ফল বিশ্লেষণ-এত ভালোর যত কারণ by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় চারটি বিষয়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। আর এ কারণেই সার্বিক ফলাফলে পাসের হার বেড়েছে। এই চারটি বিষয় হচ্ছে- ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কঠিন এই চারটি বিষয়ই পাস-ফেলের হার নির্ধারণ করে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির কারণে ফল ভালো হয়েছে। প্রথম বছরের দুই বিষয়, দ্বিতীয় বছরে সাত বিষয় এবং এবার ২১টি বিষয়ে এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রথমে অনীহা থাকলেও এখন এর প্রসারতা লাভ করেছে। এ ছাড়া নোট-গাইড বই বন্ধ করে বোর্ডের বই বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ায় লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৯৩.০১ শতাংশ, গণিতে ৯২.৭৫, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৪৭ এবং রসায়নে ৯৮.৯৬ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫.৪৬, গণিতে ৯৩.১৬, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৩০ এবং রসায়নে ৯৮.২৩ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬.০৮, গণিতে ৯৩.৮, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৯৭ এবং রসায়নে ৯৮.৮১ শতাংশ। যশোর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫.৭৮, গণিতে ৯২.০৭, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৫৬ এবং রসায়নে ৯৮.৯০ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪.৫, গণিতে ৮৭.০৮, পদার্থবিজ্ঞানে ৯২.৮৭ এবং রসায়নে ৯৪.৮৫ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪.৭৩, গণিতে ৯৪.৮২, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৩১ এবং রসায়নে ৯৭.৭৪ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯১.৩৬, গণিতে ৯১.১৯, পদার্থবিজ্ঞানে ৯১.৪৮ এবং রসায়নে ৯১.৫৪ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬.২৪, গণিতে ৯০.৫৪, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.০৭ এবং রসায়নে ৯৮.৭৭ শতাংশ। মাদ্রাসা বোর্ডে ইংরেজিতে ৯৭.৯৬, গণিতে ৯৭.৩৭, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৯.৪৮, রসায়নে পাস করেছে ৯৭.১১ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ইংরেজিতে ৯৭.৬৬, গণিতে ৯১.০৪, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৩.০৪ ও রসায়নে পাস করেছে ৯৫.৯১ শতাংশ।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতাকে আয়ত্ত করার কারণে এর জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ২১টি বিষয়ের পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে হওয়ায় পাসের হার বেড়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিভীতি কাটিয়ে ওঠায় ফল ভালো হয়েছে। ফল খারাপ হলে শিক্ষকদের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে- এ আশঙ্কা থেকে শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী হয়েছেন। পাশাপাশি নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হলে চূড়ান্ত পরীক্ষার অনুমতি না দেওয়ার নিয়মের কারণেও পাসের হার বেড়েছে। ১১ বছর আগে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল সারা দেশে মাত্র ৭৬ জন; এ বছর পেয়েছে ৮২ হাজার ২১২ জন।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলছেন, ব্যাপক মোটিভেশন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির ফসল এটা। তাঁরা জানান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও গণিতে দুর্বলতা দূরীকরণ, সৃজনশীল বিষয়কে আন্তরিকতার সঙ্গে নেওয়ার কারণে ভালো ফল করেছে শিক্ষার্থীরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আরো ভালো ফল করবে তারা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান-উর-রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা এবার ইংরেজি ও গণিতে ভালো করার কারণেই সার্বিক ফল ভালো হয়েছে। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে আতঙ্ক ছিল। কিন্তু ফল দেখে মনে হয়েছে, এ আতঙ্কও কেটে গেছে। সব মিলিয়ে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আনতে পেরেছি।'
