তোতাকাহিনী এবং অতঃপর by মামুনুর রশীদ

রবীন্দ্রনাথের 'তোতাকাহিনী' দেখছিলাম মঞ্চে। তোতা পাখিটিকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাজার অভিলাষ পূরণ করতে গিয়ে খাঁচায় আবদ্ধ হলো পাখিটি। তারপর উন্নতির নামে খাঁচাটি শক্তিশালী হতে লাগল। রাজ অমাত্য-পণ্ডিত আর লিপিকরদের বিদ্যার নিপীড়নে একসময় পাখিটি মারা গেল।


কিন্তু রাজা আর তাঁর অনুষদরা এতে আনন্দিত হলো, কারণ বিদ্যা সুসম্পন্ন হয়েছে। শেষে বিষয়টি এমনটাই দাঁড়াল যে যতই পাখি বিদ্যা অর্জন করছে, ততই তার ডাল পালটানো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। সে উড়তে পারছে না ডানা মেলে। এসব লক্ষণের মধ্য দিয়েই একসময় তার বিদ্যা অর্জন সুসম্পন্ন হয় এবং মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।
রবীন্দ্রনাথ পাঠ্য বই ও অপাঠ্য বই নিয়েও বিস্তর লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। তাঁর অসংখ্য রচনার মধ্য দিয়ে তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট করে গেছেন যে বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তোতাকাহিনীর পরিণতিই লাভ করা যাবে, যে কারণে তিনি কখনোই বিদ্যালয়ে যাননি। তাই বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রারম্ভেই তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গুরু-শিষ্য পরম্পরায়, প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণকে সে সময় তিনি আদর্শ ভেবেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সেই শিক্ষাব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় তার তেমন একটা প্রতিফলন ঘটেনি। উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাকেও তিনি উপেক্ষা করেননি। সে জন্য পরবর্তী সময়ে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু একসময় ডিগ্রির প্রয়োজন দেখা দিল, মূলত যার উদ্দেশ্য চাকরি লাভ। তাই বিশ্বভারতীর শিক্ষা সমাপনের পর কোনো একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিতে হতো। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায় এবং কালক্রমে একটি গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়; যদিও শিক্ষার উপরিকাঠামোতে এখনো কিছু পুরনো আচার রয়ে গেছে। সংগীত, চিত্রকলা, নাটক- এসবে নানা ধরনের অনুশীলনের বিষয় রয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে তা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই।
আজকের দিনে শিক্ষাব্যবস্থা যে ভয়ংকর এক রূপ গ্রহণ করেছে, তা প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। শিক্ষার জাতীয়করণ, রাজনৈতিকীকরণ, দলীয়করণ এবং সর্বশেষ বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে সর্বস্বান্ত হতে চলেছে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক, শিক্ষকের উদাসীনতা, পদ ও অর্থের লোভ এক উদগ্র চেহারা পেয়ে গেছে। শিক্ষাদানের পরিবেশ এত সংকুচিত হয়ে গেছে যে কদাচিৎ কোনো বিদ্যালয়ে একটি খেলার মাঠ পাওয়া যায়। শিক্ষার ওপর সরকারের আমলাদের তদারকি এবং ব্যবসায়ী মনোভাবগ্রস্ত শিক্ষকদের সুবিধাবাদী চরিত্র মিলে বিরাজমান ব্যবস্থাটুকুকেও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে শূন্য করে দিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে।
সবচেয়ে বড় সর্বনাশটি হয়েছে, শিক্ষাঙ্গনগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রাজনীতিবিদদের হাতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় একই রকম ঘটনাই ঘটছে। শিক্ষার অর্থ লগি্ন হচ্ছে এবং মুনাফাও ভীষণ রকম। রবীন্দ্রনাথ এক শ বছরের বেশি সময় ধরে যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন, তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি; যে কারণে রাজনীতি চলে গেল অন্য পথে। সাম্প্রদায়িকতার উন্নয়ন তিনি লক্ষ করেছিলেন। তাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তার সূচনা করেন কলকাতার নামোদা মসজিদের ইমামের হাতে রাখি পরিয়ে। বারবার তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করলেও কেউ কর্ণপাত করেনি। ভাগ্যিস ছেচল্লিশ-পরবর্তী ভারতবর্ষকে তিনি রেখে যাননি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে, তাও দেখে যাননি। জাতিরাষ্ট্রকে ধর্মরাষ্ট্র করার যে ষড়যন্ত্র চলবে, তা অবশ্য তিনি আগেই অনুধাবন করেছিলেন।
