চারদিক-ভাষাশহীদ রফিকের কথা by দীপংকর চন্দ
রাতের রহস্যময়তায় আঘাত পড়ল হঠাৎ। প্রজাপতির ডানার মতো নরম ভোর নেমে এল চরাচরে। সদ্য ভাঙা ঘুমের রেশ কাটিয়ে সূর্যটা উঠে এল আকাশে। উপস্থাপনার নান্দনিক নৈপুণ্য প্রকাশে ব্যস্ত নতুন একটি দিন দেখতে দেখতে গাবতলী থেকে বাসে চেপে বসলাম আমরা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে একটু এগিয়ে গেলেই হেমায়েতপুর।
সেখানে পৌঁছেই বাঁ দিকে বাঁক নিল বাসটা, তারপর অতি দ্রুত অতিক্রম করল ধল্লা বাজার। বসন্তের মৃদু বাতাসে যান্ত্রিক মূর্ছনা ছড়াতে ছড়াতে পেছনে ফেলল জয়মন্টপ, সিঙ্গাইর। এরপর ঋষিবাড়ী। এখানেই নামলাম আমরা। নেমেই রিকশা নিলাম। পিচ ঢালা সরু পথ ধরে চলতে চলতে একসময় পৌঁছালাম আমাদের অন্বিষ্ট পারিল গ্রামে, যেখানে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ভিটেবাড়ি।
আনুমানিক ৩৫ শতাংশ জায়গাবিশিষ্ট ভিটেবাড়িটির একাংশে রয়েছে একটি ছোট্ট পাঠাগার। তারপর একচিলতে ফাঁকা জায়গায় একটি শহীদ মিনার। ক্ষুদ্রাকৃতির সেই শহীদ মিনারের পশ্চিমে একটি পাকা ঘর। উত্তর-দক্ষিণে টানা এই ঘরটির পেছনে আরও একটি দোচালা ঘর নিয়ে ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের পরিবর্তিত-পরিমার্জিত পৈতৃক বাড়ি। কে থাকেন এখন এই বাড়িটিতে—ভাবতে ভাবতে আমরা কড়া নাড়লাম দরজার। অল্প সময় অতিক্রান্ত হলো। ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই খোরশেদ আলম দরজা খুললেন হাসিমুখে। অতিপ্রাথমিক সম্ভাষণের পালা শেষ করে মুখোমুখি বসলাম আমরা এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম রফিক উদ্দিন আহমদের কথা। খোরশেদ আলম আমাদের জানালেন, বড় ভাই রফিক উদ্দিন আহমদ শহীদ হওয়ার বছরখানেক আগে জন্ম তাঁর। সুতরাং বড় ভাই রফিক উদ্দিন সম্পর্কে তিনি যা জানেন, সমস্তই পরোক্ষে জ্ঞাত, অন্তরঙ্গ আত্মীয়স্বজনের মন্থন করা স্মৃতি থেকে সংগৃহীত। খোরশেদ আলমের বর্ণিত তথ্যানুযায়ী, অকৃতদার রফিক উদ্দিন আহমদের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল গ্রামে, ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর।
রফিকের বাবার নাম আবদুল লতিফ। মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। পাঁচ ভাই, দুই বোন তাঁরা। রফিকের বাবা আবদুল লতিফ কলকাতায় ব্যবসা করতেন। পিতার ব্যবসার সুবাদে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান রফিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয় গ্রামের স্কুলে যথাসময়েই। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে হঠাৎ হাত ভেঙে যায় তাঁর। চিকিৎসার জন্য তাঁকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় পিতার কাছে। সঠিক চিকিৎসায় দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন রফিক। তবে সুস্থ হওয়ার পরও বেশ কয়েক বছর তিনি থেকে যান কলকাতায়। সে সময় কলকাতার পূরবী সিনেমা হলের বিপরীতে মিত্র ইনস্টিটিউশনে লেখাপড়া করেন রফিক উদ্দিন। কিন্তু দেশভাগের ডামাডোলে খুব বেশি এগোয় না তাঁর লেখাপড়া। ১৯৪৭ সালে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এসেই ভর্তি হন মানিকগঞ্জ বায়রা স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৪৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ভর্তি হন মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। ১৯৫০ সালে এই কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ঢাকায় চলে আসেন রফিক। রফিকের বাবা আবদুল লতিফ তখন ঢাকায় মুদ্রণব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান হাজি ওসমান গনি রোডে শুরু করেছেন বই বাঁধাইয়ের কারখানা। ঢাকায় এসেই রফিক ভর্তি হলেন জগন্নাথ কলেজে। লেখাপড়ার অবসরে বাবার ব্যবসায় সহযোগিতার পাশাপাশি শুরু করলেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ। ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন তিনি। সংগীতে অনুরাগ, সূচিশিল্পে সহজাত দক্ষতাও ছিল তাঁর। এ ছাড়া সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজে তিনি জড়িত ছিলেন কলকাতায় বসবাসের সময় থেকেই। মানবিক গুণাবলি বিকাশ-উপযোগী এসব ক্রিয়াকলাপে আগ্রহ থেকেই রফিকের মধ্যে সৃষ্টি হলো ঢাকার চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের তাড়না।
১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি। শহরজুড়ে গুজব—রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আজ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জড়ো হবেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। বিষয়টি কি সহজভাবে মেনে নেবে শাসকগোষ্ঠী? মনে হয় না। ভীষণ কিছু একটা ঘটবে নিশ্চিত, ভাবতে ভাবতে ভ্রু কুঁচকে উঠল রফিক উদ্দিনের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের। সংশয়ে, শঙ্কায় তিনি মিছিল-মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করলেন রফিককে। কিন্তু এত বড় একটা আন্দোলন থেকে কি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন রফিক? না। তাই তিনি ভগ্নিপতির অগোচরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপস্থিত হলেন। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন। ফাল্গুনের অপরাহ্নে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হওয়ার পর তিনি অবস্থান নিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায়। পুলিশ লাঠিপেটা করল, নিক্ষেপ করল টিয়ার গ্যাসের শেল, মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য একপর্যায়ে বর্ষণ করা হলো তপ্ত, তিক্ত গুলি। সেই গুলিতে রফিক উদ্দিন আহমদের মাথার খুলি বিচূর্ণ হলো, দেহ থেকে তত্ক্ষণাত্ বিযুক্ত হলো প্রাণও। কিন্তু বাঙালির প্রাণের দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি অর্জিত হলোই শেষাবধি।
আনুমানিক ৩৫ শতাংশ জায়গাবিশিষ্ট ভিটেবাড়িটির একাংশে রয়েছে একটি ছোট্ট পাঠাগার। তারপর একচিলতে ফাঁকা জায়গায় একটি শহীদ মিনার। ক্ষুদ্রাকৃতির সেই শহীদ মিনারের পশ্চিমে একটি পাকা ঘর। উত্তর-দক্ষিণে টানা এই ঘরটির পেছনে আরও একটি দোচালা ঘর নিয়ে ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের পরিবর্তিত-পরিমার্জিত পৈতৃক বাড়ি। কে থাকেন এখন এই বাড়িটিতে—ভাবতে ভাবতে আমরা কড়া নাড়লাম দরজার। অল্প সময় অতিক্রান্ত হলো। ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই খোরশেদ আলম দরজা খুললেন হাসিমুখে। অতিপ্রাথমিক সম্ভাষণের পালা শেষ করে মুখোমুখি বসলাম আমরা এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম রফিক উদ্দিন আহমদের কথা। খোরশেদ আলম আমাদের জানালেন, বড় ভাই রফিক উদ্দিন আহমদ শহীদ হওয়ার বছরখানেক আগে জন্ম তাঁর। সুতরাং বড় ভাই রফিক উদ্দিন সম্পর্কে তিনি যা জানেন, সমস্তই পরোক্ষে জ্ঞাত, অন্তরঙ্গ আত্মীয়স্বজনের মন্থন করা স্মৃতি থেকে সংগৃহীত। খোরশেদ আলমের বর্ণিত তথ্যানুযায়ী, অকৃতদার রফিক উদ্দিন আহমদের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল গ্রামে, ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর।