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন কালের কণ্ঠকে জানান, শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে, যার প্রমাণ এ ফল। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কড়া নজরদারি, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণ এ ফল তৈরিতে সাহায্য করেছে। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার সব সূচকে যখন পরিবর্তন ঘটে, তখন মান কমে না। এ ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতিও শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করেছে। ফলে পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। ফাহিমা খাতুন বলেন, এবারের ফলাফলে সৃজনশীল পদ্ধতি বেশি নম্বর পেতে সহায়তা করেছে। পরীক্ষার উত্তরপত্র নেওয়ার সময় পরীক্ষকদের বলা হয়েছিল, মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষা করতে। কারণ গ্রামের স্কুলের উত্তরপত্র আর শহরের স্কুলের উত্তরপত্র এক হবে না। তিনি বলেন, আগের তুলনায় এখন পড়ালেখার গুরুত্ব বেড়েছে। গ্রামগঞ্জের অভিভাবকরাও এখন সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে সচেতন। আগে বিজ্ঞানে ফল খারাপ হতো বলে সার্বিকভাবে পরীক্ষার ফল খারাপ হতো। কিন্তু এবার বিজ্ঞান বিভাগেই বেশি ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মান বাড়ানো হয়েছে।
আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গ্রুপভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৪.৪৮, মানবিকে ৮১.২৬ এবং বাণিজ্য বিভাগে ৮৭.৩৯ শতাংশ।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, 'চার হাজার ৮০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ায় পাসের হার বেড়েছে। তাই ভালো ফল হয়েছে। তবে মানবিকে তুলনামূলক কম পাসের কারণ খতিয়ে দেখা হবে।'
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সৃজনশীলে পাস করা সহজ। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে যেমন সৃজনশীলতা থাকে, তেমনি নম্বর দিতেও সৃজনশীলতা দেখানো হয়। তিনি বলেন, এবার হাওরাঞ্চলে পাসের হার ৮৫ শতাংশ। সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটে সর্বোচ্চ পাসের হারের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বিদেশ গেলেও পড়াশোনা করে যাও। এতে কাজ হয়েছে। সিলেটের শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়া কমেছে। ফলে সিলেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা ছিল সেটি কেটে যাচ্ছে। তাই ফলও ভালো হয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়নি। তবু এ দুই বিষয়ে পাস করেছে ৯০ শতাংশের ওপরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এত পাস করার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার্থীদের যে অবস্থা, তাতে কোনোভাবেই এসএসসিতে ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে উঠতে পারে না। এই ফল শিক্ষার্থীরা সত্যি সত্যি মেধার জোরে পেয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, 'যদি মেধার জোরে পায়, তাহলে আমি খুব খুশি হব।' এ ছাড়া কোচিং-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কারণেও এত পাস হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। তাঁর মতে, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকরা মোটামুটি বলে দিতে পারেন, কোন বছর কোন প্রশ্ন 'কমন' পড়বে। প্রশ্ন 'কমন' হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উত্তর লিখতে পেরেছে। এরাই দুই বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে দেখা যাবে ইংরেজিতে তাদের মান অনেক কম। তিনি বলেন, ইংরেজিতে পাসের হার এত হলেও শিক্ষার মান বাড়েনি। মুখস্থ বিদ্যার প্রভাব বেড়েছে। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে যদি মেধার কারণে এই ফল হয় তাহলে প্রশ্ন নেই। আর যদি পদ্ধতিগত কারণে এই ফল হয় তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে।
বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলেছেন, প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রে নেওয়ার কারণে এসএসসিতে প্রশ্নপত্র কেমন হয়, তার ধারণা পেয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এসএসসি পরীক্ষার আগে স্কুলে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষায়ই শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিতে প্রশ্ন কেমন হবে, তার ধারণা পেয়ে যায়। এতে মূল পরীক্ষায় তাদের ভয় থাকে না। তবে একটি সূত্র বলেছে, এবারে খাতা দেখায় কিছুটা উদারনীতি অবলম্বন করা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত ছয় বিষয়ের পরীক্ষার খাতা দেখাতেও ছিল বাড়তি উদারতা।
