প্রসঙ্গ বিএনপি নেতাদের জামিন-বিভক্ত আদেশ, হয়রানি না করার নির্দেশ

হরতালের সময় সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের জামিনের বিষয়ে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে হয়রানি না করার নির্দেশ দেওয়ায় এসব নেতা গ্রেপ্তার হওয়া থেকে আপাতত রক্ষা পাচ্ছেন।


গতকাল সোমবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আদেশ হয়। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বিএনপি ও জোটের নেতাদের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। অপর বিচারপতি এসব নেতাকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এই সময়ের মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করতে বলা হয়।
আদেশের পর বিএনপির নেতাদের আইনজীবী মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দুই বিচারপতি দুই রকম আদেশ দিয়েছেন। এখন প্রধান বিচারপতি বিষয়টি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠাবেন। তৃতীয় বেঞ্চে আদেশ না হওয়া পর্যন্ত সময়ে এসব নেতাকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা যাবে না।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিভক্ত আদেশ হয়েছে। এক বিচারপতি জামিন মঞ্জুর করেছেন। অপর বিচারপতি জামিনপ্রার্থীদের এক সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই সময়ে তাঁদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেন। এটা একধরনের জামিন।
গত ২৯ এপ্রিল হরতালের দিন বিকেলে সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় শাহবাগ থানায় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় তেজগাঁও থানায় পুলিশের করা দুটি মামলায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামি করা হয়। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আসামি হওয়া দলীয় নেতারা ‘আত্মগোপনে’ চলে যান। এরপর ২ মে তাঁদের আগাম জামিন আবেদন গ্রহণে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের এক বিচারপতি বিব্রত বোধ করেন। তারপর ওই দিনই আবেদন দাখিলের জন্য আরেকটি দ্বৈত বেঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওই বেঞ্চ ‘এখতিয়ার নেই’ বলে আবেদন গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন।
একই দিন (২ মে) তেজগাঁও থানার মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন হাইকোর্টে হাজির হয়ে আগাম জামিন চাইলে অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চে বিভক্ত আদেশ হয়। পরদিন তৃতীয় বেঞ্চে তিনি জামিন পান।
এদিকে ‘আত্মগোপনের’ এক সপ্তাহ পর গতকাল বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আ স ম হান্নান শাহ, সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, ফজলুল হক, সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সৈয়দা আসিফা আশরাফি, শাম্মী আক্তার, রেহানা আক্তার ও নিলোফার চৌধুরী, যুবদলের মোয়াজ্জেম হোসেন ও সাইফুল আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের হাবিব-উন-নবী খান, ছাত্রদলের সুলতান সালাউদ্দিন, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমানসহ আসামি হওয়া অন্য নেতারা হাইকোর্টে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। আদালত ফটক থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁদের কেউ কেউ আগের রাতেই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে ঢুকে পড়েন ও রাত কাটান বলে প্রচার আছে।
শুনানি ও এজলাসকক্ষ: গতকাল সকালে হাইকোর্টে বিএনপির নেতাদের জামিন আবেদন শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন আইনজীবী মওদুদ আহমদ। কতজনের জামিন আবেদন করা হয়েছে, তা জানতে চান আদালত।
জবাবে মওদুদ বলেন, এক মামলায় ৪৪ জন, অন্য মামলায় ২৮ জন। সবাই জামিন চান। কেউ কেউ এসেছেন। কেউ কেউ আসতে পারছেন না। তিনি বলেন, জামিনপ্রার্থীদের আদালতে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আদালত অনুমতি দিলে তাঁরা আসবেন।
এ সময় আদালত বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের আদালতে এসে জামিন চাওয়ার অধিকার রয়েছে। একপর্যায়ে আদালত উপস্থিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. খুরশীদুল আলমকে ডাকেন এবং জামিনপ্রার্থীদের নির্বিঘ্নে আদালতে আসার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বেলা দুইটায় জামিন আবেদনের ওপর শুনানির সময় নির্ধারণ করেন।
বেলা দুইটার আগেই এজলাসকক্ষে জামিন আবেদনকারী নেতারা ও তাঁদের আইনজীবীরা আসতে থাকেন। একপর্যায়ে এজলাসকক্ষ ভরে যায়। কক্ষের বাইরেও ছিল ভিড়। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ পরিস্থিতিতে শুনানি করা সম্ভব নয়। তখন আদালত মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের আদালতকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।
জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হক ও মওদুদ আহমদ। তাঁদের সহযোগিতা করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, মাহবুবউদ্দিন ও এম বদরুদ্দোজা বাদল। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম মিয়া, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রাজ্জাকসহ শতাধিক আইনজীবী এজলাসকক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে মওদুদ আহমদ এজাহার পাঠ করে বলেন, হরতাল শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টায়। আর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে রাত নয়টা পাঁচ মিনিটে। হরতাল শেষ হওয়ার পর কেন আবেদনকারীরা অগ্নিসংযোগ করতে যাবেন? তিনি বলেন, জামিন আবেদনকারীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। তাই রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্যই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসে করে এসে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। কিন্তু ওই সব মাইক্রোবাসের নম্বর উল্লেখ নেই।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, এজাহারের আসামির কলামে তাঁদের নাম নেই। তবে অভিযোগের বর্ণনার মধ্যে তাঁদের নাম রয়েছে। তাঁদের জামিন না দিয়ে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দিতে পারেন। জামিন আবেদনেই নিম্ন আদালতের প্রতি আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে।
মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমাদের গ্রেপ্তার করার জন্য এ মামলা করা হয়েছে। নিম্ন আদালতে কেন যাব।’ তিনি এ সময় বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভীর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, নিম্ন আদালতে রিজভীর জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু জামিন দেওয়া হয়নি।
পরে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। অপর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার পৃথকভাবে আদেশ দেওয়া শুরু করলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘গত সাত দিন কী হয়েছে তা আপনারা হয়তো জানেন। এ মামলা নিয়ে দেশে কী পরিস্থিতি হয়েছে, তা বিবেচনা করতে হবে। ইদানীং হাইকোর্টে দ্বিধাবিভক্ত আদেশের রেওয়াজ শুরু হয়েছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের মনে খারাপ সংকেত যাচ্ছে। তাই আদালত অন্য কোনো আদেশ দিলে আবেদনকারীরা আদালত থেকে বের হলেই গ্রেপ্তার হতে পারেন। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে। আমাকে বিপদে ফেলবেন না।’ এই পর্যায়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আমি কী আদেশ দিচ্ছি, তা আগে দেখুন।’ তিনি আবেদনকারীদের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন।
এরপর একই বেঞ্চে শাহবাগ থানায় করা মামলায় নেতাদের জামিন আবেদনের ওপর পৃথক শুনানি হয়। এই মামলায়ও একই রকম বিভক্ত আদেশ হয়।
ফখরুলসহ নেতাদের প্রবেশ: গতকাল সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের ফটকসহ আশপাশে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রবেশপথগুলোতে আগত ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হয়। তবে সকাল নয়টা থেকেই জামিনপ্রার্থী বিএনপির নেতারা একে একে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে জড়ো হতে থাকেন। সেখানে তাঁরা দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এ ছাড়া অসংখ্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকের পদচারণে মুখরিত ছিল আদালত পাড়া।
বেলা পৌনে একটার দিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন মির্জা ফখরুলসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের সঙ্গে ১৮ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতাও ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের ওই ফটকে ব্যাপক র‌্যাব-পুলিশ উপস্থিতির মধ্যে চার-পাঁচটি গাড়িবহরে করে তাঁরা আদালত অঙ্গনে প্রবেশ করেন। এর আগে সোয়া ১২টার দিকে মওদুদ আহমদ, জয়নুল আবেদীন, শাহজাহান ওমরসহ বিএনপির আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকে পৌঁছান। ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা ফটকের লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান।
এর আগে ১২টা ২০ মিনিটের দিকে মওদুদ আহমদ পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন যেন আবেদনকারীদের নির্বিঘ্নে ঢুকতে দেওয়া হয়। তখন পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ আমাদের হাতে নেই।’ জবাবে আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন পুলিশকে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।
এরপর পুলিশ কর্মকর্তারা মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। এরই মধ্যে কয়েকটি আকস্মিকভাবে গাড়িবহরে করে মির্জা ফখরুল, খন্দকার মোশাররফ, হান্নান শাহ, সাদেক হোসেন খোকাসহ কয়েকজন ঢুকে পড়েন। এর আগে বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান হেঁটে ঢুকতে গেলে পেছন দিক থেকে পুলিশ তাঁকে ধরার চেষ্টা করে। তখন আইনজীবীরা বাধা দেন এবং আন্দালিব রহমান ঢুকে পড়েন।

No comments

Powered by Blogger.