সহজিয়া কড়চা-যে চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছবে না by সৈয়দ আবুল মকসুদ

লেখা তৈরি না হলে অনেক সময় লেখককে কাগজের পাতা ভরার জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করতে হয়। এই হপ্তায় আমারও সেই দশা। একটি চিঠির খসড়া করছিলাম কয়েক দিন যাবত্। সেটি ডাকবাক্সে না ফেলে ‘সহজিয়া কড়চা’ নামে চালিয়ে দিতে চাই। এই চিঠি পোস্ট করা হলেও প্রাপক তা পড়তেন না। সে সময় তাঁর নেই।


ফেব্রুয়ারি পড়েছে তো পড়েছে আমাদের ফাল্গুন মাসে। ভাষা-সাহিত্য ও ভালোবাসাবাসির মাস। বাঙালির সাহিত্য সৃষ্টি ও বিক্রির মাসও। উপসম্পাদকীয় রচনা বা কলাম এক ধরনের সাহিত্য, তবে সৃষ্টিশীল সাহিত্য নয়। আমি নিরেট প্রাণহীন গদ্যলেখক। কলামে কোনো প্রাকরণিক পরীক্ষা চলে না। পত্রোপন্যাস হয়, পত্র-কলাম হয় না। কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধন হারা পত্রোপন্যাস। আমার এই চিঠিটির বিষয়বস্তু হবে এলোমেলো, যখন যা মনে এসেছে তা-ই লিখেছি। ঘুমের মধ্যে কথা বলার মতো। আমার এই গদ্যাংশের প্রকরণ অনেকটা Stream of consciousness বা চেতনাপ্রবাহ রীতিতে লেখা উপন্যাসের মতো। জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছেন। যা হোক, আমার চিঠির খসড়াটি এ রকম:
দেশগতপ্রাণ মাননীয়াসু,
সালাম গ্রহণ করুন। আশা করি ছোট ছেলে ও আপনার বৌমা ভালো আছেন। তাঁদের অশেষ দোয়া। আপনি দেশ নিয়ে ব্যাকুল—দেশের হতভাগ্য জনগণকে নিয়ে নয়। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী জনগণ নিয়ে চিন্তিত—দেশ পরে। জনগণের চেয়ে আপনি যে দেশ নিয়ে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগে থাকেন তার একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। গত রমজানে দেশের ৮০ ভাগ রোজাদার শরবত পান করতে পারেনি। ৮০ টাকা কেজি চিনি কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তা নিয়ে কোনো উচ্চাবাচ্য ও সভা-সমাবেশ না করে আপনি ও আপনার মহাসচিব টিপাইমুখ নিয়ে ব্যস্ত রইলেন।
চিনির দামের চেয়ে টিপাইমুখ আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন, তার একটি কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। শরবত বানাতে চিনির চেয়ে আগে দরকার পানির। সে জন্য পানির নিশ্চয়তা আপনারা আগে চান। ভারত পানি বন্ধ করে দিলে আমার বন্ধু ফারুক খান বিনা পয়সায় চিনি দিলেও কোনো ফায়দা নেই।
গত আট-নয় মাস যাবত্ আপনি ও আপনার মহাসচিব প্রমুখ টিপাইমুখ নিয়েই পেরেশানিতে আছেন। টিপাইমুখ প্রকল্প আট-নয় মাস আগে গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের মতো হতভাগারাই ওই প্রসঙ্গে আগে কথা বলে। পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। তখন আপনি ক্ষমতায়। মুক্তাঙ্গন ও প্রেসক্লাবের আশপাশের পান-সিগারেটের দোকানিরা জানেন, কারা টিপাইমুখ নিয়ে রোদ অথবা বৃষ্টির মধ্যে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে। আপনার মহাসচিব না জানতে পারেন, শাহবাগ জাদুঘরের সামনের বটগাছগুলোও জানে, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে অরণ্যে রোদন করেছে কারা। আপনারা এখন যতটা সরব, তখন ততটাই ছিলেন নিশ্চুপ। ২৯ ডিসেম্বর বিপরীত ফলাফল হলে আপনারা কি টিপাইমুখ নিয়ে এত কথা বলতেন? আপনার মহাসচিব হতেন এলজিআরডি মন্ত্রী। স্থানীয় সরকারের টাকা বরাদ্দ নিয়ে তিনি তখন এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলার কোনো অবকাশই তিনি পেতেন না। কাজেই আপনাদের মুখে টিপাইমুখের কথা শুনে এখন মানুষ মুখটিপে হাসে।
আপনাকে বুদ্ধি বা পরামর্শ দিই সেই অধিকার ও ইলেম আমার নেই। অগণিত মানুষ আপনার সমর্থক। আপনি ডাক দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার বা লাখো মানুষ জড়ো হতে পারে। আপনি যে নির্দেশ দেবেন তা তারা শুনবে। সুতরাং আপনার দায়িত্ব বিরাট। পৃথিবীর সব মানুষকে আল্লাহ এই তৌফিক দেন না। দু-দুবার আপনি ১৪ কোটি মানুষকে শাসন করার ক্ষমতা পেয়েছেন। আপনি আপনার সাধ্যমতো সে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিহাসে আপনার স্থান স্থায়ী। তবে কীভাবে ইতিহাস আপনাকে মূল্যায়ন করবে সেটা ভিন্ন বিষয়।
