চালচিত্র-বাংলাদেশের নতুন বিজয় by শুভ রহমান
সারা দেশের মানুষের এবং বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল বিশ্বের তিনটি উন্নত দেশের মহামান্য তিন অতিথির বাংলাদেশে প্রায় যুগপৎ ঝটিকা সফরের প্রতি। ঠিক এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছাড়া অতীতে ঘটেনি। একই সঙ্গে তিন বন্ধু দেশের এত বিরাট সফরের আয়োজন নিঃসন্দেহেই ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের একটি বড় রকম
কূটনৈতিক পারঙ্গমতা ও সাফল্যের পরিচায়ক। দেশ তিনটি আবার ছোটখাটো কোনো দেশ নয়- তিনটি শীর্ষস্থানীয় বন্ধুদেশ- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত। স্বাভাবিকভাবেই এর গুরুত্ব সচরাচর রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বের সফরের চেয়ে অনেক বেশি ও তাৎপর্যময়। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে তাই কোনোভাবে লঘু করে দেখার কোনো উপায় নেই। বস্তুত, দেশে-বিদেশে, গণমাধ্যমে, সর্বমহলেও সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিন বিশ্ব মহারথের এই সফর আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে এবং হয়তো আরো হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি- তিনজনই তাঁদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনজনই প্রায় রাষ্ট্রপ্রধানের গুরুত্বই বহন করেন। সেদিক থেকে তাঁদের যথাযথ প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও প্রাপ্য সম্মান প্রদান ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও তা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্যই এই সফর থেকে অনেক প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেছে এবং আমাদের ধারণা, তা বহুলাংশে পেয়েছেও।
আমরা এই প্রত্যাশিত প্রাপ্তিকে বাংলাদেশের একটি নতুন বিজয় হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও ধারণা, সমুদ্রজয়ের পর বাংলাদেশ একটা নতুন বিজয় অর্জন করেছে। কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আর তার আগের অবস্থানে নেই। নতুন অবস্থান যেমন জনগণকে, তেমনি সরকার ও বিরোধী দলকে সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশের এই অর্জন এক হিসেবে সমুদ্র বিজয়ের চেয়েও মহৎ ও বৃহৎ অর্জন- চেতনাগত, ভাবগত, রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শগত দিক থেকে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ কথাগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ও সে অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশের আর কোনোভাবেই আগের মতো চললে হবে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর যেমন কথায় কথায় দমনপীড়ন, জেল-জুলুম চালানো যাবে না, সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে, তেমনি প্রতিপক্ষেরও হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক সব পথই পরিহার করতে হবে, শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে অভিন্ন জাতীয় ও মৌলিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হবে। বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময় যে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে, তাকে সত্যিকার অর্থবহ ও কার্যকর করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। জাতীয় সংসদকে সব রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে। এ কথাগুলো আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কথার কথা হিসেবে বলে আসছি, তিন বিশ্বব্যক্তিত্বের সফরের ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা- এ কথাগুলো এবার বাংলাদেশে গতিশীল ও জীবন্ত, বাস্তব রূপ নেবে। তিনজনই বস্তুত সে আলোকেই বক্তব্য রেখে গেছেন।
সাধারণ মানুষ সত্যিই এখন আর কোনোভাবেই দেখতে চাইবে না যে, বিরোধী দল আগের মতো জ্বালাও-পোড়াও, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ গ্রহণ করেছে, জাতীয়, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করছে, দেশের ভবিষ্যৎ তথা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাসূচি ও শিক্ষা কার্যক্রমকে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে বাধাগ্রস্ত করছে, খুদে ব্যবসায়ী ও দিনমজুরদের রুটিরুজির প্রতি ভ্রূক্ষেপহীন থেকে হরতালের পর হরতাল দিয়ে চলেছে। হরতালে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে মসীলিপ্ত ও ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। অতীতের সে ধারা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত ও নিন্দিত হবে নতুন বাংলাদেশে।
