ব্রিটেনে নির্বাচন-লেবারের উত্থান, বাঙালির সাফল্য by ফারুক যোশী
লন্ডনে এর আগে বাঙালি নারী কাউন্সিলর থাকলেও নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে পুরুষ কাউন্সিলরদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা_ তিন-চারজন। এবারে দু'জন নারীসহ কাউন্সিলরদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১২ জনে। তাদের সবাই লেবার পার্টি থেকে গত ৩ মের স্থানীয় নির্বাচন যেন ব্রিটেনের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে এক নতুন বার্তা।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবিতে এমনকি আঁতকে উঠেছে ওই দলটি। হয়তো তাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না_ জনগণ এতই বিমুখ হয়েছে তাদের প্রতি। কনজারভেটিভ-লিবারেল ডেমোক্রেট কোয়ালিশন সরকারের দুটি দলই হারিয়েছে তাদের নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল। কাউন্সিলর হারিয়েছে অনেক আসনে। পার্টির লিডার ডেভিড ক্যামেরনের এমনকি নিজস্ব সংসদীয় এলাকা উইটনি ও চিপিং নর্টনে প্রধানমন্ত্রীর পার্টি নেতৃত্ব হারিয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির একটি পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে একই সময়ে অনুষ্ঠিত রেফারেন্ডাম ভোটেও। তারা চেয়েছিল টাওয়ার হ্যামলেটসের মতো নটিংহাম, কভেন্ট্রি এবং ম্যানচেস্টারে কাউন্সিলরদের দ্বারা নির্বাচিত মেয়রের পরিবর্তে জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র। কিন্তু ওই তিন কাউন্সিলের ভোটাররা তা-ও নাকচ করে দেয়। ব্রিটেনের জনজীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনার প্রয়োজনে ক্যামেরন সরকার প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যয় সংকোচন নীতির নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, সেখানে নির্বাচনের মতো ব্যয়বহুল একটি ব্যাপারের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে এই এলাকার জনগণ। সব মিলিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ব্রিটেনের মানুষ। গণমাধ্যমে বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে কনজারভেটিভের ভরাডুবির কথা। পার্টি এমন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যে, এই পার্টি কিংবা সরকারকে বলা হচ্ছে, তারা 'আউট অব ভোটার'। সহজ কথায়_ জনবিচ্ছিন্ন সরকার।
যদিও কনজারভেটিভ পার্টির এক সময়ের লিডার এবং বর্তমান ফরেন সেক্রেটারি উইলিয়াম হেগ বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে না। উইলিয়াম হেগের এই উক্তি অনেকের কাছেই মনে হয়েছে এক শিশুসুলভ উক্তি। কারণ, এই ভোটাররাই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। তারাই প্রতিনিধি নির্বাচন করে হাউস অব কমন্সে পাঠায়। তিনি যা-ই বলেন না কেন, বর্তমান সরকারের জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কনডেম সরকারকে মূলত একটা বার্তা দিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ, যার প্রতিফলন আগামী নির্বাচনে যে প্রতিবিম্বিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকার তার বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখলে জাতীয় নির্বাচনে যে এই ফলাফল তাদের জন্য আরও ভয়াবহ হয়ে আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উইলিয়াম হেইগ যা-ই বলেন না কেন, পার্টির ভেতরেও যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে, তা স্পষ্ট। এক সময়ের লৌহমানবী বলে খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের সরকারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছেন জেরাল্ড হাওয়ার্থ। তিনি এখন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত। তিনি বলেছেন, সময় এসেছে কনজারভেটিভ পার্টির_ নেতৃত্বকে জনগণের কিছু ব্যাপার অবশ্যই শুনতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, এই সরকার বহু সমালোচিত গে-ম্যারেজ কিংবা পুরুষ-পুরুষ বিবাহকে জায়েজ করেছে, যা তার ভাষায় এমনকি অনেক কনজারভেটিভ সদস্যের পাশাপাশি অসংখ্য ব্রিটিশ জনগণকে আশাহত করেছে। ডেভন সাউথ ওয়েস্টের কনজারভেটিভ দলীয় এমপি গ্যারি স্টিটার মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেনের অসংখ্য ভোটার এই সরকারকে দক্ষ (কম্পিটেন্ট) হিসেবে মনে করে না। তার ভাষায়, গত ক'দিনে তিনি অনেক অনেকবার জনগণের বাড়ি বাড়ি গেছেন এবং জনগণ যে কথাটি বারবার তাকে শুনিয়েছে তাহলো, তারা সরকারের ওপর খুশি নয়। জনগণের প্রত্যাশা ছিল সরকারের বর্তমান চলমান কার্যক্রম থেকে অনেক বেশি। প্লে-মাউথ সিটি কাউন্সিলের লিডার কনজারভেটিভ দলীয় নেত্রী ভেন পেনগেলি সরাসরি তার পার্টি লিডার ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে বলেছেন, তার পরাজয়ের জন্য ক্যামেরনই দায়ী। তার নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ডেভিড ক্যামেরনকে অবশ্যই জনগণের কথা শুনতে হবে। ব্রিটেনের জনগণের মতো তিনিও মনে করেন, মিডিয়া টাইকুন রুপার্ট মারডকের নিউজ করপোরেশনের স্ক্যান্ডালের সঙ্গে সরকারের কালচারাল সেক্রেটারির সংযোগের প্রপাগান্ডা সরকারকে সমালোচিত করেছে। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের দিকে। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি অসহায় মানুষদের আরও অসহায় করে তুলেছে। এভাবেই স্থানীয় নির্বাচনে ব্রিটিশ জনগণের রায়ের পাশাপাশি কনজারভেটিভ দলের ভেতরের মানুষরাও যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। বলতে গেলে, ফুঁসে উঠছে তারা ও সাধারণ মানুষ।
যদিও পার্টি লিডার ও প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে তৃতীয় বিশ্বের দেশের নেতা-নেত্রীদের মতোই বলেছেন, লেবারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি, তাদের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে আমরা পথ চলছি এবং এ থেকে দেশকে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, অতীতের এসব জঞ্জাল সমাধান করা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। তবুও তার পার্টি কিংবা সরকার দেশের সেই মানুষদের পাশে থাকবে, যেসব মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই দেশে।
সঙ্গে সঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটও যেন তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় পেয়েছে এই নির্বাচনে। কোয়ালিশন সরকারের হয়ে কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করার কারণেই যে তাদের এই দশা হয়েছে_ এটা বলতে আর কারও দ্বিধা নেই। লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী তাদের কাউন্সিলর সংখ্যা তিন হাজারের নিচে নেমে গেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পার্টির লিডার এবং ব্রিটেনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী তার দলের এই ধস নামাকে দুঃখজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ম্যানচেস্টারের লিবারেল ডেমোক্রেট দলীয় লিডার দেশব্যাপী তাদের দলের এ পরাজয়কে 'লজ্জা' (এ শেইম) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বলতে গেলে চমকপ্রদ ভালো ফল করেছে জর্জ গ্যালওয়ের রেসপেক্ট পার্টি। মাত্র দু'তিন সপ্তাহ আগে তিনি ব্রাডফোর্ড ওয়েস্ট থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিন সপ্তাহ পর অর্থাৎ সব মিলিয়ে (তার ভাষায় ফাইভ উইকস, ফাইভ সিটস) মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জিতে নিয়েছেন পাঁচটি আসন।
খুব স্বাভাবিক কারণেই এ নির্বাচনে লেবার পার্টি তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে_ এটা বলাই যায়। অন্তত ৮০০টিরও বেশি কাউন্সিলর পদ তারা নতুনভাবে পেয়েছে। নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের এমনকি বাঙালি কমিউনিটিতে এসেছে অসাধারণ সাফল্য। এই রিজিওনের ম্যানচেস্টার, ওল্ডহ্যাম, টেইমসাইড, রচডেল, ব্রাডফোর্ডের কাউন্সিলগুলোর প্রতিটিতেই বলতে গেলে বাঙালি কাউন্সিলরদের সংখ্যা এবারে গিয়ে পেঁৗছেছে একাধিক আসনে। লন্ডনে এর আগে বাঙালি নারী কাউন্সিলর থাকলেও নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে পুরুষ কাউন্সিলরদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা_ তিন-চার জন। এবারে দু'জন নারীসহ কাউন্সিলরদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১২ জনে। তাদের সবাই লেবার পার্টি থেকে। নতুন করে ৩০টিরও অধিক কাউন্সিলে লেবার পার্টি এবার নেতৃত্ব সংযোগ করেছে। বলতে গেলে, এ রকম ফল প্রতা্যাশিতই ছিল।
