চিরকুট-ফাঁসি অতঃপর by শাহাদুজ্জামান
ব্রিটেনে তখন সন্ধ্যা। একটা ফোন পাই বাংলাদেশ থেকে। ঘড়ি দেখে বুঝি, বাংলাদেশে তখন গভীর রাত। দেশ থেকে এত রাতের ফোন পেয়ে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। ঢাকা থেকে ফোন করেছেন আমার এক অগ্রজ। বললেন, ‘খোঁজ পেয়েছ? ফাঁসি তো হয়ে গেল।’ আজকাল ব্রিটেনে বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল দেখা যায়, ফলে খোঁজ পাচ্ছিলাম।
সেই অগ্রজ বলেন, ‘খুব হালকা লাগছে। আজ রাতে আর ঘুমাব না, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।’ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি দেওয়াতে নির্ভার বোধ করেছেন বলে সেদিন ঢাকার রাস্তায় জনৈক মানুষ সারা রাত নির্ঘুম হেঁটেছেন। এই মানুষটিকে আমি চিনি। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। একজন সাধারণ মানুষ, যিনি দেশের ভালোমন্দ নিয়ে নিরন্তর ভাবেন। এই ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় তাঁর জীবন কিছু বদলে যায়নি। রাজনৈতিক কর্মী নন বলে একে দলীয় বিজয় ভেবে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার কোনো কারণও তাঁর নেই। তবু তাঁর বুকের ওপর অনেক দিন ধরে চেপে থাকা একটা পাথর যেন সরে গেছে। আমি জানি, সেই রাতে বাংলাদেশে তাঁর মতো আরও বহু মানুষ নির্ভার বোধ করেছেন। আমাদের স্মরণ রাখা ভালো যে কেবল দালানকোঠা, কলকারখানা বানিয়ে একটি দেশ এগিয়ে যায় না, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশবাসীর বুকের ওপর চেপে থাকা পাথরও সরাতে হয়।
জানলাম, ফাঁসির মঞ্চে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেজর ফারুককে। দেওয়ান ইশরাতুল্লাহ সৈয়দ ফারুক আহমেদ, যিনি বাংলা লিখতে জানেন না, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে যিনি রহস্যময় কারণে আবুধাবি থেকে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, নিজের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আর্মি ব্যান্ডের সংগীতের মূর্ছনা, পোলাও আর রেজালার সুবাসের ভেতর ভায়রা মেজর আবদুর রশীদের সঙ্গে বসে যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঘটনাটি তাঁরা পনেরো তারিখেই ঘটাবেন। তাঁর ভায়রা আবদুর রশীদ একটি বেবিট্যাক্সির লাইসেন্স নেওয়ার অছিলায় আগামসি লেনে গিয়ে ইতিমধ্যেই পাকা কথা সেরে এসেছিলেন তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। তারপর গভীর রাতে নির্মাণাধীন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের রানওয়ের অন্ধকারে অতিকায় পোকার মতো ছড়িয়ে থাকা ধাতব ট্যাংকগুলোর আশপাশে কালো পোশাকে ছোটাছুটি করেছিলেন তিনি, হত্যার দায়িত্ব বণ্টন করেছিলেন সতীর্থদের মধ্যে। সব রক্ত ঝরে যাওয়ার পর বত্রিশ নম্বর স্তব্ধ হয়ে গেলে সঙ্গীদের পুরস্কৃত করার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। কারও কাঁধে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেনের পদক, কারও বা মেজরের। এ দেশের ইতিহাসকে দুমড়ে দেওয়ার বদলে বিলাচ্ছিলেন কয়েকটি পিতলের পাত। তারপর তাঁর সীমাহীন ব্যস্ততা। সেই খুদে মেজর রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ লিমুজিন গাড়িটি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বঙ্গভবনে, গলায় বাহারি রুমাল জড়িয়ে চোস্ত ইংরাজিতে বিদেশি টিভি চ্যানেলে সদর্পে কৃতিত্ব নিয়েছেন হত্যাকাণ্ডের।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় নীরব ছিলেন ফারুক। জানার উপায় নেই, সে সময় তাঁর মনে পড়ছিল কি না সেই সব ঔদ্ধত্য আর উল্লাসের দিনগুলো। যে বিচারপতি তাঁদের ফাঁসি দিয়েছেন, তিনি বলছিলেন, জীবনে আরও অনেক ফাঁসির আদেশ দিলেও সেই আদেশ শুনে এই আসামিদের মতো এত দুর্বল হতে তিনি দেখেননি কাউকে। সাজাপ্রাপ্ত এই মেজর নিজেকে ভেবেছিলেন ঘটনার নায়ক। ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’। অথচ তিনি এবং তাঁর ঘাতক দলের সঙ্গী-সাথিরা বিবিধ ব্যক্তিগত ক্ষোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর মূর্খতা নিয়ে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহায়তা করছিলেন মাত্র।
