অরণ্যে রোদন-কাজী কামালের হাতঘড়ি by আনিসুল হক
কাজী কামাল ছিলেন বাস্কেটবল খেলোয়াড়। পূর্ব পাকিস্তান দলেই জায়গা হয়েছিল তাঁর। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন। একাত্তর সালে তাঁর বয়স ছিল বছর পঁচিশেক। তিনি যুদ্ধে যাবেন। আগরতলা গিয়ে ট্রেনিং নেবেন। তাঁর যাওয়ার কথা ফতেহ চৌধুরীর সঙ্গে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের খানিকক্ষণ পরে তিনি যান ফতেহ চৌধুরীর বাসায়। ফতেহ চৌধুরী নয়, তাঁর ভাই শাহাদত চৌধুরীর দেখা পান।
শাহাদত বলেন, ‘ওরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষে রওনা দিয়ে দিল। এখনো যাও সদরঘাটের দিকে। মতলবের লঞ্চে খোঁজ করো।’
কাজী কামাল ছুটলেন সদরঘাটের দিকে। সদরঘাটে গিয়ে তিনি দেখা পান ফতেহ চৌধুরীর। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন তরুণ। তাঁরা সবাই যাচ্ছেন মেজর খালেদ মোশাররফের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে।
ফতেহ বলেন, ‘এসেছ ভালো করেছ। কিন্তু যারা যাচ্ছে সবাই ১৭০ টাকা করে জমা দিচ্ছে পথখরচ হিসেবে। তুমি যেতে চাইলে তোমাকেও ১৭০ টাকা জমা দিতে হবে।’
কাজী কামাল মুশকিলে পড়েন। কারণ তাঁর পকেটে টাকা নেই।
‘তাহলে তোমার যাওয়া হবে না।’ তাঁরা জানিয়ে দেন।
‘এক মিনিট, আমি আসছি’ বলে কাজী কামাল লঞ্চ থেকে নেমে পড়েন, একটু পরে ফিরে আসেন হাতে টাকা নিয়ে।
‘নাও। তোমাদের ১৭০ টাকা।’ কাজী কামাল হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর হাতে টাকা।
‘কই পেলে?’
কাজী কামাল জানান, তিনি তাঁর বাবার দেওয়া হাতঘড়িটা বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন সদরঘাটের ফুটপাতে।
কাজী কামালেরা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে ঢাকা শহরে এবং এর আশপাশের এলাকায় অনেকগুলো বীরত্বপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিলেন তাঁরা। সেসবের অনেকগুলোর বর্ণনা আমরা পাব জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে। তাঁর সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের লেখা ব্রেভ অফ হার্ট গ্রন্থে পাব বিস্তারিত। ব্রেভ অব হার্ট বই অবলম্বন করে ১৯৭১ সালের ঢাকার একটা সন্ধ্যার বর্ণনা খানিকটা তুলে ধরছি।
২৫ আগস্ট। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়েছেন অভিযানে। তাঁরা একটা মাজদা গাড়ি হাইজাক করেছেন। গাড়িটা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কালভার্ট পেরিয়ে ডানে ঘুরল।
ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কে সাত-আটজন পাকিস্তানি সেনা প্রহরারত। সম্ভবত কোনো আর্মি অফিসারের বাড়ি। সেনারা বেশ অসতর্ক অবস্থায় আছে।
গাড়ির পেছনে বসে আছেন বদি আর কাজী কামাল। তাঁদের হাতে স্টেনগান।
গাড়িটা ওই বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে নীরবে গতি কমিয়ে দিল। হাবিবুল আলম বললেন, ‘ফায়ার।’
গর্জে উঠল বদি আর কাজী কামালের হাতের স্টেনগান।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেনারা লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়।
ওই আক্রমণ পরিচালনা করেই তাঁরা নিরস্ত হলেন না। তাঁরা এগিয়ে গেলেন মিরপুর রোডের দিকে। সেখানে সেনারা এরই মধ্যে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি চেক করতে শুরু করেছে। সেখানে গোটা দুই মিলিটারি ট্রাক ও একটা জিপ দাঁড় করিয়ে রাখা।
তাঁদের গাড়ি সেই সেনা তল্লাশির কাছে যেতেই সেনারা অর্ডার করল, হল্ট। এবং ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠল কাজী কামাল, বদি, স্বপন, রুমিদের অস্ত্র।
পাল্টা আক্রমণের আগেই তাঁদের গাড়ি ছুটছে। কিন্তু পেছনে ধাওয়া করল আর্মি জিপ...