রফিকের বাবার নাম আবদুল লতিফ। মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। পাঁচ ভাই, দুই বোন তাঁরা। রফিকের বাবা আবদুল লতিফ কলকাতায় ব্যবসা করতেন। পিতার ব্যবসার সুবাদে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান রফিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয় গ্রামের স্কুলে যথাসময়েই। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে হঠাৎ হাত ভেঙে যায় তাঁর। চিকিৎসার জন্য তাঁকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় পিতার কাছে। সঠিক চিকিৎসায় দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন রফিক। তবে সুস্থ হওয়ার পরও বেশ কয়েক বছর তিনি থেকে যান কলকাতায়। সে সময় কলকাতার পূরবী সিনেমা হলের বিপরীতে মিত্র ইনস্টিটিউশনে লেখাপড়া করেন রফিক উদ্দিন। কিন্তু দেশভাগের ডামাডোলে খুব বেশি এগোয় না তাঁর লেখাপড়া। ১৯৪৭ সালে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এসেই ভর্তি হন মানিকগঞ্জ বায়রা স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৪৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ভর্তি হন মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। ১৯৫০ সালে এই কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ঢাকায় চলে আসেন রফিক। রফিকের বাবা আবদুল লতিফ তখন ঢাকায় মুদ্রণব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান হাজি ওসমান গনি রোডে শুরু করেছেন বই বাঁধাইয়ের কারখানা। ঢাকায় এসেই রফিক ভর্তি হলেন জগন্নাথ কলেজে। লেখাপড়ার অবসরে বাবার ব্যবসায় সহযোগিতার পাশাপাশি শুরু করলেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ। ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন তিনি। সংগীতে অনুরাগ, সূচিশিল্পে সহজাত দক্ষতাও ছিল তাঁর। এ ছাড়া সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজে তিনি জড়িত ছিলেন কলকাতায় বসবাসের সময় থেকেই। মানবিক গুণাবলি বিকাশ-উপযোগী এসব ক্রিয়াকলাপে আগ্রহ থেকেই রফিকের মধ্যে সৃষ্টি হলো ঢাকার চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের তাড়না।
১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি। শহরজুড়ে গুজব—রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আজ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জড়ো হবেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। বিষয়টি কি সহজভাবে মেনে নেবে শাসকগোষ্ঠী? মনে হয় না। ভীষণ কিছু একটা ঘটবে নিশ্চিত, ভাবতে ভাবতে ভ্রু কুঁচকে উঠল রফিক উদ্দিনের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের। সংশয়ে, শঙ্কায় তিনি মিছিল-মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করলেন রফিককে। কিন্তু এত বড় একটা আন্দোলন থেকে কি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন রফিক? না। তাই তিনি ভগ্নিপতির অগোচরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপস্থিত হলেন। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন। ফাল্গুনের অপরাহ্নে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হওয়ার পর তিনি অবস্থান নিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায়। পুলিশ লাঠিপেটা করল, নিক্ষেপ করল টিয়ার গ্যাসের শেল, মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য একপর্যায়ে বর্ষণ করা হলো তপ্ত, তিক্ত গুলি। সেই গুলিতে রফিক উদ্দিন আহমদের মাথার খুলি বিচূর্ণ হলো, দেহ থেকে তত্ক্ষণাত্ বিযুক্ত হলো প্রাণও। কিন্তু বাঙালির প্রাণের দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি অর্জিত হলোই শেষাবধি।
No comments