আমার ভাষা আমার একুশ-সংবিধান ও বাংলা ভাষা by সৌরভ সিকদার

সংবিধান হচ্ছে দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান নির্দেশিকা। একে ভিত্তি বা রক্ষাকবচও বলা হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে যখন কোনো নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন সে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কিছু মূলনীতি ঠিক করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য তেমনি একটি সংবিধান প্রণীত হয়েছিল।


এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের সংবিধান পৃথিবীর যেকোনো উন্নত সংবিধানের সমতুল্য। একই সঙ্গে এ কথাও প্রযোজ্য যে স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বড় একটি সংবিধান রচনা করতে গেলে কিছু অর্থ-ভাষাতাত্ত্বিক ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। যেকোনো ভুল ভুলই। ভুল হওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু তা সংশোধনের প্রয়াস না নেওয়া নিঃসন্দেহে দোষের। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হলে স্বাধীন পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল নয় বছর। সেখানে ১৯৫০ সালে ‘মূলনীতি কমিটি’ প্রস্তাব করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী এবং দুই পাকিস্তান মিলে বাংলা হচ্ছে প্রধান ভাষা, তা উপেক্ষা করে উর্দুর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের পরবর্তী পরিণতির ইতিহাস আমাদের জানা। যদিও শেষ পর্যন্ত সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যত তা ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে বাংলা উপেক্ষিতই ছিল।
যেকোনো সংবিধানে ভাষার প্রশ্ন এবং সংবিধানের ভাষা, অর্থাত্ যে ভাষায় সংবিধান রচিত হয়েছে সেই ভাষা কতটা স্বচ্ছ ও দ্ব্যর্থতামুক্ত, তা যেমন একটি বড় প্রশ্ন, তেমনি সংবিধানে ব্যবহূত শব্দাবলি, নাম, প্রতিষ্ঠান, আইনকানুন এমনকি বিরতিচিহ্নগুলোও গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ভুল থাকলেও । প্রয়োজন মনে করলে জনগণের সংবিধান জনগন তাদের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ না পাল্টানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটিই প্রামাণ্য। সমস্যা হচ্ছে, ভাষা মানুষ প্রয়োগ করে তার ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে, সেখানে নিয়ম করে কী বলবে কী বলবে না তার নির্দেশনা দেওয়া কঠিন। তাই আমাদের সংবিধানে সংসদ সদস্য শব্দটি রয়েছে, অথচ আমরা প্রয়োগ করছি ‘সাংসদ’—এটি সংবিধানের ভাষা বিচারে আইনসিদ্ধ নয়। বিভিন্ন সময় যখন সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, তখন আগের ধারাবতিকতা লক্ষ না করে কোথাও `Bengali’ কোথাও `Bangla’ রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মূল সংবিধান রচিত হয়েছিল ইংরেজিতে। পরে তার বাংলায় অনুবাদ করা হয় এবং এও বলা হয়, ‘বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে এবং উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন’ (১৫৩/২); এরপর (৩) বলা হয়েছে, ‘বাংলা-ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।’
১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্রের ৪ নম্বর আদেশে বলা হয়েছে এর উল্টো কথা। তা হচ্ছে, যেকোনো ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, অর্থগত অসংগতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘ইংরেজি পাঠ প্রধান্য পাইবে’।
অর্থাত্ আমাদের সংবিধানে ভাষা প্রসঙ্গে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে এবং এটি হয়েছে এ কাজে ভাষাবিশেষজ্ঞ সমপৃক্ত না থাকার ফলে। একই সঙ্গে পরবর্তীকালে যাঁরা একে পরিবর্তন করেছেন, তাঁরা ভাষার ব্যাপারে মনোযোগী যেমন ছিলেন না, তেমনি বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমাদের সংবিধানের প্রথম ভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এরপর দ্বিতীয় ভাগের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: রাষ্ট্র জাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রভৃতি উন্নয়নের ব্যবস্থা করবেন। অর্থাত্ সংবিধানে ‘রাষ্ট্রভাষা’ এবং ‘জাতীয় ভাষার’ প্রসঙ্গ এসেছে। এখানে একটা বিষয় বলে নেওয়া প্রয়োজন, বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্র। কাজেই আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা তথা ইউনেসকো-নির্দেশিত দাপ্তরিক ভাষা বাংলা হওয়া যেমন সংগত, তেমনি এ দেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা আদিবাসীদের ভাষার স্বীকৃতিও থাকা প্রয়োজন ছিল। ‘বাংলা ছাড়াও এ দেশের অন্য সব ভাষাভাষীর ভাষিক মর্যাদা রক্ষাও এই সংবিধানের লক্ষ্য’—এ ধরনের একটি লাইন তৃতীয় অনুচ্ছেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে আরও ভালো হতো। ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ হলে এর আরও ভাষাগত পরিমার্জন করা যেতে পারে। বিশেষ করে ইংরেজি ও বাংলা পাঠের মধ্যে যে শব্দ ও অর্থগত দ্ব্যর্থকতা রয়েছে, তা সংশোধন করা জরুরি। যেমন ইংরেজি `Local Government’-এর বাংলা হয়েছে স্থানীয় শাসন, স্পিকারের বাংলা অধ্যক্ষ প্রভৃতি। আবার বাংলা অংশে মাঝেমধ্যে রোমান হরফের প্রয়োগও রয়েছে। ভারতে হিন্দি যেমন দাপ্তরিক ভাষা, রাষ্ট্রভাষা নয়, তেমনি আমাদের সংবিধানের এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাখাওয়াত্ আনসারী লিখেছেন—‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’—এই উল্লেখের মাধ্যমে সংবিধানপ্রণেতারা বাঙালির সংবেদনশীলতার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করলেও আমরা ভাষাবৈজ্ঞনিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছি যে ‘রাষ্ট্রভাষা’ অভিধাটি অভ্রান্ত নয়। এ স্থানে যথার্থ অভিধা ‘দাপ্তরিক ভাষা’ (২০০৯) । ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। এমনকি সংবিধানেই এ দেশের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, সরকার বা রাষ্ট্র সে বিষয়টিকে কখনো কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন বলে আমরা জানি না, অর্থাত্ বাংলা ভাষা প্রয়োগের যে নৈরাজ্য সৃষ্ট হয়েছে, তা প্রতিহত করার জন্য সাংবিধানিক বিধানও রয়েছে (দ্বিতীয় ভাগের ২৩ পরিচ্ছেদ)।
রাষ্ট্র বা সরকার এই বিধানকে প্রয়োগ না করে জাতীয় সংস্কৃতি-ভাষা রক্ষা না করে প্রকারান্তরে সংবিধান লঙ্ঘনই করছেন।
ভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা সংবিধান ও বাংলা ভাষা বিষয়ে আমাদের জানান, আমাদের সংবিধানে বাংলা ভাষা বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আর যা বলা হয়েছে তা আইন বলে পরিগণিত। কাজেই এগুলো না মানা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। তবে সংবিধানে আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কিছু ভাষাগত সমস্যা রয়ে গেছে। সংবিধানের ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ না হওয়ায় কোনো কোনো স্থানে বক্তব্য সাংঘর্ষিক বা দ্ব্যর্থবোধক মনে হতে পারে। ভাষা বিষয়ে সংবিধান অনেক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত দিলেও তা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ তৈরি করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি। অনেক কিছুরই পদবি, নাম পরিবর্তন হয়নি; প্রয়োজন নেই তবু ইংরেজি শব্দ রয়েছে। ‘আমাদের সংবিধান-এর আর একটি দিক হচ্ছে, সে সময়ের প্রেক্ষিত ও আবেগের কারণে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি স্পষ্ট হলেও এ দেশের অন্য ভাষাগুলো ঠাঁই পায়নি। এ বিষয়ে ভাবার এখন সময় এসেছে।’
সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম-কানুন-নীতি। কাজেই তার মধ্যে যেমন রাষ্ট্রের ভাষা অর্থাত্ রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব মানুষের ভাষার অধিকার রক্ষিত হবে, তেমনি সংবিধানের ভাষাকেও হতে হবে দ্বিধাদ্বন্দ্বমুক্ত, স্বচ্ছ, সরল ও স্পষ্ট। আমাদের সংবিধানে প্রথমত সব জাতির সব ভাষার অধিকার স্বীকৃত হয়নি। দ্বিতীয়ত ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এর ভাষায় রয়েছে কিছু অসংগতি, যা দূর করার কাজটি মোটেই দুরূহ নয়। প্রয়োজন ছিল ভাষা ও অর্থতত্ত্বের বিশ্লেষণ। আমাদের সংবিধানের এত বছর পার হলেও তা হয়নি। এর ফলে সত্য-সত্যায়িত অর্থতত্ত্বের (Truth Conditional Semantics) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সমস্যা দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রেই। এমনকি আইনের ক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগের যে সচেতনতা থাকা দরকার ছিল, সে চেষ্টা আমরা লক্ষ করিনি এযাবত্কালে। একটি বিশেষ কমিটি করে তাদের দায়িত্ব দিলে এ কাজটি অনায়াসে করা সম্ভব। সেই সঙ্গে সম্ভব নতুন সংশোধনী এনে এটা বাস্তবায়ন করা। অন্তত ভাষার স্বার্থের প্রশ্নে এ দেশে বিরোধিতা করার মানুষ পাওয়া কঠিন হবে।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.