পৃথিবীর প্রধান সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেসবের কোনোটিই কোনো তাত্ক্ষণিক ঘটনা নয়, সব কটিই দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ (ফেইন এবং ভসেকুইল, ১৯৯৯, জার্নাল অব ফরেনসিক সায়েন্স)। বিশেষ করে, সত্তর দশক অবধি তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে অনিবার্যভাবে ছিল রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের কোনো গোপন যোগসূত্র। এ ক্ষেত্রে প্যাট্রিস লুলুম্বা, সালভাদর আয়েন্দে হত্যকাণ্ডের মতো এমনি বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। সত্তর দশকের বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম ঘটনা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুপুঙ্খ কোনো গবেষণা এখনো হয়নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারানহাস ও লরেন্স লিফশুলত্স—এই দুই বিদেশি এ ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়েছেন। ম্যাসকারানহাসের বইটির ব্যাপারে অতিরঞ্জনের অভিযোগ আছে, তুলনায় লিফশুলত্স যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার যোগসূত্রটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন লিফশুলত্স। অসামরিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের একটি অর্থনীতির অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে বাংলাদেশের ইতিহাসের একেবারে সূচনালগ্নে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এই রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে এ দেশের ইতিহাসের গতিটি পুরোপুরি পাল্টে ফেলার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাতটি হানা হয়েছিল পঁচাত্তরের আগস্টে। বলা বাহুল্য, সেই মূল পরিকল্পনার সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে, সংগত কারণে তাঁদেরই কেবল এ ঘটনার নিষ্পত্তির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে এবং তাঁরাই এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছেন। কিন্তু এ ঘটনার পুরো নিষ্পত্তির জন্য এর প্রক্রিয়া, স্তর ও পাত্র-পাত্রীদের রোমহর্ষক গতিপথটির পুঙ্খানুপুঙ্খ উদঘাটন প্রয়োজন। পুরো ঘটনার ব্যাকরণ না জানলে আবারও আঘাত হানার জন্য ঝোপের আড়ালে কে কোথায় ওত পেতে বসে আছে, তা থেকে যাবে অজানা।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক
জানলাম, ফাঁসির মঞ্চে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেজর ফারুককে। দেওয়ান ইশরাতুল্লাহ সৈয়দ ফারুক আহমেদ, যিনি বাংলা লিখতে জানেন না, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে যিনি রহস্যময় কারণে আবুধাবি থেকে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, নিজের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আর্মি ব্যান্ডের সংগীতের মূর্ছনা, পোলাও আর রেজালার সুবাসের ভেতর ভায়রা মেজর আবদুর রশীদের সঙ্গে বসে যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঘটনাটি তাঁরা পনেরো তারিখেই ঘটাবেন। তাঁর ভায়রা আবদুর রশীদ একটি বেবিট্যাক্সির লাইসেন্স নেওয়ার অছিলায় আগামসি লেনে গিয়ে ইতিমধ্যেই পাকা কথা সেরে এসেছিলেন তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। তারপর গভীর রাতে নির্মাণাধীন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের রানওয়ের অন্ধকারে অতিকায় পোকার মতো ছড়িয়ে থাকা ধাতব ট্যাংকগুলোর আশপাশে কালো পোশাকে ছোটাছুটি করেছিলেন তিনি, হত্যার দায়িত্ব বণ্টন করেছিলেন সতীর্থদের