আশির দশকে দীর্ঘ সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে আপনারা দুই জোটের পক্ষ থেকে দুজন নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনগণ আপনার অনমনীয়তা বা আপসহীনতার মূল্যায়ন করেছিল একানব্বইয়ের নির্বাচনে। আট বছর রাজপথে ছিলেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত পর্যন্ত হয়েছেন সচিবালয়ের গেটে বা পল্টনে, আমার চোখের সামনে। অর্থাত্ সুবিধাবাদী ও ভিরু নেতৃত্বের দেশে আপনি অগ্নিপরীক্ষায় পার হয়ে এসেছেন। শুধু শারীরিক লাঞ্ছনা নয়, নিন্দা-অপবাদকে আপনি মাকড়সার জালের মতো হাত নেড়ে মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
যখন আশির দশকে আপনার রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙার জন্যও বিশ্ব পুঁজিবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদ শেষ লড়াই করছে। সে লড়াই করতে গিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি পৃথিবীর দেশে দেশে বাম ও কমিউনিস্টবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল এবং দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাতে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আপনার সুবিধা হয়। পনের বা আটদলীয় জোট ছিল বামঘেঁষা মধ্যপন্থী। আপনার নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট ছিল ডানঘেঁষা। পনেরদলীয় অসাম্প্রদায়িক জোটকে যদি কিছুটা প্রগতিশীল বলি, তাহলে আপনার সাতদলীয় জোট ছিল রক্ষণশীল—ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে যার সম্পর্ক নিবিড়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করার সময় বিশ্বপুঁজিবাদ সব দেশের রক্ষণশীলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। তাদের দিতে থাকে সাহায্য-সহযোগিতা। সেই সুযোগটি আপনার দল ও আপনি গ্রহণ করে উপকৃত হন।
পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও আজ উদার ও রক্ষণশীল দুটি ধারাই সমান্তরাল সক্রিয়। তবে অধিকাংশ দেশে খ্রিষ্টধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। রক্ষণশীলদের সঙ্গে আঁতাত করে ইউরোপের বহু দেশেই তারা আজ ক্ষমতায়। সুতরাং বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশে ইসলামি মৌলবাদীদের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ওই গোষ্ঠীটি আপনার মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে পায় তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ঢাল হিসেবে। তাদের এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর হয় না। আপনার জন্য সেটা বড় দুর্ভাগ্য। শুধু আপনার নয়, গোটা দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য।
একেক দেশের সাম্প্রদায়িকতার ধরন ভিন্ন। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ধরনও আলাদা। আপনি মওলানা ভাসানীর রাজনীতির কথা শুনেছেন, তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করেননি। তাঁর যেসব সাগরেদ আপনার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তাঁরা আর মওলানা এক জিনিস নন, মওলানার ভারতবিরোধী রাজনীতির কথা আপনি শুনেছেন। সে জন্য তাঁর প্রতি আপনার কিঞ্চিত্ অনুরাগ।
আপনার স্বামী পঁচাত্তরের ডিসেম্বর মাসটা পার করতে পারতেন না। ক্ষমতা হারাতে হতো মওলানা সমর্থন না দিলে। সামরিক পোশাক ও উর্দি পরা অবস্থায় তিনি যখন পিজি হাসপাতালে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন মওলানা তাঁকে বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসকদের মতো অফিসে বসে বসে শুধু ফাইলওয়ার্ক করো না। মানুষের জন্য যদি কিছু করতে চাও, গ্রামে গিয়া মানুষের সঙ্গে মেশো।’ কথাটা আপনার স্বামীর মনঃপূত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নাম শুনলে মওলানা যে হুঙ্কার দিয়ে উঠতেন তা সম্ভবত আপনি জানেন না। আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের মৃদু নিন্দাও আপনার মুখে শুনিনি।
আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম। তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, আপনার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রিত্ব। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদটি আপনার একেবারেই পছন্দ নয়। অথচ আমরা জানি, পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধীদলীয় নেতার পদটি প্রধানমন্ত্রীর সমকক্ষ। জনস্বার্থ রক্ষায় বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব বিরাট। কী অভিমান করলেন, সংসদেই গেলেন না দশ মাস—৬৪ কর্মদিবস। আপনার যোগ্য ও জনপ্রিয় মহাসচিব এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। দলের সংসদ সদস্যরা আগামী চার বছর যদি সংসদে না যান তাঁর কোনো ক্ষতি নেই।
মিডিয়ার মানুষ আপনার নাগাল খুব কমই পান। কিন্তু ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে এই কারণে যে, তিনি ভারত সফর করার ফলে আপনি তিন-তিনবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাওয়ার আগে একবার, সফর সাঙ্গ করে আসার পরে আরেকবার। তৃতীয়বার গত ৮ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের ‘চা-চক্রে মতবিনিময়’-এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁদের আপনি বলেছেন, ‘আমি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার রাজনীতি করছি।’ আরও বলেছেন, ‘আমরা সংসদে যাব, রাজপথেও প্রতিবাদ জানাব।’ সেটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু একটি বছর সংসদেও গেলেন না, রাজপথেও দেখা গেল না। ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি থেকে তো দেশে জরুরি অবস্থা নেই, সভা-সমাবেশও নিষিদ্ধ নয়।
একটি কথা জানতে ইচ্ছা হয়। প্রধানমন্ত্রী যদি ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আয়ারল্যান্ড, ইতালি বা পাকিস্তান যেতেন তাহলেও কি আপনি দু-তিনবার সংবাদ সম্মেলন করতেন? প্রধানমন্ত্রী তো অনবরত ট্যুরই করছেন। দুদিন আগেও তো কুয়েত ঘুরে এলেন। তখন তো সাংবাদিকদের ডাকলেন না।
আপনার দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনটা ছিল মূলত সাহিত্যসংক্রান্ত। রাজনৈতিকও নয়, কূটনৈতিকও নয়। হিন্দু-ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ও সুন্নি মুসলমান নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গিয়ে ভারতের শিখ প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেসের ইতালীয়-বংশোদ্ভূত খ্রিষ্টান সভানেত্রীর কাছে বাঙালি ব্রাহ্ম-কবির পক্ষ অবলম্বন করে এসেছেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত নজরুল হয়েছেন বঞ্চনার শিকার। আমি নজরুলের ওপর একটি বই লেখায় হাত দিয়েছি, সুতরাং আমি আপনার পক্ষেই আছি। তবে এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে। কাদার মতো নরম মনের মানুষ নজরুলও একবার একজনের মাথা ফাটিয়েছিলেন বাঁশ দিয়ে বাড়ি মেরে। ওই লোক বোধহয় নজরুলকে খুশি করার জন্য বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুলের কবিতাই ভালো।’
কোনো জাতির ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে গেলে ওই জাতির ও সেই ভূখণ্ডের ইতিহাসটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আপনার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আপনার দলের উচ্চশিক্ষিত নেতারাও কি বাঙালির ও পূর্ব বাংলার ইতিহাস পাঠ করেননি? আপনার দলে বহু পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী আছেন। তাঁদের লেখাপড়া ভালো। তাঁরা তো জানেন, দেশটা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসীর। এখানকার সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সমন্বয়ী প্রভাব। আপনার দশ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ত্রিসীমানায় আমাদের যেতে দেননি। ঘরে বসে আমরা অনুষ্ঠান দেখতাম। গৌণতম মুসলমান কবিদের কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হচ্ছে। তাই একবার আমি বিটিভির মহাপরিচালককে বলেছিলাম, চেষ্টা করে দেখুন বিষাদ-সিন্ধু ও মহাশ্মশান-এ সুরারোপ করে পরিবেশন করা যায় কি না। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দিয়ে কেউ কোনোদিন লাভবান হয়েছে এমন নজির ইতিহাসে নেই।