এটা ঠিক নয় যে, যে তিন মহারথী- যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করে নতুন কিছু বলেছেন না, নতুন কিছুই তাঁরা বলেননি। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে সুস্থ, বিবেকবান, সচেতন মানুষ যে কথাগুলো বলে আসছেন- তাঁরা বস্তুত তাঁদের নিজস্ব রীতিতে সেসব কথাই বলে গেলেন। গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হবে। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে অমীমাংসিত সব সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতবিরোধ দূর করতে হবে। এগুলো তো শাসক মহাজোটেরও প্রচেষ্টা ছিল। বাড়তি কিছু দেওয়ার মধ্যে তিস্তার পানির হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে হিলারির মমতাকে বোঝানোর কথা রয়েছে। আর প্রণবের দিক থেকে হয়েছে ভারতের ঋণের শর্ত শিথিল, টিপাইমুখ ও তিস্তার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি না হওয়ার বড় রকম প্রতিশ্রুতি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ করে দু'দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অংশীদারি সংলাপ চালানোর কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাবনায় একটা নতুন আবহই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। সেটাই বাংলাদেশের নতুন একটি অর্জন। এতকাল তা অর্জিত হয়নি।
বিশ্ব ইতিহাসেও বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক এখন সম্পূর্ণ নতুন চেহারা নেবে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আজও নিহিত থাকলেও সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়- এই ঘোষিত বাহ্যিক নীতিই অনুসৃত হচ্ছে বলে কূটনৈতিক শিষ্টাচারে ধরে নেওয়া হয়। ভিয়েতনাম ২৫ বছর মহাপরাক্রমশালী ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়েছে- কিন্তু তারপর ভিয়েতনামের দুই অংশের স্বাধীনতা অর্জনের ও একত্রীকরণের পর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি তাকে সেই পুরনো শত্রুর সঙ্গেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে কূটনৈতিক মিত্রতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার কূটনৈতিক প্রজ্ঞাই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে সাবেক পাশ্চাত্য শত্রু দেশগুলোকেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে সহায়ক হয়েছে। ভারত সুদীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের পদানত থেকেও আজ সমমর্যাদার ভিত্তিতে ব্রিটিশ, মার্কিন, সব পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই সমমর্যাদার বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসকদেরও বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উত্থান-পতন ও কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসার পর আজ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ার দক্ষতা ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ভারত বা জাপানের মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক রাষ্ট্রও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র, অনুন্নত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সমান মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছে অকুণ্ঠচিত্তে। এটাই বাংলাদেশের নতুন বিজয়।
আজ যারা এ বিজয়ের তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে এবং পুরনো, পরিত্যজ্য পন্থাই অবলম্বন করে, পুরনো ঘৃণ্য মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে, হাজার বছরের পশ্চাৎপদ মৌলবাদী ও সামন্ত ধ্যানধারণা ও ভাবাদর্শ সম্বল করে সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল করতে চাইবে- তাদের স্থান অনিবার্যভাবেই হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে, আর কোথাও নয়।
০৭.০৫.২০১২
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি- তিনজনই তাঁদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনজনই প্রায় রাষ্ট্রপ্রধানের গুরুত্বই বহন করেন। সেদিক থেকে তাঁদের যথাযথ প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও প্রাপ্য সম্মান প্রদান ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও তা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্যই এই সফর থেকে অনেক প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেছে এবং আমাদের ধারণা, তা বহুলাংশে পেয়েছেও।
আমরা এই প্রত্যাশিত প্রাপ্তিকে বাংলাদেশের একটি নতুন বিজয় হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও ধারণা, সমুদ্রজয়ের পর বাংলাদেশ একটা নতুন বিজয় অর্জন করেছে। কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আর তার আগের অবস্থানে নেই। নতুন অবস্থান যেমন জনগণকে, তেমনি সরকার ও বিরোধী দলকে সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশের এই অর্জন এক হিসেবে সমুদ্র বিজয়ের চেয়েও মহৎ ও বৃহৎ অর্জন- চেতনাগত, ভাবগত, রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শগত দিক থেকে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ কথাগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ও সে অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশের আর কোনোভাবেই আগের মতো চললে হবে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর যেমন কথায় কথায় দমনপীড়ন, জেল-জুলুম চালানো যাবে না, সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে, তেমনি প্রতিপক্ষেরও হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক সব পথই পরিহার করতে হবে, শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে অভিন্ন জাতীয় ও মৌলিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হবে। বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময় যে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে, তাকে সত্যিকার অর্থবহ ও কার্যকর করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। জাতীয় সংসদকে সব রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে। এ কথাগুলো আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কথার কথা হিসেবে বলে আসছি, তিন বিশ্বব্যক্তিত্বের সফরের ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা- এ কথাগুলো এবার বাংলাদেশে গতিশীল ও জীবন্ত, বাস্তব রূপ নেবে। তিনজনই বস্তুত সে আলোকেই বক্তব্য রেখে গেছেন।
সাধারণ মানুষ সত্যিই এখন আর কোনোভাবেই দেখতে চাইবে না যে, বিরোধী দল আগের মতো জ্বালাও-পোড়াও, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ গ্রহণ করেছে, জাতীয়, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করছে, দেশের ভবিষ্যৎ তথা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাসূচি ও শিক্ষা কার্যক্রমকে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে বাধাগ্রস্ত করছে, খুদে ব্যবসায়ী ও দিনমজুরদের রুটিরুজির প্রতি ভ্রূক্ষেপহীন থেকে হরতালের পর হরতাল দিয়ে চলেছে। হরতালে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে মসীলিপ্ত ও ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। অতীতের সে ধারা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত ও নিন্দিত হবে নতুন বাংলাদেশে।
এটা ঠিক নয় যে, যে তিন মহারথী- যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করে নতুন কিছু বলেছেন না, নতুন কিছুই তাঁরা বলেননি। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে সুস্থ, বিবেকবান, সচেতন মানুষ যে কথাগুলো বলে আসছেন- তাঁরা বস্তুত তাঁদের নিজস্ব রীতিতে সেসব কথাই বলে গেলেন। গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হবে। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে অমীমাংসিত সব সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতবিরোধ দূর করতে হবে। এগুলো তো শাসক মহাজোটেরও প্রচেষ্টা ছিল। বাড়তি কিছু দেওয়ার মধ্যে তিস্তার পানির হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে হিলারির মমতাকে বোঝানোর কথা রয়েছে। আর প্রণবের দিক থেকে হয়েছে ভারতের ঋণের শর্ত শিথিল, টিপাইমুখ ও তিস্তার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি না হওয়ার বড় রকম প্রতিশ্রুতি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ করে দু'দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অংশীদারি সংলাপ চালানোর কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাবনায় একটা নতুন আবহই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। সেটাই বাংলাদেশের নতুন একটি অর্জন। এতকাল তা অর্জিত হয়নি।
বিশ্ব ইতিহাসেও বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক এখন সম্পূর্ণ নতুন চেহারা নেবে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আজও নিহিত থাকলেও সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়- এই ঘোষিত বাহ্যিক নীতিই অনুসৃত হচ্ছে বলে কূটনৈতিক শিষ্টাচারে ধরে নেওয়া হয়। ভিয়েতনাম ২৫ বছর মহাপরাক্রমশালী ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়েছে- কিন্তু তারপর ভিয়েতনামের দুই অংশের স্বাধীনতা অর্জনের ও একত্রীকরণের পর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি তাকে সেই পুরনো শত্রুর সঙ্গেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে কূটনৈতিক মিত্রতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার কূটনৈতিক প্রজ্ঞাই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে সাবেক পাশ্চাত্য শত্রু দেশগুলোকেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে সহায়ক হয়েছে। ভারত সুদীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের পদানত থেকেও আজ সমমর্যাদার ভিত্তিতে ব্রিটিশ, মার্কিন, সব পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই সমমর্যাদার বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসকদেরও বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উত্থান-পতন ও কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসার পর আজ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ার দক্ষতা ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ভারত বা জাপানের মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক রাষ্ট্রও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র, অনুন্নত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সমান মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছে অকুণ্ঠচিত্তে। এটাই বাংলাদেশের নতুন বিজয়।
আজ যারা এ বিজয়ের তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে এবং পুরনো, পরিত্যজ্য পন্থাই অবলম্বন করে, পুরনো ঘৃণ্য মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে, হাজার বছরের পশ্চাৎপদ মৌলবাদী ও সামন্ত ধ্যানধারণা ও ভাবাদর্শ সম্বল করে সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল করতে চাইবে- তাদের স্থান অনিবার্যভাবেই হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে, আর কোথাও নয়।
০৭.০৫.২০১২
No comments