকা একজন নিরীহ ছাত্র।
ভাবছি, জাতীয় সমস্যা আড়াল করার জন্যই কি একটি কফিনের ভেতর উঁকি মারছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য? বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ম্যানহোলের লাশ নিয়ে অস্বস্তিবোধের, অপরাধবোধের কারণে সেই প্রসঙ্গটি সংসদকক্ষে আলোচনা এড়িয়ে যেতে হই-হই করে কক্ষের বাইরে চলে গেলেন? কফিন আর লাশ নিয়ে গুরুত্বহীন অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যটিকে প্রাধান্য দিয়ে একজন সরকারি সদস্যের উসকানিতে হইচই করলেন, ফাইল ছিঁড়লেন, আর সংসদকক্ষে আসা-যাওয়া করলেন? তারপরও আদ্যোপান্ত বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে ভাবছি, হঠাত্ করে এতদিন পর সরকারি কৌশলীরা জিয়া উদ্যানের কফিনের খোঁজ করছেন কেন, নির্বোধ বিরোধী দল কি কারণটি অনুধাবন করতে পারছে না? তারা সরকারি দলের পাতা কফিনের-লাশের ফাঁদে জড়িয়ে না পড়ে জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে সংসদে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ হারাচ্ছে। তাই তো বিরোধী সদস্যদের বলছি, লাশের বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ে চুক্তি-সমঝোতা নিয়ে টেবিল চাপড়ান, গ্যাস-বিদ্যুতের কথা বলতে না দিলে ফাইল ছোড়েন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণের দুর্ভোগের কথা বলুন, শিক্ষাঙ্গনের লাশ আর অশান্ত পরিবেশ নিয়ে আলোচনায় সরকারকে বিব্রত করুন। সংসদে এলেনই যখন, আসা-যাওয়া করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু প্রকৃত প্রজ্ঞাবান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে লাশ আর দেশ বেচা নিয়ে হইচই না করে জনগণের কথা বলুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.