সমকালীন প্রসঙ্গ-মুরবি্বদের বাংলাদেশ সফর by বদরুদ্দীন উমর

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি হিলারির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন। আওয়ামী লীগ এ দেশে গুম, হত্যাসহ যেসব অনাচার করছে সে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।


একজন বিদেশি মন্ত্রীর সঙ্গে দেশের এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলার অর্থ এ ক্ষেত্রে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা। এটা যে কোনো মতেই সঠিক ও সমর্থনযোগ্য কাজ নয়_ এটা বলাই বাহুল্য। আমরা আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপের কথা সবসময়ই বলে থাকি। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই গায়ে পড়ে দেশীয় ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপ চাই তাহলে সেটা যে দূষণীয় ব্যাপার এতে আর সন্দেহ কি?

দুনিয়াতে বিদেশি রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিবিদদের আসা-যাওয়া হামেশাই হয়ে থাকে। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু দোষ দাঁড়ায় তখনই, যখন তারা আসেন জমিদারি পরিদর্শনের মতো লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মেজাজ নিয়ে। এই মাত্র বাংলাদেশে দু'দেশের দুই মন্ত্রী এসে ফেরত গেলেন। তাদের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় শুধু সাজসাজ রবই ওঠেনি, মনে হলো তাদের আগমনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গদের দল এবং বিরোধী নেত্রী নিজেদের ধন্যজ্ঞান করলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আসার আগে থেকেই মার্কিন দূতাবাস ও সরকার পক্ষ থেকে বলা হতে থাকল যে, এই সফর এক যুগান্তকারী ব্যাপার। এর ফলে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। আসলে এ ধরনের কোনো উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিক কোনো দেশে এসে চুক্তি স্বাক্ষর করার আগেই সে চুক্তির খসড়া তৈরি থাকে। দু'দেশের বৈদেশিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ স্থানীয় আধিকারিকদের মধ্যে এর ওপর বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো তৈরি হয়। সফরকারী সরকারি নেতারা তার ওপর সামান্য কথাবার্তা বলে স্বাক্ষর দেন। কাজেই এই নেতাদের ঢাকঢোল পেটানো সফরের আগেই 'যুগান্তকারী' যা হওয়ার তা হয়ে থাকে। তাদের কাজ শুধু হয় গৃহীত সিদ্ধান্তে সিল-ছাপ্পর মারা। কাজেই এক্ষেত্রে 'যুগান্তরকারী' যে ব্যাপারটি ঘটে তা হলো, দু'দেশের নেতৃত্বের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা, যার গুরুত্ব সৌজন্যমূলকের বেশি নয়। হিলারি ক্লিনটনের সফরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সেদেশের একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা। কিন্তু তিনি এসে কোনো চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষর করেননি। বাহ্যত তার সফরের উদ্দেশ্য ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের সার্ধশতবর্ষের উৎসবের শেষ পর্বে যোগদান। তিনি অবশ্য তার সংক্ষিপ্ত সফরে দ্বিপক্ষীয় কিছু কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেত্রী এবং কিছু সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তার আগমন নিয়েও এখানে যে হুলস্থূল ভাব দেখা গেল সেটা উপেক্ষা করার ব্যাপার নয়। এর থেকে বোঝা যায় ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের চরিত্র। এটা বলাই বাহুল্য যে, বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী তো নয়ই এমনকি প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সফরে গেলে এ ধরনের কোনো হৈচৈ সরকারি প্রশাসনে
হয় না।
এবার প্রণব মুখার্জর্ি রবীন্দ্র উৎসবে আসার কারণে তাকে নিয়ে তুলনামূলকভাবে কোনো বড় হৈচৈ হয়নি। তাছাড়া তিনি বলেই গেছেন যে, দু'দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সহজ সমাধান এখনই সম্ভব নয়। তার জন্য সময় লাগবে। আরও অনেক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজন হবে। ভারত সরকার আওয়ামী লীগের প্রতি অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন, এ ধারণার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন যে, এটা ভুল। তাদের সম্পর্ক বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে। কাজেই বাংলাদেশের জনগণ যে দলকেই নির্বাচিত করবে তারা তার সঙ্গে একই রকম সম্পর্ক বজায় রাখবেন। একথা তিনি মিসেস জিয়ার সঙ্গে আলোচনার সময়ে তাকেও বলেছেন। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। অতীতেও দেখা গেছে, এ দেশের যে কোনো সরকারের সঙ্গেই ভারত একই প্রকার সম্পর্ক রেখে কাজ করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ ছিল এমন বলা যায় না। মিসেস জিয়ার দু'দফা সরকারের সময়ও তাই ছিল। তবে একথা ঠিক যে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে বাড়াবাড়ি রকম অধীনতার ভাব দেখায়, যতখানি জোহুজুরগিরি করে, সেটা অন্যদের ক্ষেত্রে একইভাবে দেখা যায় না। যদিও কার্যক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই থাকে। এখানে অবশ্য বলা দরকার যে, এই সফরে এসে নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের সব থেকে প্রভাবশালী মন্ত্রী কর্তৃক কোনো দলের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্বের কথা অস্বীকার করার বিষয়টি তাৎপর্যহীন নয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি হিলারির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন। আওয়ামী লীগ এ দেশে গুম, হত্যাসহ যেসব অনাচার করছে সে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একজন বিদেশি মন্ত্রীর সঙ্গে দেশের এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলার অর্থ এ ক্ষেত্রে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা। এটা যে কোনো মতেই সঠিক ও সমর্থনযোগ্য কাজ নয়_ এটা বলাই বাহুল্য। আমরা আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপের কথা সবসময়ই বলে থাকি। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই গায়ে পড়ে দেশীয় ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপ চাই তাহলে সেটা যে দূষণীয় ব্যাপার এতে আর সন্দেহ কি?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশে এমনিতেই একশ' রকমে হস্তক্ষেপ করে। তাদের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় বসে এখানকার সরকার, বিরোধী দল এবং সবকিছু সম্পর্কে ইচ্ছামতো কথাবার্তা বলে থাকেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নীতি কী হওয়া দরকার এ বিষয়ে তারা বেশ খোলাখুলি নির্দেশের মতো করেই কথা বলেন। এর ভিত্তি যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই তৈরি হয়েছে এটা এ দেশের শাসকশ্রেণীর সংকটজনক অবস্থার মধ্যেই দেখা যায়। এই সংকট বাংলাদেশের সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রেই ধস নামাচ্ছে। এই ধসে পড়তে থাকা অবস্থায় যে কোনো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকা তো দূরের কথা, প্রায় খতম হওয়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে আজ সেই অবস্থাই বিরাজ করছে।
দুনিয়ার ইতিহাসে সবসময়েই, সব দেশেই দেখা গেছে অভ্যন্তরীণ শাসন দুর্বল ও সংকটজনক হওয়া এবং ভেঙে পড়তে থাকার সময় সে দেশ বহির্শত্রুর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল বা টার্গেটে পরিণত হয়। দেশে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সাধারণ নিয়ম বর্তমান দুনিয়াতেও একইভাবে কার্যকর। এ কারণে দেখা যায় যে দেশ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যত দুর্বল, সে দেশে বৈদেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, অনুপ্রবেশ ও দখলদারি তত বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ কেন বিপন্ন, প্রায় অনুপস্থিত এবং নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে এ বিষয়টি বোঝার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার দিকে তাকানো দরকার।
বাংলাদেশের মতো দেশকে বলা হয়ে থাকে নির্ভরশীল (ফবঢ়বহফবহঃ) দেশ। এই নির্ভরশীলতা কার ওপর? নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে সরকার যাদের কাছে দেনদরবার করে, যাদের থেকে ঋণ নেয়, যাদের সঙ্গে অসম বাণিজ্য চুক্তি করে, যাদের কাছে দেশের সম্পদ পাচার করে, যাদের কাছে বেকার শ্রমিকের জোগান দেয় এবং যাদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে ধমক খায় তারাই হলো বাংলাদেশের মুরবি্ব রাষ্ট্র। বাংলাদেশ হলো তাদের মক্কেল রাষ্ট্র (ঈষরবহঃ ংঃধঃব)। এই রাষ্ট্রগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি সৌদি আরব। এসব দেশের ওপরই বাংলাদেশ আজ নির্ভরশীল।
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এসব দেশের উচ্চমার্গের নেতা-নেত্রীরা, এমনটি মাঝারি পদের লোকেরা যখন বাংলাদেশে আসেন তখন এখানকার সরকার ও সফরকারী দেশের প্রতিনিধিদের আচরণ দেখে মনে হয়, সফরকারীরা আসেন জমিদারি পরিদর্শনে। তাদের এই সফরের উদ্দেশ্য সবসময়েই হয় এ দেশের থেকে নানা সুবিধা আদায় ও সম্পদ লুণ্ঠন।
হিলারি ক্লিনটনের উপস্থিতিতে ঢাকায় যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তার কোনো বিবরণ জনগণকে জানানো হয়নি। যেটুকু প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। মুরবি্ব ও মক্কেল দেশের মধ্যে চুক্তির এটা হলো এক সাধারণ দিক। এবারও সরকারিভাবে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাকে বড়জোর বলা চলে একটা ফবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ রহঃবহঃ. সদিচ্ছার ঘোষণা। এর মধ্যে আর কিছু নেই। হিমবাহের মাত্র এক-দশমাংশ যেমন পানির ওপর দেখা যায়, ঠিক সেভাবেই এসব চুক্তির অতি সামান্য অংশই প্রকাশ করা হয়। বাকি অংশ গোপনই থাকে। সেই অনুযায়ীই কাজ হয়। এ কারণে এ চুক্তিগুলোর পূর্ণ বিবরণ কোনো সময়ই জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয় না। শুধু দেশে এসে বিদেশিরা যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেন সে ক্ষেত্রেই যে এ রকম হয়, এমন নয়। আমাদের সরকারি প্রতিনিধিরা আমেরিকা, ভারত বা এই ধরনের অন্য দেশে গিয়ে যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেসব ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার। গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিলি্লতে গিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তার কোনো বিবরণ আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তারপর থেকে অনেক কিছুই করে চলেছে। সেগুলো যে ওই চুক্তির আওতায় তাতে ওয়াকিবহাল মহলের কোনো সন্দেহ নেই। এবারও হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে তাদের কী এজেন্ডা তারা কার্যকর করবে এটা জনগণের জানার কোনো উপায় নেই। তবে এই চুক্তির ভুক্তভোগী যে তারা হবেন, এতে আর সন্দেহ কি?
৭.৫.২০১২

No comments

Powered by Blogger.