পুরো বর্ণনাটা যদি হাবিবুল আলমের বইয়ে পাঠ করেন, তাহলে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাবেই।
এ রকম অনেকগুলো অপারেশনে অংশ নিয়েছেন কাজী কামাল। হাবিবুল আলম বীর প্রতীক তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘কাজী কামাল ছিলেন ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল তারকা। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন কাজী ভাই। তার একটা গুণ সবাইকে আকৃষ্ট করত। তিনি কখনও পেছনের দিকে তাকাতেন না। তিনি কখনও হতোদ্যম হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন না। যখনই দরকার পড়ত, তিনি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন। তিনি ছিলেন অসমসাহসী, যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলেন।’
আমার মা বইয়ের আজাদের ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন কাজী কামাল। ১৯৭১ সালে ৩০ আগস্ট রাতে আজাদদের বাড়িতেই ছিলেন তাঁরা। বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা সে রাতে ছিলেন আজাদদের বাড়িতে। ছিলেন ক্রিকেট খেলোয়াড় মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল...মাথার কাছে কাজী কামালের পিস্তলটা নিয়ে। কাজী কামাল ছিলেন শুধু লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়। গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে বাড়িটা। দরজায় আঘাত করে। সেনারা ভেতরে ঢুকে জুয়েলের জখমি হাতে আঘাত করলে কাজী কামাল পাকিস্তানি মেজরের হাত থেকে স্টেনগান কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। গুলি বেরিয়ে যায়। আজাদের চাচাতো ভাই জায়েদ ও টগর গুলিবিদ্ধ হন। কাজী কামালের পরনের লুঙ্গি খুলে গেলে সুতোহীন শরীরে কাজী কামাল ওই বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
আজাদ, জুয়েল, বাশার যাঁরা ওই বাড়িতে ধরা পড়েন, তাঁরা আর ফিরে আসেননি।
কিন্তু কাজী কামাল ১৫ জানুয়ারি ২০১২ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
মা বইটা লেখার সময় আমি কাজী কামালের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁর সাক্ষাৎকার নিই। এই রকম দিলদরিয়া মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টা দেখেছি বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ হো হো করে হাসেন।
আমাকে পরে বলেছেন, ‘আরে মিয়া, আমি তো ভাবছি তুমি সাংবাদিক, কী চাকরি করো না করো, খাইতে টাইতে পাও না, তোমারে কিছু সাহায্য করুম। তো তুমি দেখি ভালোই আছ। তোমার তো সাহায্যর দরকার নাই মনে হইতাছে।’
তিনি প্রায়ই প্রথম আলোয় আসতেন। নিজের জন্য নয়। তাঁর বন্ধুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে। আসল উদ্দেশ্য বন্ধুকে সহায়তা করা। শেষের দিকে তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়ল। কিডনিতে সমস্যা। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। এই অবস্থায় কিছুদিন আগে আবার প্রথম আলোয় এলেন তিনি। আমাকে বললেন, ‘বারাইছিলাম ডায়ালাইসিস করাইতে। করাইলাম, তারপর ভাবলাম তোমার লগে দেখা কইরা যাই। শুনো, আমার ছেলেরে কইবা না, একটা মহিলা বাসাভাড়া দিতে পারতাছে না। আমারে খুব ধরছে। দুই মাসের বাসাভাড়া বাকি। আমার এই অবস্থায় কেমনে আমি তারে সাহায্য করি। আমার ছেলে জানলে খুব রাগ করব।’
আমি বললাম, ‘আপনি যান, টাকাটা জোগাড় করি। আমি ওই মহিলার কাছে দুই মাসের ভাড়া পাঠায়ে দেব।’
‘শোনো, তুমি কিন্তু ধার দিতাছ। আগে কও ফেরত লইবা?’
আমি বলি, ‘কামাল ভাই, আপনার শরীর খারাপ। ডায়ালাইসিস করে এসেছেন। এত কথা বলার দরকার নাই তো। মহিলার ঠিকানা দেন। আমি টাকাটা জোগাড় করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
তিনি চলে গেলেন।
আমি বিস্মিত। ডায়ালাইসিস সেরে এসেছেন, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। আর তিনি পরোপকার ব্রতে বেরিয়েছেন।
আমার সঙ্গে কিছুদিন আগেও তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। মা বইটার ইংরেজি অনুবাদ বেরুচ্ছে দিল্লি থেকে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদক আমাকে ই-মেইলে প্রশ্ন করেছেন, ‘সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আজাদ রোজ নতুন নতুন কাপড় পরে যেত, এটা কী করে হয়? ইউনিফর্ম ছিল না?’
আমার সূত্র তো কাজী কামাল। আমি ফোন করলাম তাঁকে। কাজী কামাল বললেন, ‘না না, ছোটবেলায় আমরা ইউনিফর্ম পরে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে যাইনি। ’
আমি বললাম, ‘কেমন আছেন?’
উনি বললেন, ‘জানো না মিয়া, আমার তো ক্যানসার। হা হা হা।’ বলেই তিনি তার সেই ভুবন-কাঁপানো হাসিটা দিলেন।কাজী কামাল উদ্দীন বীর বিক্রমের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সিয়ামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তিনি ব্যবসা করছেন এবং ভালো করছেন। বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব ছেলে যত্নের সঙ্গেই পালন করছিলেন।
গত পরশু বিকেলে সিয়াম ফোন করে বললেন, ‘চাচা, আব্বা কিন্তু আর তিন চার দিনের বেশি সারভাইভ করবেন বলে ডাক্তাররা আশা করছেন না।’
‘কোন হাসপাতালে আছেন?’
‘ইউনাইটেড।’
‘আচ্ছা।’
আমি ভাবলাম, যাব। দেখা করে আসব। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফোন। ‘চাচা, আব্বা আর নাই।’
আমি ভাবছি কাজী কামালের সেই শখের ঘড়িটার কথা। যে ঘড়িটা তাঁর আব্বা তাঁকে দিয়েছিলেন। যেটা তিনি দেশের জন্য অবলীলায় ২৫ বছর বয়সে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। আর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতেও যিনি পরোপকারের জন্য আমার অফিস পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন।
আসলে নিজের জীবনটাকেই কি এই মুক্তিযোদ্ধারা উৎসর্গ করে রাখেননি? কাজী কামালের সহযোদ্ধারা, বদিউল আলম, রুমী, জুয়েল, আজাদ, বাকী... কতজনই তো ওই একাত্তরেই আর ঘরে ফেরেননি। কাজী কামাল তাঁর সাহস আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
আজ কাজী কামাল চললেন তাঁর শহীদ সহযোদ্ধাদের দেশে।
তাঁকে লাল সালাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কাজী কামাল ছুটলেন সদরঘাটের দিকে। সদরঘাটে গিয়ে তিনি দেখা পান ফতেহ চৌধুরীর। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন তরুণ। তাঁরা সবাই যাচ্ছেন মেজর খালেদ মোশাররফের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে।
ফতেহ বলেন, ‘এসেছ ভালো করেছ। কিন্তু যারা যাচ্ছে সবাই ১৭০ টাকা করে জমা দিচ্ছে পথখরচ হিসেবে। তুমি যেতে চাইলে তোমাকেও ১৭০ টাকা জমা দিতে হবে।’
কাজী কামাল মুশকিলে পড়েন। কারণ তাঁর পকেটে টাকা নেই।
‘তাহলে তোমার যাওয়া হবে না।’ তাঁরা জানিয়ে দেন।
‘এক মিনিট, আমি আসছি’ বলে কাজী কামাল লঞ্চ থেকে নেমে পড়েন, একটু পরে ফিরে আসেন হাতে টাকা নিয়ে।
‘নাও। তোমাদের ১৭০ টাকা।’ কাজী কামাল হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর হাতে টাকা।
‘কই পেলে?’
কাজী কামাল জানান, তিনি তাঁর বাবার দেওয়া হাতঘড়িটা বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন সদরঘাটের ফুটপাতে।
কাজী কামালেরা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে ঢাকা শহরে এবং এর আশপাশের এলাকায় অনেকগুলো বীরত্বপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিলেন তাঁরা। সেসবের অনেকগুলোর বর্ণনা আমরা পাব জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে। তাঁর সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের লেখা ব্রেভ অফ হার্ট গ্রন্থে পাব বিস্তারিত। ব্রেভ অব হার্ট বই অবলম্বন করে ১৯৭১ সালের ঢাকার একটা সন্ধ্যার বর্ণনা খানিকটা তুলে ধরছি।
২৫ আগস্ট। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়েছেন অভিযানে। তাঁরা একটা মাজদা গাড়ি হাইজাক করেছেন। গাড়িটা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কালভার্ট পেরিয়ে ডানে ঘুরল।
ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কে সাত-আটজন পাকিস্তানি সেনা প্রহরারত। সম্ভবত কোনো আর্মি অফিসারের বাড়ি। সেনারা বেশ অসতর্ক অবস্থায় আছে।
গাড়ির পেছনে বসে আছেন বদি আর কাজী কামাল। তাঁদের হাতে স্টেনগান।
গাড়িটা ওই বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে নীরবে গতি কমিয়ে দিল। হাবিবুল আলম বললেন, ‘ফায়ার।’
গর্জে উঠল বদি আর কাজী কামালের হাতের স্টেনগান।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেনারা লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়।
ওই আক্রমণ পরিচালনা করেই তাঁরা নিরস্ত হলেন না। তাঁরা এগিয়ে গেলেন মিরপুর রোডের দিকে। সেখানে সেনারা এরই মধ্যে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি চেক করতে শুরু করেছে। সেখানে গোটা দুই মিলিটারি ট্রাক ও একটা জিপ দাঁড় করিয়ে রাখা।
তাঁদের গাড়ি সেই সেনা তল্লাশির কাছে যেতেই সেনারা অর্ডার করল, হল্ট। এবং ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠল কাজী কামাল, বদি, স্বপন, রুমিদের অস্ত্র।
পাল্টা আক্রমণের আগেই তাঁদের গাড়ি ছুটছে। কিন্তু পেছনে ধাওয়া করল আর্মি জিপ...
পুরো বর্ণনাটা যদি হাবিবুল আলমের বইয়ে পাঠ করেন, তাহলে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাবেই।
এ রকম অনেকগুলো অপারেশনে অংশ নিয়েছেন কাজী কামাল। হাবিবুল আলম বীর প্রতীক তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘কাজী কামাল ছিলেন ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল তারকা। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন কাজী ভাই। তার একটা গুণ সবাইকে আকৃষ্ট করত। তিনি কখনও পেছনের দিকে তাকাতেন না। তিনি কখনও হতোদ্যম হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন না। যখনই দরকার পড়ত, তিনি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন। তিনি ছিলেন অসমসাহসী, যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলেন।’
আমার মা বইয়ের আজাদের ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন কাজী কামাল। ১৯৭১ সালে ৩০ আগস্ট রাতে আজাদদের বাড়িতেই ছিলেন তাঁরা। বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা সে রাতে ছিলেন আজাদদের বাড়িতে। ছিলেন ক্রিকেট খেলোয়াড় মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল...মাথার কাছে কাজী কামালের পিস্তলটা নিয়ে। কাজী কামাল ছিলেন শুধু লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়। গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে বাড়িটা। দরজায় আঘাত করে। সেনারা ভেতরে ঢুকে জুয়েলের জখমি হাতে আঘাত করলে কাজী কামাল পাকিস্তানি মেজরের হাত থেকে স্টেনগান কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। গুলি বেরিয়ে যায়। আজাদের চাচাতো ভাই জায়েদ ও টগর গুলিবিদ্ধ হন। কাজী কামালের পরনের লুঙ্গি খুলে গেলে সুতোহীন শরীরে কাজী কামাল ওই বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
আজাদ, জুয়েল, বাশার যাঁরা ওই বাড়িতে ধরা পড়েন, তাঁরা আর ফিরে আসেননি।
কিন্তু কাজী কামাল ১৫ জানুয়ারি ২০১২ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
মা বইটা লেখার সময় আমি কাজী কামালের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁর সাক্ষাৎকার নিই। এই রকম দিলদরিয়া মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টা দেখেছি বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ হো হো করে হাসেন।
আমাকে পরে বলেছেন, ‘আরে মিয়া, আমি তো ভাবছি তুমি সাংবাদিক, কী চাকরি করো না করো, খাইতে টাইতে পাও না, তোমারে কিছু সাহায্য করুম। তো তুমি দেখি ভালোই আছ। তোমার তো সাহায্যর দরকার নাই মনে হইতাছে।’
তিনি প্রায়ই প্রথম আলোয় আসতেন। নিজের জন্য নয়। তাঁর বন্ধুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে। আসল উদ্দেশ্য বন্ধুকে সহায়তা করা। শেষের দিকে তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়ল। কিডনিতে সমস্যা। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। এই অবস্থায় কিছুদিন আগে আবার প্রথম আলোয় এলেন তিনি। আমাকে বললেন, ‘বারাইছিলাম ডায়ালাইসিস করাইতে। করাইলাম, তারপর ভাবলাম তোমার লগে দেখা কইরা যাই। শুনো, আমার ছেলেরে কইবা না, একটা মহিলা বাসাভাড়া দিতে পারতাছে না। আমারে খুব ধরছে। দুই মাসের বাসাভাড়া বাকি। আমার এই অবস্থায় কেমনে আমি তারে সাহায্য করি। আমার ছেলে জানলে খুব রাগ করব।’
আমি বললাম, ‘আপনি যান, টাকাটা জোগাড় করি। আমি ওই মহিলার কাছে দুই মাসের ভাড়া পাঠায়ে দেব।’
‘শোনো, তুমি কিন্তু ধার দিতাছ। আগে কও ফেরত লইবা?’
আমি বলি, ‘কামাল ভাই, আপনার শরীর খারাপ। ডায়ালাইসিস করে এসেছেন। এত কথা বলার দরকার নাই তো। মহিলার ঠিকানা দেন। আমি টাকাটা জোগাড় করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
তিনি চলে গেলেন।
আমি বিস্মিত। ডায়ালাইসিস সেরে এসেছেন, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। আর তিনি পরোপকার ব্রতে বেরিয়েছেন।
আমার সঙ্গে কিছুদিন আগেও তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। মা বইটার ইংরেজি অনুবাদ বেরুচ্ছে দিল্লি থেকে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদক আমাকে ই-মেইলে প্রশ্ন করেছেন, ‘সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আজাদ রোজ নতুন নতুন কাপড় পরে যেত, এটা কী করে হয়? ইউনিফর্ম ছিল না?’
আমার সূত্র তো কাজী কামাল। আমি ফোন করলাম তাঁকে। কাজী কামাল বললেন, ‘না না, ছোটবেলায় আমরা ইউনিফর্ম পরে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে যাইনি। ’
আমি বললাম, ‘কেমন আছেন?’
উনি বললেন, ‘জানো না মিয়া, আমার তো ক্যানসার। হা হা হা।’ বলেই তিনি তার সেই ভুবন-কাঁপানো হাসিটা দিলেন।কাজী কামাল উদ্দীন বীর বিক্রমের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সিয়ামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তিনি ব্যবসা করছেন এবং ভালো করছেন। বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব ছেলে যত্নের সঙ্গেই পালন করছিলেন।
গত পরশু বিকেলে সিয়াম ফোন করে বললেন, ‘চাচা, আব্বা কিন্তু আর তিন চার দিনের বেশি সারভাইভ করবেন বলে ডাক্তাররা আশা করছেন না।’
‘কোন হাসপাতালে আছেন?’
‘ইউনাইটেড।’
‘আচ্ছা।’
আমি ভাবলাম, যাব। দেখা করে আসব। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফোন। ‘চাচা, আব্বা আর নাই।’
আমি ভাবছি কাজী কামালের সেই শখের ঘড়িটার কথা। যে ঘড়িটা তাঁর আব্বা তাঁকে দিয়েছিলেন। যেটা তিনি দেশের জন্য অবলীলায় ২৫ বছর বয়সে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। আর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতেও যিনি পরোপকারের জন্য আমার অফিস পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন।
আসলে নিজের জীবনটাকেই কি এই মুক্তিযোদ্ধারা উৎসর্গ করে রাখেননি? কাজী কামালের সহযোদ্ধারা, বদিউল আলম, রুমী, জুয়েল, আজাদ, বাকী... কতজনই তো ওই একাত্তরেই আর ঘরে ফেরেননি। কাজী কামাল তাঁর সাহস আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
আজ কাজী কামাল চললেন তাঁর শহীদ সহযোদ্ধাদের দেশে।
তাঁকে লাল সালাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments