একুশে-ভাষাশহীদ জব্বারের কথা by দীপংকর চন্দ
‘পাঁচুয়া গ্রামে নয়, আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে আসলে বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন লঙ্গাইর গ্রামে। আসাম-বেঙ্গল রেলপথ স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ সরকার যখন বিভিন্ন জনের জমি হুকুম-দখল শুরু করে, তখনই ভিটেচ্যুত হই আমরা।
পারিবারিক এক করুণ ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমার বাবার দাদা হামেদ আলী শেখকে কোলে নিয়ে তাঁর মা লঙ্গাইরসংলগ্ন গ্রাম পাঁচুয়ার অধিবাসী খিদির সরকারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময় কিছু ভূ-সম্পত্তির মালিকানা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন পাঁচুয়ায়। হ্যাঁ, আমার বাবা ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের জন্ম এই পাঁচুয়া গ্রামেই।’ কথাগুলো বিষণ্ন্ন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের একমাত্র ছেলে নুরুল ইসলাম বাদল এবং সদ্যসমাপ্ত কথার রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই তিনি কথা শুরু করেন পুনরায়, ‘হামেদ আলী শেখের মেজ ছেলে হাছেন আলী শেখের ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠা খোদেজা খাতুন। তাঁর ঠিক পরেই আমার বাবা আবদুল জব্বারের অবস্থান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৯ সালের মধ্যপাদে। বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে আমার দাদি সাফাতুন নেছা ভীষণ ভালোবাসতেন বাবাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য দাদি ও দাদাই বাবাকে ভর্তি করান খারুয়া মুকুন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় আকস্মিকভাবে অসুস্থতায় নিপতিত হন হাছেন আলী শেখ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে বালক আবদুল জব্বারের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে তখনই। তারপর অতিক্রান্ত হয় বেশ কিছু বছর। বালক জব্বার পদার্পণ করেন কৈশোরে। কিন্তু এ সময় কী এক অজানা ঘোরে আক্রান্ত হন তিনি! পরিবার-পরিজন ছেড়ে ট্রেনে চেপে বসেন একদিন। সবার অগোচরে চলে যান নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ সদরের প্রধান রেলস্টেশনের কাছেই নদীবন্দর থেকে একটি জাহাজে চড়ে তত্কালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে পৌঁছান। তারপর বেশ কয়েক বছর এ দেশ-ও দেশ ঘোরার পর ১৯৩৮ সালের জুন মাসে বার্মা থেকে কলকাতা হয়ে গফরগাঁও ফেরেন তিনি।’
‘দেশে ফেরার পরবর্তী বছর অর্থাত্ ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ভাগ হয় দেশ। সদ্য বিভক্ত দেশে গঠিত হয় পিএনজি (পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড)। সেখানে যোগ দেন ২৮ বছরের যুবক জব্বার। পরবর্তী সময় এ সংগঠনটি ভেঙে দেওয়া হয়। তবে ভেঙে দেওয়া সংগঠনের সদস্যদের কিছু অংশকে যুক্ত করা হয় সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এবং বাদবাকি অংশকে নিয়ে গঠিত হয় আনসার বাহিনী। আবদুল জব্বার নবগঠিত আনসার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। ময়মনসিংহ সদর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে গ্রামে ফিরে আনসার কমান্ডার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এ সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য চাকরির পাশাপাশি খারুয়া বড়াইল গ্রামের লক্ষ্মীর বাজারে একটা মুদি দোকানও চালু করেন আবদুল জব্বার। ১৯৪৯ সালে বাল্যবন্ধু মফিজ উদ্দিনের ছোট বোন আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জন্ম নেয় আবদুল জব্বারের একমাত্র সন্তান। হ্যাঁ, অগ্রহায়ণ মাসের শেষ রোববার জন্ম আমার। সে বছর অগ্রহায়ণ মাসেও ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি ছিল। তাই বাবা আমার নাম রাখেন বাদল। পরবর্তী সময় গ্রাম্য রীতিতে অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আমার নাম রাখা হয় নুরুল ইসলাম।’
‘১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আমার নানি উলফত জান গুরুতর অসুস্থতায় নিপতিত হন। আমার মামা মফিজ উদ্দিন নানিকে নিয়ে ঢাকা যান ১৭ ফেব্রুয়ারি। নানিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাড়ি ফেরেন মামা। বাবা ঢাকা রওনা হন ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে। দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছে নানির অসুস্থতার খোঁজখবর নেন তিনি। কথা বলেন নানির চিকিত্সায় নিয়োজিত চিকিত্সকদের সঙ্গে। রাতে তিনি থাকেন বকশি বাজার আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলে। পাঁচুয়া গ্রামের আবদুল হাই তখন মাদ্রাসার ছাত্র। তারই সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন জব্বার। পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেডিকেল কলেজে আসেন তিনি। শাশুড়ির খোঁজখবর নিয়ে উপস্থিত হন মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ব্যারাকের ২০ নম্বর শেডের সামনে। তিনি জানতেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা এঁটেছে ছাত্ররা। তারা কি পারবে এ কাজে সফল হতে? জব্বার কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছিলেন ছাত্রদের কর্মকাণ্ড। দুপুরের পর থেকেই পরিস্থিতি চরমে উঠল। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হলো। এবার আর নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকা চলে না কারও। উপস্থিত জনসাধারণ ছাত্রদের কাঁধে কাঁধ মিলাল দৃঢ়ভাবে। আবদুল জব্বারও মিলিত হলেন ছাত্র-জনতার ওই মহাস্রোতে। এবার শুধু লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ নয়, অবাঙালি ডিসি কোরাইশির নির্দেশে গুলি চালাল পুলিশ। সেই গুলিতে রফিক উদ্দিনের মৃত্যু হলো সঙ্গে সঙ্গেই। আবুল বরকত, আবদুস সালাম ছাড়াও গুলি লাগল আবদুল জব্বারের শরীরেও। হ্যাঁ, ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিনের মতো সেদিনই মৃত্যুতে বিলীন হলো আমার বাবার প্রাণসত্তা।’
‘দেশে ফেরার পরবর্তী বছর অর্থাত্ ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ভাগ হয় দেশ। সদ্য বিভক্ত দেশে গঠিত হয় পিএনজি (পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড)। সেখানে যোগ দেন ২৮ বছরের যুবক জব্বার। পরবর্তী সময় এ সংগঠনটি ভেঙে দেওয়া হয়। তবে ভেঙে দেওয়া সংগঠনের সদস্যদের কিছু অংশকে যুক্ত করা হয় সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এবং বাদবাকি অংশকে নিয়ে গঠিত হয় আনসার বাহিনী। আবদুল জব্বার নবগঠিত আনসার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। ময়মনসিংহ সদর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে গ্রামে ফিরে আনসার কমান্ডার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এ সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য চাকরির পাশাপাশি খারুয়া বড়াইল গ্রামের লক্ষ্মীর বাজারে একটা মুদি দোকানও চালু করেন আবদুল জব্বার। ১৯৪৯ সালে বাল্যবন্ধু মফিজ উদ্দিনের ছোট বোন আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জন্ম নেয় আবদুল জব্বারের একমাত্র সন্তান। হ্যাঁ, অগ্রহায়ণ মাসের শেষ রোববার জন্ম আমার। সে বছর অগ্রহায়ণ মাসেও ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি ছিল। তাই বাবা আমার নাম রাখেন বাদল। পরবর্তী সময় গ্রাম্য রীতিতে অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আমার নাম রাখা হয় নুরুল ইসলাম।’
‘১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আমার নানি উলফত জান গুরুতর অসুস্থতায় নিপতিত হন। আমার মামা মফিজ উদ্দিন নানিকে নিয়ে ঢাকা যান ১৭ ফেব্রুয়ারি। নানিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাড়ি ফেরেন মামা। বাবা ঢাকা রওনা হন ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে। দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছে নানির অসুস্থতার খোঁজখবর নেন তিনি। কথা বলেন নানির চিকিত্সায় নিয়োজিত চিকিত্সকদের সঙ্গে। রাতে তিনি থাকেন বকশি বাজার আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলে। পাঁচুয়া গ্রামের আবদুল হাই তখন মাদ্রাসার ছাত্র। তারই সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন জব্বার। পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেডিকেল কলেজে আসেন তিনি। শাশুড়ির খোঁজখবর নিয়ে উপস্থিত হন মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ব্যারাকের ২০ নম্বর শেডের সামনে। তিনি জানতেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা এঁটেছে ছাত্ররা। তারা কি পারবে এ কাজে সফল হতে? জব্বার কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছিলেন ছাত্রদের কর্মকাণ্ড। দুপুরের পর থেকেই পরিস্থিতি চরমে উঠল। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হলো। এবার আর নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকা চলে না কারও। উপস্থিত জনসাধারণ ছাত্রদের কাঁধে কাঁধ মিলাল দৃঢ়ভাবে। আবদুল জব্বারও মিলিত হলেন ছাত্র-জনতার ওই মহাস্রোতে। এবার শুধু লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ নয়, অবাঙালি ডিসি কোরাইশির নির্দেশে গুলি চালাল পুলিশ। সেই গুলিতে রফিক উদ্দিনের মৃত্যু হলো সঙ্গে সঙ্গেই। আবুল বরকত, আবদুস সালাম ছাড়াও গুলি লাগল আবদুল জব্বারের শরীরেও। হ্যাঁ, ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিনের মতো সেদিনই মৃত্যুতে বিলীন হলো আমার বাবার প্রাণসত্তা।’
No comments