দেবাশীষ পাল নামের এক অভিভাবক কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিভাবকরাও এখন আগের চেয়ে সচেতন। তাঁরা সন্তানের প্রতি খুবই মনোযোগী। ফলে শিক্ষার্থীরা পাসও করছে বেশি। ঢাকা বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যানের মতে, পরীক্ষকরা নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে উদার হচ্ছেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে ফলাফলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, পাসের হার বাড়ার পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে কি না- সত্যিকার অর্থে গবেষণা করা দরকার। তিনি বলেন, বেশি শিক্ষার্থী পাস করবে, জিপিএ ৫ পাবে- এটাই কাম্য। কিন্তু এটা সত্যি সত্যি পড়াশোনা করে পেয়েছে কি না, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, বেশি নম্বর দিয়ে বেশি পাস দেখানো হলে আনন্দের পরিবর্তে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৯৩.০১ শতাংশ, গণিতে ৯২.৭৫, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৪৭ এবং রসায়নে ৯৮.৯৬ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫.৪৬, গণিতে ৯৩.১৬, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৩০ এবং রসায়নে ৯৮.২৩ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬.০৮, গণিতে ৯৩.৮, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৯৭ এবং রসায়নে ৯৮.৮১ শতাংশ। যশোর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫.৭৮, গণিতে ৯২.০৭, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৫৬ এবং রসায়নে ৯৮.৯০ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪.৫, গণিতে ৮৭.০৮, পদার্থবিজ্ঞানে ৯২.৮৭ এবং রসায়নে ৯৪.৮৫ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪.৭৩, গণিতে ৯৪.৮২, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৭.৩১ এবং রসায়নে ৯৭.৭৪ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯১.৩৬, গণিতে ৯১.১৯, পদার্থবিজ্ঞানে ৯১.৪৮ এবং রসায়নে ৯১.৫৪ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬.২৪, গণিতে ৯০.৫৪, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.০৭ এবং রসায়নে ৯৮.৭৭ শতাংশ। মাদ্রাসা বোর্ডে ইংরেজিতে ৯৭.৯৬, গণিতে ৯৭.৩৭, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৯.৪৮, রসায়নে পাস করেছে ৯৭.১১ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ইংরেজিতে ৯৭.৬৬, গণিতে ৯১.০৪, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৩.০৪ ও রসায়নে পাস করেছে ৯৫.৯১ শতাংশ।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতাকে আয়ত্ত করার কারণে এর জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ২১টি বিষয়ের পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে হওয়ায় পাসের হার বেড়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিভীতি কাটিয়ে ওঠায় ফল ভালো হয়েছে। ফল খারাপ হলে শিক্ষকদের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে- এ আশঙ্কা থেকে শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী হয়েছেন। পাশাপাশি নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হলে চূড়ান্ত পরীক্ষার অনুমতি না দেওয়ার নিয়মের কারণেও পাসের হার বেড়েছে। ১১ বছর আগে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল সারা দেশে মাত্র ৭৬ জন; এ বছর পেয়েছে ৮২ হাজার ২১২ জন।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলছেন, ব্যাপক মোটিভেশন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির ফসল এটা। তাঁরা জানান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও গণিতে দুর্বলতা দূরীকরণ, সৃজনশীল বিষয়কে আন্তরিকতার সঙ্গে নেওয়ার কারণে ভালো ফল করেছে শিক্ষার্থীরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আরো ভালো ফল করবে তারা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান-উর-রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা এবার ইংরেজি ও গণিতে ভালো করার কারণেই সার্বিক ফল ভালো হয়েছে। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে আতঙ্ক ছিল। কিন্তু ফল দেখে মনে হয়েছে, এ আতঙ্কও কেটে গেছে। সব মিলিয়ে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আনতে পেরেছি।'
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন কালের কণ্ঠকে জানান, শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে, যার প্রমাণ এ ফল। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কড়া নজরদারি, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণ এ ফল তৈরিতে সাহায্য করেছে। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার সব সূচকে যখন পরিবর্তন ঘটে, তখন মান কমে না। এ ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতিও শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করেছে। ফলে পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। ফাহিমা খাতুন বলেন, এবারের ফলাফলে সৃজনশীল পদ্ধতি বেশি নম্বর পেতে সহায়তা করেছে। পরীক্ষার উত্তরপত্র নেওয়ার সময় পরীক্ষকদের বলা হয়েছিল, মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষা করতে। কারণ গ্রামের স্কুলের উত্তরপত্র আর শহরের স্কুলের উত্তরপত্র এক হবে না। তিনি বলেন, আগের তুলনায় এখন পড়ালেখার গুরুত্ব বেড়েছে। গ্রামগঞ্জের অভিভাবকরাও এখন সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে সচেতন। আগে বিজ্ঞানে ফল খারাপ হতো বলে সার্বিকভাবে পরীক্ষার ফল খারাপ হতো। কিন্তু এবার বিজ্ঞান বিভাগেই বেশি ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মান বাড়ানো হয়েছে।
আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গ্রুপভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৪.৪৮, মানবিকে ৮১.২৬ এবং বাণিজ্য বিভাগে ৮৭.৩৯ শতাংশ।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, 'চার হাজার ৮০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ায় পাসের হার বেড়েছে। তাই ভালো ফল হয়েছে। তবে মানবিকে তুলনামূলক কম পাসের কারণ খতিয়ে দেখা হবে।'
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সৃজনশীলে পাস করা সহজ। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে যেমন সৃজনশীলতা থাকে, তেমনি নম্বর দিতেও সৃজনশীলতা দেখানো হয়। তিনি বলেন, এবার হাওরাঞ্চলে পাসের হার ৮৫ শতাংশ। সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটে সর্বোচ্চ পাসের হারের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বিদেশ গেলেও পড়াশোনা করে যাও। এতে কাজ হয়েছে। সিলেটের শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়া কমেছে। ফলে সিলেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা ছিল সেটি কেটে যাচ্ছে। তাই ফলও ভালো হয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়নি। তবু এ দুই বিষয়ে পাস করেছে ৯০ শতাংশের ওপরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এত পাস করার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার্থীদের যে অবস্থা, তাতে কোনোভাবেই এসএসসিতে ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে উঠতে পারে না। এই ফল শিক্ষার্থীরা সত্যি সত্যি মেধার জোরে পেয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, 'যদি মেধার জোরে পায়, তাহলে আমি খুব খুশি হব।' এ ছাড়া কোচিং-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কারণেও এত পাস হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। তাঁর মতে, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকরা মোটামুটি বলে দিতে পারেন, কোন বছর কোন প্রশ্ন 'কমন' পড়বে। প্রশ্ন 'কমন' হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উত্তর লিখতে পেরেছে। এরাই দুই বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে দেখা যাবে ইংরেজিতে তাদের মান অনেক কম। তিনি বলেন, ইংরেজিতে পাসের হার এত হলেও শিক্ষার মান বাড়েনি। মুখস্থ বিদ্যার প্রভাব বেড়েছে। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে যদি মেধার কারণে এই ফল হয় তাহলে প্রশ্ন নেই। আর যদি পদ্ধতিগত কারণে এই ফল হয় তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে।
বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলেছেন, প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রে নেওয়ার কারণে এসএসসিতে প্রশ্নপত্র কেমন হয়, তার ধারণা পেয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এসএসসি পরীক্ষার আগে স্কুলে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষায়ই শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিতে প্রশ্ন কেমন হবে, তার ধারণা পেয়ে যায়। এতে মূল পরীক্ষায় তাদের ভয় থাকে না। তবে একটি সূত্র বলেছে, এবারে খাতা দেখায় কিছুটা উদারনীতি অবলম্বন করা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত ছয় বিষয়ের পরীক্ষার খাতা দেখাতেও ছিল বাড়তি উদারতা।
দেবাশীষ পাল নামের এক অভিভাবক কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিভাবকরাও এখন আগের চেয়ে সচেতন। তাঁরা সন্তানের প্রতি খুবই মনোযোগী। ফলে শিক্ষার্থীরা পাসও করছে বেশি। ঢাকা বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যানের মতে, পরীক্ষকরা নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে উদার হচ্ছেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে ফলাফলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, পাসের হার বাড়ার পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে কি না- সত্যিকার অর্থে গবেষণা করা দরকার। তিনি বলেন, বেশি শিক্ষার্থী পাস করবে, জিপিএ ৫ পাবে- এটাই কাম্য। কিন্তু এটা সত্যি সত্যি পড়াশোনা করে পেয়েছে কি না, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, বেশি নম্বর দিয়ে বেশি পাস দেখানো হলে আনন্দের পরিবর্তে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
No comments