একুশে-ভাষাশহীদ শফিউরের কথা by দীপংকর চন্দ
‘১৯৫২ সালের ১৮ মে। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হওয়ার পর তিনটি মাসও পেরোয়নি পুরোপুরি। সে সময়ই আমি ভূমিষ্ঠ হলাম ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের পিতৃপরিচয় নিয়ে।’ শফিকুর রহমান এভাবেই বলতে থাকেন বাবার কথা।
জন্মের আগেই বাবাকে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে আমাদের সামনে উন্মোচনের চেষ্টা করেন ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র। ‘নানা সূত্রে আহরিত তথ্যানুসারে, আমার বাবা ভাষাশহীদ শফিউর রহমান জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগরে, ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। তাঁর বাবার নাম মাহবুবুর রহমান ও মায়ের নাম কানেতাতুন্নেসা। পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ শফিউর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন কোন্নগরেই একটি স্থানীয় বিদ্যালয়ে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন কোন্নগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে। তারপর কলকাতা কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আইকম পাস করেন তিনি। কিন্তু সংসারে সচ্ছলতা যোগ করার স্বার্থে আরও অধিক শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত রইলেন শফিউর রহমান। চব্বিশ পরগনার সিভিল সাপ্লাই অফিসে কোনোরকমে একটা চাকরি জুটিয়ে গৃহকর্মে মন দিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগে শফিউর রহমান বিয়ে করলেন কলকাতা নিবাসী তমিজুদ্দিন আহমেদের মেয়ে আকিলা খাতুনকে। তারপর সুখে-দুঃখে বেশ ভালোই কাটছিল শফিউর রহমানের দাম্পত্য জীবন, কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এক প্রহেলিকাময় ঘূর্ণির সৃষ্টি করল জীবনের সচল প্রবাহে। অনেক চিন্তাভাবনার পর স্মৃতিবিজড়িত পশ্চিমবঙ্গের মায়া ত্যাগ করলেন শফিউর রহমানের বাবা মাহবুবুর রহমান। নির্ভরতার আশ্বাসপূর্ণ নিশ্চিত জীবনকে পেছনে ফেলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যসহ তিনি ঢাকায় চলে এলেন। এবার মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেওয়ার পালা। পুরান ঢাকার কলতাবাজারের কাছে ৬ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনে আশ্রয় নিল শফিউর রহমানের পরিবার। পুরান ঢাকা তখন নগরীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শফিউর রহমানের বাসার কাছেই আজাদ সিনেমা হল। রাস্তা পেরোলেই শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার। কয়েক পা এগোলেই প্রাণচঞ্চল বুড়িগঙ্গা। ঢাকায় এসেই শফিউর রহমানের বাবা চাকরি পেলেন ডাক ও তার অফিসে সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে আর আমার বাবা শফিউর রহমান ঢাকা হাইকোর্টে যুক্ত হলেন হিসাবরক্ষক পদে। খুব তাড়াতাড়িই ঢাকার নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিল পুরো পরিবারটি।’ কথা বলতে বলতে ছোট্ট একটা বিরতি নিলেন ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের একমাত্র ছেলে শফিকুর রহমান, সুসজ্জিত কক্ষের কেন্দ্রে স্থাপিত টেবিল থেকে এক পেয়ালা ধূমায়িত চা তুলে নিলেন হাতে। তারপর চুমুক দিতে দিতে রেশ ধরলেন পূর্বকথনের।
‘ঢাকায় আসার পর আমার বড় বোন জন্ম নিলেন। মা-বাবা তাঁর নাম রাখলেন শাহনাজ। আশফিয়া খাতুন শাহনাজ। ১৯৫০ সালের ঘটনা এটা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন দানা বেঁধেছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন। এ বছরের শুরুতেই আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হলো। এই কমিটির নেতৃত্বে ১১ মার্চ পালন করা হলো রাষ্ট্রভাষা দিবস। এভাবেই বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ ধরে অতিক্রান্ত হলো ১৯৫০ সাল। ১৯৫১ সালটিও অতিবাহিত হলো ভাষা আন্দোলনের নানা উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৯৫২ সাল এল বাঙালি জাতির জীবনে।’
‘২১ ফেব্রুয়ারি। পূর্ববাংলা বিধান পরিষদের অধিবেশন ছিল সেদিন। অথচ পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনড় ছিল ছাত্ররা। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদের বাধা দিল পুলিশ। আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে পুলিশের সেই বাধা অতিক্রমে সচেষ্ট হলো ছাত্ররা। আন্দোলন-সংগ্রাম ক্রমেই মারমুখী চেহারায় রূপ নিল। পুলিশ গুলি চালাল। মারা গেলেন রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে রইল আবদুস সালামের সংজ্ঞাহীন দেহ। ঘৃণিত এ ঘটনায় ক্রোধে উন্মাতাল হলো দেশ। সেদিন আর কাজে মন বসল না শফিউর রহমানের। বিষণ্ন অন্তঃকরণে হাইকোর্ট থেকে তিনি ফিরে এলেন বাসায়।’