গণতন্ত্রের ভিত্তি থাকা দেশগুলোই এমন যে, মানুষ সেখানে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে। নির্বাচনগুলোতে নেতা কিংবা প্রার্থীর উপস্থিতির তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়ে না। ভোটাররা দিনের পর দিন সরকারের চলমান কার্যক্রমকেই ভোটের মাধ্যমে জানান দিয়ে যায়। কনজারভেটিভ ক্ষমতায় আসার পর সবদিক থেকেই এক ধরনের 'কাট-আতঙ্ক' (ব্যয় সংকোচন) শুরু হয়। সাধারণ মানুষের বেনিফিট (সুযোগ-সুবিধা) বিশেষত চাইল্ড বেনিফিট, অল্প ঘণ্টা কর্মরত স্বল্প আয়ের মানুষদের ওয়ার্কিং টেক্স ক্রেডিট, পেনশন ভাতার সময়সীমা ৬৫ বছরের জায়গায় ৭০ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া, ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, চাকরিহীনতা, ছাত্রছাত্রীদের ইউনিভার্সিটি পড়ার ফিস বাড়িয়ে দেওয়া, বিশেষত মধ্যবিত্ত মানুষদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এমনকি ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পেট্রোল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে নিয়ে এসেছে অস্বস্তি। আর সেসব কারণেই সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠছিল। এই ফুঁসে ওঠারই ফল গত ৩ মের নির্বাচন। অথচ এসব সমস্যা বিভিন্ন সময় লেবার পার্টি গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেখে এসেছে তাদের নেতৃত্বাধীন সময়ে। সে জন্যই লেবার পার্টির ওপর শেষ ভরসার জায়গা হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে ব্রিটিশ জনগণ এবারের নির্বাচনে।
যদিও কনজারভেটিভ কিংবা লিবারেল ডেমোক্রেট তাদের দলীয় এই হেরে যাওয়াকে দুঃখজনক কিংবা লজ্জা হিসেবে উল্লেখ করেছে; তারপরও তাদের দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন, নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন লেবার দল এক হাজারেরও বেশি আসন স্থানীয় নির্বাচনে হারিয়েও তারা ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। ক্ষমতায় টিকে থাকার কিংবা দলের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার এ এক যুক্তি বটে। ক্ষমতাসীন সবল দলের এই দুর্বল যুক্তি কতটা প্রভাব ফেলে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু এটাই সঠিক, সরকার যেমন ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিবর্তন এনে মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে, ঠিক তেমনি আগামী দু'বছরের মধ্যেও যদি তারা দ্রুত জনমুখী হতে না পারে, অর্থাৎ জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের নিশ্চিত পথ দেখাতে না পারে, তাহলে কোনো যুক্তিই আর আগামীর ক্ষমতায় কনজারভেটিভদের নিয়ে আসতে পারবে না।
ফারুক যোশী :কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com
যদিও কনজারভেটিভ পার্টির এক সময়ের লিডার এবং বর্তমান ফরেন সেক্রেটারি উইলিয়াম হেগ বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে না। উইলিয়াম হেগের এই উক্তি অনেকের কাছেই মনে হয়েছে এক শিশুসুলভ উক্তি। কারণ, এই ভোটাররাই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। তারাই প্রতিনিধি নির্বাচন করে হাউস অব কমন্সে পাঠায়। তিনি যা-ই বলেন না কেন, বর্তমান সরকারের জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কনডেম সরকারকে মূলত একটা বার্তা দিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ, যার প্রতিফলন আগামী নির্বাচনে যে প্রতিবিম্বিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকার তার বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখলে জাতীয় নির্বাচনে যে এই ফলাফল তাদের জন্য আরও ভয়াবহ হয়ে আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উইলিয়াম হেইগ যা-ই বলেন না কেন, পার্টির ভেতরেও যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে, তা স্পষ্ট। এক সময়ের লৌহমানবী বলে খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের সরকারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছেন জেরাল্ড হাওয়ার্থ। তিনি এখন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত। তিনি বলেছেন, সময় এসেছে কনজারভেটিভ পার্টির_ নেতৃত্বকে জনগণের কিছু ব্যাপার অবশ্যই শুনতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, এই সরকার বহু সমালোচিত গে-ম্যারেজ কিংবা পুরুষ-পুরুষ বিবাহকে জায়েজ করেছে, যা তার ভাষায় এমনকি অনেক কনজারভেটিভ সদস্যের পাশাপাশি অসংখ্য ব্রিটিশ জনগণকে আশাহত করেছে। ডেভন সাউথ ওয়েস্টের কনজারভেটিভ দলীয় এমপি গ্যারি স্টিটার মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেনের অসংখ্য ভোটার এই সরকারকে দক্ষ (কম্পিটেন্ট) হিসেবে মনে করে না। তার ভাষায়, গত ক'দিনে তিনি অনেক অনেকবার জনগণের বাড়ি বাড়ি গেছেন এবং জনগণ যে কথাটি বারবার তাকে শুনিয়েছে তাহলো, তারা সরকারের ওপর খুশি নয়। জনগণের প্রত্যাশা ছিল সরকারের বর্তমান চলমান কার্যক্রম থেকে অনেক বেশি। প্লে-মাউথ সিটি কাউন্সিলের লিডার কনজারভেটিভ দলীয় নেত্রী ভেন পেনগেলি সরাসরি তার পার্টি লিডার ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে বলেছেন, তার পরাজয়ের জন্য ক্যামেরনই দায়ী। তার নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ডেভিড ক্যামেরনকে অবশ্যই জনগণের কথা শুনতে হবে। ব্রিটেনের জনগণের মতো তিনিও মনে করেন, মিডিয়া টাইকুন রুপার্ট মারডকের নিউজ করপোরেশনের স্ক্যান্ডালের সঙ্গে সরকারের কালচারাল সেক্রেটারির সংযোগের প্রপাগান্ডা সরকারকে সমালোচিত করেছে। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের দিকে। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি অসহায় মানুষদের আরও অসহায় করে তুলেছে। এভাবেই স্থানীয় নির্বাচনে ব্রিটিশ জনগণের রায়ের পাশাপাশি কনজারভেটিভ দলের ভেতরের মানুষরাও যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। বলতে গেলে, ফুঁসে উঠছে তারা ও সাধারণ মানুষ।
যদিও পার্টি লিডার ও প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে তৃতীয় বিশ্বের দেশের নেতা-নেত্রীদের মতোই বলেছেন, লেবারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি, তাদের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে আমরা পথ চলছি এবং এ থেকে দেশকে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, অতীতের এসব জঞ্জাল সমাধান করা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। তবুও তার পার্টি কিংবা সরকার দেশের সেই মানুষদের পাশে থাকবে, যেসব মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই দেশে।
সঙ্গে সঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটও যেন তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় পেয়েছে এই নির্বাচনে। কোয়ালিশন সরকারের হয়ে কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করার কারণেই যে তাদের এই দশা হয়েছে_ এটা বলতে আর কারও দ্বিধা নেই। লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী তাদের কাউন্সিলর সংখ্যা তিন হাজারের নিচে নেমে গেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পার্টির লিডার এবং ব্রিটেনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী তার দলের এই ধস নামাকে দুঃখজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ম্যানচেস্টারের লিবারেল ডেমোক্রেট দলীয় লিডার দেশব্যাপী তাদের দলের এ পরাজয়কে 'লজ্জা' (এ শেইম) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বলতে গেলে চমকপ্রদ ভালো ফল করেছে জর্জ গ্যালওয়ের রেসপেক্ট পার্টি। মাত্র দু'তিন সপ্তাহ আগে তিনি ব্রাডফোর্ড ওয়েস্ট থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিন সপ্তাহ পর অর্থাৎ সব মিলিয়ে (তার ভাষায় ফাইভ উইকস, ফাইভ সিটস) মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জিতে নিয়েছেন পাঁচটি আসন।
খুব স্বাভাবিক কারণেই এ নির্বাচনে লেবার পার্টি তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে_ এটা বলাই যায়। অন্তত ৮০০টিরও বেশি কাউন্সিলর পদ তারা নতুনভাবে পেয়েছে। নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের এমনকি বাঙালি কমিউনিটিতে এসেছে অসাধারণ সাফল্য। এই রিজিওনের ম্যানচেস্টার, ওল্ডহ্যাম, টেইমসাইড, রচডেল, ব্রাডফোর্ডের কাউন্সিলগুলোর প্রতিটিতেই বলতে গেলে বাঙালি কাউন্সিলরদের সংখ্যা এবারে গিয়ে পেঁৗছেছে একাধিক আসনে। লন্ডনে এর আগে বাঙালি নারী কাউন্সিলর থাকলেও নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে পুরুষ কাউন্সিলরদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা_ তিন-চার জন। এবারে দু'জন নারীসহ কাউন্সিলরদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১২ জনে। তাদের সবাই লেবার পার্টি থেকে। নতুন করে ৩০টিরও অধিক কাউন্সিলে লেবার পার্টি এবার নেতৃত্ব সংযোগ করেছে। বলতে গেলে, এ রকম ফল প্রতা্যাশিতই ছিল।
গণতন্ত্রের ভিত্তি থাকা দেশগুলোই এমন যে, মানুষ সেখানে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে। নির্বাচনগুলোতে নেতা কিংবা প্রার্থীর উপস্থিতির তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়ে না। ভোটাররা দিনের পর দিন সরকারের চলমান কার্যক্রমকেই ভোটের মাধ্যমে জানান দিয়ে যায়। কনজারভেটিভ ক্ষমতায় আসার পর সবদিক থেকেই এক ধরনের 'কাট-আতঙ্ক' (ব্যয় সংকোচন) শুরু হয়। সাধারণ মানুষের বেনিফিট (সুযোগ-সুবিধা) বিশেষত চাইল্ড বেনিফিট, অল্প ঘণ্টা কর্মরত স্বল্প আয়ের মানুষদের ওয়ার্কিং টেক্স ক্রেডিট, পেনশন ভাতার সময়সীমা ৬৫ বছরের জায়গায় ৭০ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া, ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, চাকরিহীনতা, ছাত্রছাত্রীদের ইউনিভার্সিটি পড়ার ফিস বাড়িয়ে দেওয়া, বিশেষত মধ্যবিত্ত মানুষদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এমনকি ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পেট্রোল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে নিয়ে এসেছে অস্বস্তি। আর সেসব কারণেই সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠছিল। এই ফুঁসে ওঠারই ফল গত ৩ মের নির্বাচন। অথচ এসব সমস্যা বিভিন্ন সময় লেবার পার্টি গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেখে এসেছে তাদের নেতৃত্বাধীন সময়ে। সে জন্যই লেবার পার্টির ওপর শেষ ভরসার জায়গা হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে ব্রিটিশ জনগণ এবারের নির্বাচনে।
যদিও কনজারভেটিভ কিংবা লিবারেল ডেমোক্রেট তাদের দলীয় এই হেরে যাওয়াকে দুঃখজনক কিংবা লজ্জা হিসেবে উল্লেখ করেছে; তারপরও তাদের দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন, নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন লেবার দল এক হাজারেরও বেশি আসন স্থানীয় নির্বাচনে হারিয়েও তারা ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। ক্ষমতায় টিকে থাকার কিংবা দলের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার এ এক যুক্তি বটে। ক্ষমতাসীন সবল দলের এই দুর্বল যুক্তি কতটা প্রভাব ফেলে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু এটাই সঠিক, সরকার যেমন ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিবর্তন এনে মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে, ঠিক তেমনি আগামী দু'বছরের মধ্যেও যদি তারা দ্রুত জনমুখী হতে না পারে, অর্থাৎ জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের নিশ্চিত পথ দেখাতে না পারে, তাহলে কোনো যুক্তিই আর আগামীর ক্ষমতায় কনজারভেটিভদের নিয়ে আসতে পারবে না।
ফারুক যোশী :কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com
No comments