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর উপলক্ষে তিন-তিনটি সংবাদ সম্মেলন করেও আপনাদের মন ভরেনি। উদ্বেগ একটাই: ভারত। এখন আপনার সংগঠন একটি রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। এর নামকরণ করলে ভালো হয়: ‘ভারত প্রতিরোধ সংঘ’। অথচ আপনি তো বালথেকারে বা নরেন্দ্র মোদি নন। বৃহস্পতিবার আপনার দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা এক হোটেলে ভোজসভায় মিলিত হন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। আয়োজক আপনাদের পেশাজীবী সংগঠন গ্রুপ ২০০৯ বা জি-৯। আপনারা দাবি করেন জাতীয়তাবাদী। দাওয়াত দিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। ভুটান, নেপাল, নেদারল্যান্ড বা রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূতকে নয়। সেখানেও মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন: ‘বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে ভারত বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।
আপনাদের মেহমান সাফ বলে দিয়েছেন, করুক গিয়া। দুই পক্ষ বইসা মিটমাট কইরা ফ্যালান। আমরা কোনো মধ্যস্থতার মধ্যে নাই।
আপনার বিজ্ঞরা তো জানেন যে, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আপাতত মধুরতম। ওই বন্ধুত্ব নষ্ট করে আমেরিকা কিছুই করবে না। তবে রাষ্ট্রদূত এ কথাও বলেছেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক রক্ষায় তৃতীয় কোনো দেশের প্রয়োজন নেই। ঢাকা ওয়াশিংটনের পরীক্ষিত বন্ধু। তবে সাধারণ আক্কেলের কথা হলো এই: কোনো ধরনের ভারত প্রতিরোধ সংঘকে আমেরিকা সমর্থন দেবে না। তখন আপনার ও আপনার মহাসচিবের সামনে পথ থাকবে একটাই: বালথেকারের আদর্শ বাদ দিয়ে শ্যাভেজ ও আহমেদিনেজাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। তা কি পারবেন?
বাংলাদেশ ও ভারতের ভূগোলটি এমন যে, অমীমাংসিত সমস্যা সব সময়ই কিছু থাকবে। একটির সমাধান হলে আরেকটি দাঁড়াবে। কিন্তু তার পরেও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হওয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী ডিমভরা ইলিশ নিয়ে ভারত গেছেন। সেখানে শাড়ি উপহার পেয়েছেন। বাগবাজারের তালশাঁস রসগোল্লা আর ভীমনাগের সন্দেশ খেয়েছেন। আমার মতো মিষ্টান্নপ্রিয় মানুষ ছাড়া তাতে আর কারও গোস্বা হওয়ার কারণ নেই। অথচ আমরা জানি, এই সফরটি নয় বছর আগে আপনিও করতে পারতেন। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র এসেছিলেন। আপনাকে দাওয়াত দেওয়া হয়। পাঁচ বছরে আপনি সময় করে উঠতে পারেননি। আপনিই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারতেন। মগবাজারের নেতারা সম্ভবত আপনাকে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেননি।
ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের পথ হলো: সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য, উদার অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবসম্মত প্রাগম্যাটিক দূরদর্শিতা। হিংসার পথ নয়।
বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। প্রধান বাজার হলো গরু আর গরম মসলার বাজার। ভারত যদি গরু আসা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আপনার ও আপনার সহযোগী দলটির ভোটারদের মেজাজ গরম হবে আপনাদেরই ওপর। ভারত থেকে যদি গরু না আসে কয়জন কোরবানি দিতে পারবেন তা একমাত্র দুদকের চেয়ারম্যানই বলতে পারেন। পাকিস্তান থেকে কিছু উট আনা যেতে পারে, তবে বাঙালি মুসলমান উটের রুঠা মাংসের চেয়ে গরুর চর্বিযুক্ত মাংস ও কুড়মুড়ে হাড্ডি বেশি পছন্দ করে। সৌদি আরব থেকে দুম্বা আনা গেলেও গরুর গোশতের শূন্যতা তাতে পূরণ হবে না।
শুধু গরু নয়, গরম মসলাও ভারত থেকে আসে। এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, জিরা, আলুবোখারা, পিঁয়াজ প্রভৃতি যদি ভারত থেকে আসা বন্ধ হয় তাহলে গো-মাংস প্রস্তর-যুগের মানুষের মতো শুধু আগুনে ঝলসে খেতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে, কাবার আর রেজালা খাওয়ার লোভে টিপাইমুখ, তালপট্টি, সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বিনা প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে। আপনি জাতীয় নেতা, আপনার মুখে অব্যাহত ভারতবিরোধিতা শোভা পায় না। এখন যা মনে হচ্ছে, গুলশান, নয়াপল্টন ও মগবাজারের ভারতবিরোধিতা নয়াদিল্লি অসন্তুষ্ট না হয়ে উপভোগই করে।
বিনয়াবনত—
আপনার বিশ্বস্ত
দস্তখত (অস্পষ্ট)
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.