রাজনীতি-বর্জন-সংস্কৃতির অবসান হবে কি? by সোহরাব হাসান
সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানাই। দেরিতে হলেও বিএনপি সংসদে যোগ দিয়েছে। এর আগে তিনি সংসদে ফিরে যাওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দেন। সোমবার জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে
বিএনপি সংসদে যাবে এবং সরকারের জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য রাজপথেও থাকবে।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যে দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংসদে যাওয়া। দুই. জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করা। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখলেই কী সংসদ কার্যকর হবে? ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তো দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল। তা সত্ত্বেও গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়নি, এক-এগারোর মহাদুর্যোগও ঠেকানো যায়নি। বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দলকে উপলব্ধি করতে হবে। আজ বিরোধী দল সংসদ বর্জনের পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগও সেসব যুক্তি দিত। আবার পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে, ২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়া যা বলতেন, এখন শেখ হাসিনা তা-ই বলছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন তাঁর ভাষায় ‘সরকারের জনগণ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনের’ কথা বলেন, তখনই সংসদ তথা গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কা জাগে। আসলেই কি তিনি সংসদীয় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে চান? সরকার জনগণ ও রাষ্ট্রবিরোধী পদক্ষেপ নিলে সংসদেই তার প্রতিবাদ জানাতে হবে। বলতে হবে, এটি বেআইনি, সংবিধানবিরোধী, এ কাজ তোমরা করতে পার না। এসবের পরও যদি সরকারি দল গায়ের জোরে কিছু চাপাতে চায়, তাহলে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। গণতন্ত্রে সংসদই হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।
বিরোধীদলীয় নেত্রী রাজপথে আন্দোলনের কথা বলেছেন। এই আন্দোলন বলতে যদি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু রাজপথ বন্ধ করে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে সভা-সমাবেশ করা যাবে না। যে কথা তাঁরা রাজপথে বলতে চান, সেই কথা সংসদে বললে অসুবিধা কোথায়?
আর তিনি রাজপথের আন্দোলন বলতে যদি ফের হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন, তাহলে জনগণ সেটি মানবে না। হরতাল-অবরোধ করে দেশের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি আর নয়। নির্বাচনের আগে তো দুই দলই সংসদকে কার্যকর ও অর্থবহ করার কথা বলেছিল। এখন তা থেকে তাঁরা সরে আসতে পারেন না।
মতবিনিময় সভায় জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের বক্তব্য নিশ্চয়ই বিএনপি নেত্রী শুনেছেন। তাঁরা একবাক্যে সবাই বলেছেন, বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জন ঠিক হয়নি। তাঁরা অবিলম্বে তাঁদের সংসদে যেতে বলেছেন। সামনের সারিতে একটি বা দুটি আসন নিয়ে অব্যাহত সংসদ বর্জন চলতে পারে না। একজন সম্পাদক বলেছেন, সংসদে তাঁদের কথা বলতে না দিলেও সেখানে অবস্থান করতে হবে। সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদও জানাতে হবে সংসদে থেকে। জনগণের দাবি-দাওয়া ও অধিকারের কথা বলার জন্যও বিরোধী দলকে সংসদে থাকতে হবে। সরকারকেও বুঝতে হবে, সংসদ কোনো দলের সম্পত্তি নয়। গায়ের জোরে সবকিছু করা ঠিক নয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সংসদে গরহাজির থেকে জনগণকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত করেছে। এ অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। গত এক বছরে দেশে বহু অঘটন ঘটেছে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ছাত্র সংঘর্ষের কারণে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবরও পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতমুক্ত করার নামে প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ চলছে। বিরোধী দল সংসদে থাকলে এসব বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে পারত। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সংসদে আলোচনা না করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সংসদে আলোচনা, সমালোচনা, যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই সঠিক সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতে পারে। বিরোধী দল সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করবে, আবার ভালো কাজের প্রতি সমর্থন জানাবে, এটাই গণতন্ত্রের রীতি।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর ও ভারতের সঙ্গে সই করা চুক্তি নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল বাগ্যুদ্ধ চালাচ্ছে সংসদের বাইরে। অথচ সংসদে বিষয়টি নিয়ে অর্থবহ আলোচনা হতে পারত। তবে সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে যুক্তির ভাষায় কথা বলতে হবে। বিএনপি এত দিন বলে আসছিল যে সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে এসেছে। আসলেই কি এর সমর্থনে কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে? মতবিনিময় সভায় এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জবাব দেন, চুক্তির বিস্তারিত তাঁদের জানা নেই, একটি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়েছে। তিনি দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন এবং আছেন। এর পরও কি তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনা যায়? আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব কি এতটাই দায়িত্বহীন?