তিনি নিজে স্বশিক্ষার উজ্জ্বলতম উদাহরণ। নিজের ভাষা তো বটেই, বিদেশি ভাষার ওপরও যে পারদর্শিতা, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
অমলের সংলাপ : আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজার ডাকহরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে, বাঁ হাতে তার লণ্ঠন, কাঁধে তার চিঠির থলি। কত দিন, কত রাত ধরে সে কেবলই নেমে আসছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনার পথ যেখানে ফুরিয়েছে, সেখানে বাঁকা নদীর পথ ধরে সে কেবলই চলে আসছে। নদীর ধারে জোয়ারির ক্ষেত, তারই সরু গলির ভেতর দিয়ে সে কেবল আসছে। তারপরে আখের ক্ষেত, সেই আখের ক্ষেতের পাশ দিয়ে উঁচু আল চলে গিয়েছে, সেই উঁচু আলের ভেতর দিয়ে কেবলই আসছে- রাতদিন একলাটি চলে আসছে; ক্ষেতের মধ্যে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। নদীর ধারে একটি মানুষও নেই, কেবল কাদাখোঁচা লেজ দুলিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি। যতই সে আসছে, দেখছি আমার বুকের ভেতরে ভারি খুশি হয়ে উঠছে।
রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর অনুবাদ করেছেন এ রকম : I can see it there all. The king postman is coming down, a lantern in his left hand and on his back a bag of letters. He is climbing down the hillside so long, days and nights. Where at the foot of mountain the waterfall becomes stream. He takes the footpath on the back and walks through the rye. Then is the sugarcane field. He disappears into the narrow lane cutting through the fall stems of the sugarcane. Then he reaches the open meadow where the cricket chirps. There is no man is to be seen there only the snipes wagging their tails and playing with their bills. I feel he is coming nearer and nearer and I am glad.
মাতৃভাষাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি আক্ষরিক অনুবাদ করেননি। সেই ভাষার মাধুর্য, কাব্যিক রচননীতিকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বা যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে মানুষকে স্বশিক্ষার জন্য প্রণোদনা সৃষ্টি করা; সৃজনশীল, মননশীল মানুষ সৃষ্টি করা। কিন্তু সেই লক্ষ্য কখনোই অর্জিত হওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ জাতীয় কৃষ্টি, অর্থনীতির সঙ্গে সে শিক্ষা বেড়ে ওঠেনি।
রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্ম নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, সে তুলনায় অতি সামান্যই হয়েছে তাঁর শিক্ষাভাবনা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, শিক্ষা নিয়ে তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নিজের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শ্রোতৃমণ্ডলী তা কবির বয়ান হিসেবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু গ্রহণ করেনি।
আজকে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকানো যায়, তাহলে আমরা দেখব, একের পর এক নানা ধরনের নৈরাজ্য এসে গ্রাস করছে, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই বহু আগে শূন্য হয়ে গেছে। উপাচার্য নিয়োগ, উপাচার্যদের শিক্ষক নিয়োগ এবং নানা প্রশাসনিক দুর্নীতির ফলে ছাত্রদের কাছে তাঁদের শ্রদ্ধার আসনটি টলে উঠেছে অনেক আগেই। মাঝখান থেকে অর্থলোভী বিদ্যালয় মালিকরা শিক্ষা-বাণিজ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শিশু থেকে যুবক ছাত্রদের তোতাকাহিনী বানানোর প্রক্রিয়া জোরদার হয়ে উঠেছে। তোতা পাখিটি হয়তো মরছে না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়াটি একেবারেই ধ্বংস করে দিয়ে শিক্ষাটি সুসম্পন্ন হয়েছে।

লেখক : নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যাভিনেতা

No comments

Powered by Blogger.