ধর্ম-ইসলামে ভাষাশহীদদের মর্যাদা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সহজাত যে আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ; ইসলাম একে বিশেষভাবে উত্সাহিত করেছে। এ জন্যই মাতৃভূমি, মায়ের ভাষা কিংবা স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ইসলামি প্রেরণার অন্যতম বিষয়। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার শুধু জন্মগত নয় বরং মাতৃভাষা মহান সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত ও নিজস্ব মৌলিক অধিকার।

এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আল্লাহতাআলা কাউকে দেননি। ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মেধা বিকাশের সব পরিচয় তার নিজস্ব ভাষা বা মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। নিত্যদিনের মনের আবেগ-উচ্ছ্বাস, কামনা-বাসনা, আকুতি-মিনতি—সবই তার নিজের ভাষায়ই প্রস্ফুটিত হয়, অন্য কোনো ভাষায় নয়। ফলে সে তার নিজস্ব ভাষা বা মাতৃভাষা কোনো প্ররোচনায় বা কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ত্যাগ করতে কখনো বাধ্য নয়। যদি কোনো কারণে তার মুখের ভাষা প্রকাশ করতে প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়, তবে সে জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও তা প্রতিহত করতে বাধ্য হয়। এ জন্য মাতৃভাষার উত্কর্ষ সাধনে ইসলাম যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ৩-৪)
দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোত্সর্গের ঘটনা জানা থাকলেও, কোনো জাতি তার মাতৃভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছে—এমন নজির জগতের ইতিহাসে আর নেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে গিয়ে বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত বাংলাবিরোধীদের উপহার দিয়ে ভাষার স্ব্বাধীনতা এনেছিল। জাগতিক উত্কর্ষ ও নানাবিধ লোভ-মোহের প্রতি কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে বাঙালি জাতি মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণোত্সর্গ করেছিল। সেদিন ঢাকার পিচঢালা রাজপথ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিলেন শহীদি চেতনায় উজ্জীবিত রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও শফিউরের মতো নাম না জানা আরও অনেক মহান ভাষাসৈনিক। ভাষার জন্য আন্দোলন করে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তাঁরা মাতৃভাষা বাংলার নাম সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে রক্তিম অক্ষরে লিখে গেলেন। রক্তের বন্যায় সেদিন ভাষার বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের অমর ভাষাসৈনিকেরা। এই মহান বিজয় আত্মত্যাগের, শৌর্য-বীর্য ও গৌরবের। ভাষার লড়াইয়ে তাঁদের আত্মোত্সর্গ আজ জগত্বাসীর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন। সেই সব ভাষা শহীদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে পৃথিবীতে বেঁচে আছে। যে বাংলাভাষার মাধ্যমে দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, সেই ভাষার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণার্থে যাঁরা অকাতরে প্রাণ দিলেন, তাঁদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা যায়, ‘আর আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পার না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৪)
মাতৃভাষা বাংলাভাষা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সেরা দান। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একমাত্র স্বাধীন দেশ, যে দেশের দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। মাতৃভাষার এই মহান আন্দোলন ও আত্মত্যাগকে ইসলাম যথাযথ মর্যাদার দৃষ্টিতে বিবেচনা করে। তাঁদের আত্মদান দেশবাসীর জন্য চিরস্থায়ী এবং বাঙালি জাতি তাঁদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। এহেন সত্কর্ম তাঁদের নিয়ে যাবে জান্নাতুল ফেরদাউসে। শহীদদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহতাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘যারা বিশ্বাস করে ও সত্কর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান। সেখানে ওরা স্থায়ী হবে, এর পরিবর্তে অন্য স্থান চাইবে না।’ (সুরা আল-কাহ্ফ, আয়াত-১০৭) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শহীদদের রুহগুলো সবুজ পাখির গড়নের মধ্যে জান্নাতে ভ্রমণ করে থাকে এবং সেখানকার ফল ও নিয়ামতসমূহ আহার করে থাকে।’
ইসলাম স্বদেশ ও জাতির প্রতি আত্মিক প্রেরণা ও ভালোবাসাকে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। দেশপ্রেম একটি বহুমাত্রিক অনুভূতির দর্পণ। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি যার অন্তরে ভালোবাসা বিদ্যমান, দেশের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা ও মঙ্গল সাধন তার করণীয় হতে বাধ্য। আজ বাংলাভাষাকে রক্ষা করার জন্য সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকের মতো বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন নেই; শুধু প্রয়োজন মমতা দিয়ে গ্রহণ করার এবং শুদ্ধভাবে তা প্রয়োগ করার। এই মহত্ কর্মের সুফল আমরা যাঁদের জীবনের বিনিময়ে পেয়েছি, তাঁরা হলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আত্মত্যাগী, জীবনদানকারী, মাতৃভাষার অধিকার রক্ষাকারী মহান ব্যক্তিবর্গ ও অমর ভাষাসৈনিকগণ। তাঁদের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে সারা পৃথিবীতে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত এবং বিশ্বসভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বাংলাভাষা উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত। বিশাল গৌরবময় আসনে সমাসীন মাতৃভাষা বাংলা এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত বাঙালি জাতি। জগতে বহু ভাষা প্রচলিত আছে; তন্মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। পৃথিবীর বহু দেশে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার চলছে।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মাহূতি দেওয়া আমাদের সূর্যসন্তানদের জন্য এই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত, পরিচিত ও সম্মানিত। তাই মাতৃভাষার জন্য ত্যাগী শহীদ সন্তানদের মতো আরও নিবেদিতপ্রাণ সংগ্রামীর জন্ম হোক বিশ্বের দিকে দিকে। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমরণ সংগ্রামের আদর্শে এগিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথ হোক আমাদের পাথেয়। মহান ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা চর্চায় বাঙালি জাতিকে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে ধর্ম-বর্ণ ও দল-মতনির্বিশেষে সব শ্রেণীর লোকের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও দেশপ্রেমের চেতনায় ভাষাশহীদসহ সবার অশেষ অবদানকে সম্মান জানানো একজন মুমিন মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এটা তাঁর ঈমানের অপরিহার্য দাবি। মাতৃভাষা রক্ষায় দেশপ্রেমের আহ্বানে সাড়া দিতে তাই আমাদের প্রত্যেকেরই সদা প্রস্তুত থাকা বাঞ্ছনীয়।
মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.