আবার সরকারি দলও যদি মনে করে, জনগণ তাদের পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছে, অতএব এ পাঁচ বছর তারা যা খুশি করতে পারবে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। জনগণ তাদের নির্বাচিত করেছে সুশাসনের জন্য। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দলবাজির জন্য নয়। সরকারের দখলদারি মানসিকতার ভয়াবহ পরিণাম আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। জনগণ বহু দুর্ভোগ সহ্য করেছে। বহুবার ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তার পরও যদি চৈতন্যোদয় না হয়, তাহলে তারা আবারও সমুচিত জবাব দেবে।
সংসদে কথা বলতে দেওয়া, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা এবং বাকি দুটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার যে দাবি বিএনপি নেত্রী জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই আমরা মনে করি। সরকারি দলও এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে। এর পরও কোনো সংশয় থাকলে স্পিকারের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সামনের সারির আসন নিয়েও সরকারি দলের একগুঁয়েমি থাকা উচিত নয়। যে সংসদে সরকারি দলের তিন-চতুর্থাংশ আসন আছে, সেই সংসদে সামনের সারিতে বিরোধী দলকে দুটি বাড়তি আসন দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে সরকারি দলের সাংসদেরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রায়ই দেখা যায়, কোরামের অভাবে সংসদের অধিবেশন শুরু হতে দেরি হচ্ছে। পেছনের সারির কথা বাদ দিলেও প্রথম সারির অনেক আসন ফাঁকা থাকে। সংসদ নেত্রী অনুপস্থিত থাকলে তো কথাই নেই। সরকারি দলের সাংসদদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা সংসদে যান সংসদীয় ভূমিকা পালন করতে নয়, সংসদ নেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। এভাবে কোনো সংসদ চলতে পারে না, চলে না।
দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলকে তিনি সংখ্যা দিয়ে বিচার করবেন না। বিরোধী দলে অনেক প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ সাংসদ আছেন। তাঁদের যুক্তি-পরামর্শ সংসদকে শুধু প্রাণবন্তই করবে না, জনকল্যাণেও এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা বাড়বে। এর আগেও দেখেছি, বর্তমান সংসদেও লক্ষ করছি, অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে, যা ব্যক্তিগত গালাগালের পর্যায়ে পড়ে। বিতর্কে জীবিত নেতারা যথেষ্ট নয় মনে করে, প্রয়াত নেতাদের লাশ নিয়েও টানাটানি চলে। ইতিহাসে যার যে ভূমিকা তা স্বীকার করে নিতে হবে।
বিরোধী দল এখন সংসদে। তবে বিরোধীদলীয় নেত্রী গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সংসদে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর দিনই বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সরকার যেভাবে আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমানকে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় জড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে আমরা সংসদে গেলেও কত দিন থাকতে পারব, তা নিশ্চিত নয়।’ আমাদের উত্কণ্ঠার কারণও সেটি। বিরোধী দল আসলেই সংসদের বাকি মেয়াদে তাদের সাংবিধানিক ভূমিকা পালনে প্রস্তুত না সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে? বর্জন-সংস্কৃতির অবসান হবে কি? এসব প্রশ্ন্নের জবাব পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যে দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংসদে যাওয়া। দুই. জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করা। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখলেই কী সংসদ কার্যকর হবে? ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তো দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল। তা সত্ত্বেও গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়নি, এক-এগারোর মহাদুর্যোগও ঠেকানো যায়নি। বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দলকে উপলব্ধি করতে হবে। আজ বিরোধী দল সংসদ বর্জনের পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগও সেসব যুক্তি দিত। আবার পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে, ২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়া যা বলতেন, এখন শেখ হাসিনা তা-ই বলছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন তাঁর ভাষায় ‘সরকারের জনগণ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনের’ কথা বলেন, তখনই সংসদ তথা গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কা জাগে। আসলেই কি তিনি সংসদীয় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে চান? সরকার জনগণ ও রাষ্ট্রবিরোধী পদক্ষেপ নিলে সংসদেই তার প্রতিবাদ জানাতে হবে। বলতে হবে, এটি বেআইনি, সংবিধানবিরোধী, এ কাজ তোমরা করতে পার না। এসবের পরও যদি সরকারি দল গায়ের জোরে কিছু চাপাতে চায়, তাহলে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। গণতন্ত্রে সংসদই হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।
বিরোধীদলীয় নেত্রী রাজপথে আন্দোলনের কথা বলেছেন। এই আন্দোলন বলতে যদি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু রাজপথ বন্ধ করে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে সভা-সমাবেশ করা যাবে না। যে কথা তাঁরা রাজপথে বলতে চান, সেই কথা সংসদে বললে অসুবিধা কোথায়?