‘পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ভাষাশহীদদের গায়েবি জানাজার কর্মসূচি। জানাজা শেষে জনসমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল। শফিউর রহমান বাড়ি থেকে বের হলেন। প্রাত্যহিক নিয়মেই যাত্রা করলেন অফিসের পথে। কিন্তু সেই পথে আজ অগণন বিক্ষুব্ধ মানুষ। প্রদীপ্ত তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ। ঊর্ধ্বে উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাত, কণ্ঠে তাঁদের বজ্রনিনাদি স্লোগান। এসব এড়িয়ে কী করে অফিসে যাবেন তিনি? কী করে মন বসাবেন বৈচিত্র্যহীন আটপৌরে কাজে? ভাবতে ভাবতে ধোলাইখাল পার হলেন তিনি। রথখোলায় এলেন। মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান পার হওয়ার আগেই শফিউর রহমানের চারপাশের জনস্রোত পরিণত হলো উত্তুঙ্গস্পর্শী মিছিলে। নিয়তির অমোঘ নির্দেশে শফিউর রহমান সেই মিছিলের অভিন্ন অংশে পরিণত হলেন। ঠিক তখনই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে এগিয়ে এল পুলিশ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই গুলি চালাল তারা। সেই গুলিতে বক্ষ বিদীর্ণ হলো শফিউর রহমানের।’ ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে একটু থামেন শফিউর রহমান। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, ‘বাবা শহীদ হওয়ার বৃত্তান্ত বুকে জড়িয়েই জীবনের পথচলা শুরু হলো আমার।’
‘ঢাকায় আসার পর আমার বড় বোন জন্ম নিলেন। মা-বাবা তাঁর নাম রাখলেন শাহনাজ। আশফিয়া খাতুন শাহনাজ। ১৯৫০ সালের ঘটনা এটা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন দানা বেঁধেছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন। এ বছরের শুরুতেই আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হলো। এই কমিটির নেতৃত্বে ১১ মার্চ পালন করা হলো রাষ্ট্রভাষা দিবস। এভাবেই বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ ধরে অতিক্রান্ত হলো ১৯৫০ সাল। ১৯৫১ সালটিও অতিবাহিত হলো ভাষা আন্দোলনের নানা উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৯৫২ সাল এল বাঙালি জাতির জীবনে।’
‘২১ ফেব্রুয়ারি। পূর্ববাংলা বিধান পরিষদের অধিবেশন ছিল সেদিন। অথচ পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনড় ছিল ছাত্ররা। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদের বাধা দিল পুলিশ। আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে পুলিশের সেই বাধা অতিক্রমে সচেষ্ট হলো ছাত্ররা। আন্দোলন-সংগ্রাম ক্রমেই মারমুখী চেহারায় রূপ নিল। পুলিশ গুলি চালাল। মারা গেলেন রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে রইল আবদুস সালামের সংজ্ঞাহীন দেহ। ঘৃণিত এ ঘটনায় ক্রোধে উন্মাতাল হলো দেশ। সেদিন আর কাজে মন বসল না শফিউর রহমানের। বিষণ্ন অন্তঃকরণে হাইকোর্ট থেকে তিনি ফিরে এলেন বাসায়।’
‘পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ভাষাশহীদদের গায়েবি জানাজার কর্মসূচি। জানাজা শেষে জনসমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল। শফিউর রহমান বাড়ি থেকে বের হলেন। প্রাত্যহিক নিয়মেই যাত্রা করলেন অফিসের পথে। কিন্তু সেই পথে আজ অগণন বিক্ষুব্ধ মানুষ। প্রদীপ্ত তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ। ঊর্ধ্বে উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাত, কণ্ঠে তাঁদের বজ্রনিনাদি স্লোগান। এসব এড়িয়ে কী করে অফিসে যাবেন তিনি? কী করে মন বসাবেন বৈচিত্র্যহীন আটপৌরে কাজে? ভাবতে ভাবতে ধোলাইখাল পার হলেন তিনি। রথখোলায় এলেন। মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান পার হওয়ার আগেই শফিউর রহমানের চারপাশের জনস্রোত পরিণত হলো উত্তুঙ্গস্পর্শী মিছিলে। নিয়তির অমোঘ নির্দেশে শফিউর রহমান সেই মিছিলের অভিন্ন অংশে পরিণত হলেন। ঠিক তখনই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে এগিয়ে এল পুলিশ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই গুলি চালাল তারা। সেই গুলিতে বক্ষ বিদীর্ণ হলো শফিউর রহমানের।’ ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে একটু থামেন শফিউর রহমান। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, ‘বাবা শহীদ হওয়ার বৃত্তান্ত বুকে জড়িয়েই জীবনের পথচলা শুরু হলো আমার।’
No comments