মধ্যে। সব রক্ত ঝরে যাওয়ার পর বত্রিশ নম্বর স্তব্ধ হয়ে গেলে সঙ্গীদের পুরস্কৃত করার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। কারও কাঁধে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেনের পদক, কারও বা মেজরের। এ দেশের ইতিহাসকে দুমড়ে দেওয়ার বদলে বিলাচ্ছিলেন কয়েকটি পিতলের পাত। তারপর তাঁর সীমাহীন ব্যস্ততা। সেই খুদে মেজর রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ লিমুজিন গাড়িটি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বঙ্গভবনে, গলায় বাহারি রুমাল জড়িয়ে চোস্ত ইংরাজিতে বিদেশি টিভি চ্যানেলে সদর্পে কৃতিত্ব নিয়েছেন হত্যাকাণ্ডের।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় নীরব ছিলেন ফারুক। জানার উপায় নেই, সে সময় তাঁর মনে পড়ছিল কি না সেই সব ঔদ্ধত্য আর উল্লাসের দিনগুলো। যে বিচারপতি তাঁদের ফাঁসি দিয়েছেন, তিনি বলছিলেন, জীবনে আরও অনেক ফাঁসির আদেশ দিলেও সেই আদেশ শুনে এই আসামিদের মতো এত দুর্বল হতে তিনি দেখেননি কাউকে। সাজাপ্রাপ্ত এই মেজর নিজেকে ভেবেছিলেন ঘটনার নায়ক। ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’। অথচ তিনি এবং তাঁর ঘাতক দলের সঙ্গী-সাথিরা বিবিধ ব্যক্তিগত ক্ষোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর মূর্খতা নিয়ে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহায়তা করছিলেন মাত্র।
পৃথিবীর প্রধান সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেসবের কোনোটিই কোনো তাত্ক্ষণিক ঘটনা নয়, সব কটিই দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ (ফেইন এবং ভসেকুইল, ১৯৯৯, জার্নাল অব ফরেনসিক সায়েন্স)। বিশেষ করে, সত্তর দশক অবধি তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে অনিবার্যভাবে ছিল রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের কোনো গোপন যোগসূত্র। এ ক্ষেত্রে প্যাট্রিস লুলুম্বা, সালভাদর আয়েন্দে হত্যকাণ্ডের মতো এমনি বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। সত্তর দশকের বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম ঘটনা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুপুঙ্খ কোনো গবেষণা এখনো হয়নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারানহাস ও লরেন্স লিফশুলত্স—এই দুই বিদেশি এ ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়েছেন। ম্যাসকারানহাসের বইটির ব্যাপারে অতিরঞ্জনের অভিযোগ আছে, তুলনায় লিফশুলত্স যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার যোগসূত্রটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন লিফশুলত্স। অসামরিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের একটি অর্থনীতির অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে বাংলাদেশের ইতিহাসের একেবারে সূচনালগ্নে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এই রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে এ দেশের ইতিহাসের গতিটি পুরোপুরি পাল্টে ফেলার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাতটি হানা হয়েছিল পঁচাত্তরের আগস্টে। বলা বাহুল্য, সেই মূল পরিকল্পনার সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে, সংগত কারণে তাঁদেরই কেবল এ ঘটনার নিষ্পত্তির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে এবং তাঁরাই এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছেন। কিন্তু এ ঘটনার পুরো নিষ্পত্তির জন্য এর প্রক্রিয়া, স্তর ও পাত্র-পাত্রীদের রোমহর্ষক গতিপথটির পুঙ্খানুপুঙ্খ উদঘাটন প্রয়োজন। পুরো ঘটনার ব্যাকরণ না জানলে আবারও আঘাত হানার জন্য ঝোপের আড়ালে কে কোথায় ওত পেতে বসে আছে, তা থেকে যাবে অজানা।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক
No comments