আর তিনি রাজপথের আন্দোলন বলতে যদি ফের হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন, তাহলে জনগণ সেটি মানবে না। হরতাল-অবরোধ করে দেশের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি আর নয়। নির্বাচনের আগে তো দুই দলই সংসদকে কার্যকর ও অর্থবহ করার কথা বলেছিল। এখন তা থেকে তাঁরা সরে আসতে পারেন না।
মতবিনিময় সভায় জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের বক্তব্য নিশ্চয়ই বিএনপি নেত্রী শুনেছেন। তাঁরা একবাক্যে সবাই বলেছেন, বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জন ঠিক হয়নি। তাঁরা অবিলম্বে তাঁদের সংসদে যেতে বলেছেন। সামনের সারিতে একটি বা দুটি আসন নিয়ে অব্যাহত সংসদ বর্জন চলতে পারে না। একজন সম্পাদক বলেছেন, সংসদে তাঁদের কথা বলতে না দিলেও সেখানে অবস্থান করতে হবে। সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদও জানাতে হবে সংসদে থেকে। জনগণের দাবি-দাওয়া ও অধিকারের কথা বলার জন্যও বিরোধী দলকে সংসদে থাকতে হবে। সরকারকেও বুঝতে হবে, সংসদ কোনো দলের সম্পত্তি নয়। গায়ের জোরে সবকিছু করা ঠিক নয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সংসদে গরহাজির থেকে জনগণকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত করেছে। এ অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। গত এক বছরে দেশে বহু অঘটন ঘটেছে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ছাত্র সংঘর্ষের কারণে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবরও পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতমুক্ত করার নামে প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ চলছে। বিরোধী দল সংসদে থাকলে এসব বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে পারত। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সংসদে আলোচনা না করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সংসদে আলোচনা, সমালোচনা, যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই সঠিক সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতে পারে। বিরোধী দল সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করবে, আবার ভালো কাজের প্রতি সমর্থন জানাবে, এটাই গণতন্ত্রের রীতি।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর ও ভারতের সঙ্গে সই করা চুক্তি নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল বাগ্যুদ্ধ চালাচ্ছে সংসদের বাইরে। অথচ সংসদে বিষয়টি নিয়ে অর্থবহ আলোচনা হতে পারত। তবে সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে যুক্তির ভাষায় কথা বলতে হবে। বিএনপি এত দিন বলে আসছিল যে সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে এসেছে। আসলেই কি এর সমর্থনে কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে? মতবিনিময় সভায় এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জবাব দেন, চুক্তির বিস্তারিত তাঁদের জানা নেই, একটি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়েছে। তিনি দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন এবং আছেন। এর পরও কি তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনা যায়? আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব কি এতটাই দায়িত্বহীন?
আবার সরকারি দলও যদি মনে করে, জনগণ তাদের পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছে, অতএব এ পাঁচ বছর তারা যা খুশি করতে পারবে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। জনগণ তাদের নির্বাচিত করেছে সুশাসনের জন্য। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দলবাজির জন্য নয়। সরকারের দখলদারি মানসিকতার ভয়াবহ পরিণাম আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। জনগণ বহু দুর্ভোগ সহ্য করেছে। বহুবার ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তার পরও যদি চৈতন্যোদয় না হয়, তাহলে তারা আবারও সমুচিত জবাব দেবে।
সংসদে কথা বলতে দেওয়া, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা এবং বাকি দুটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার যে দাবি বিএনপি নেত্রী জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই আমরা মনে করি। সরকারি দলও এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে। এর পরও কোনো সংশয় থাকলে স্পিকারের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সামনের সারির আসন নিয়েও সরকারি দলের একগুঁয়েমি থাকা উচিত নয়। যে সংসদে সরকারি দলের তিন-চতুর্থাংশ আসন আছে, সেই সংসদে সামনের সারিতে বিরোধী দলকে দুটি বাড়তি আসন দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে সরকারি দলের সাংসদেরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রায়ই দেখা যায়, কোরামের অভাবে সংসদের অধিবেশন শুরু হতে দেরি হচ্ছে। পেছনের সারির কথা বাদ দিলেও প্রথম সারির অনেক আসন ফাঁকা থাকে। সংসদ নেত্রী অনুপস্থিত থাকলে তো কথাই নেই। সরকারি দলের সাংসদদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা সংসদে যান সংসদীয় ভূমিকা পালন করতে নয়, সংসদ নেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। এভাবে কোনো সংসদ চলতে পারে না, চলে না।
দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলকে তিনি সংখ্যা দিয়ে বিচার করবেন না। বিরোধী দলে অনেক প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ সাংসদ আছেন। তাঁদের যুক্তি-পরামর্শ সংসদকে শুধু প্রাণবন্তই করবে না, জনকল্যাণেও এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা বাড়বে। এর আগেও দেখেছি, বর্তমান সংসদেও লক্ষ করছি, অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে, যা ব্যক্তিগত গালাগালের পর্যায়ে পড়ে। বিতর্কে জীবিত নেতারা যথেষ্ট নয় মনে করে, প্রয়াত নেতাদের লাশ নিয়েও টানাটানি চলে। ইতিহাসে যার যে ভূমিকা তা স্বীকার করে নিতে হবে।
বিরোধী দল এখন সংসদে। তবে বিরোধীদলীয় নেত্রী গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সংসদে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর দিনই বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সরকার যেভাবে আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমানকে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় জড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে আমরা সংসদে গেলেও কত দিন থাকতে পারব, তা নিশ্চিত নয়।’ আমাদের উত্কণ্ঠার কারণও সেটি। বিরোধী দল আসলেই সংসদের বাকি মেয়াদে তাদের সাংবিধানিক ভূমিকা পালনে প্রস্তুত না সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে? বর্জন-সংস্কৃতির অবসান হবে কি? এসব প্রশ্ন্নের জবাব পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments