ক্যাম্পাসের জীবন ও মৃত্যু-জুবায়েরের দৃশ্য ও অদৃশ্য ঘাতকেরা by ফারুক ওয়াসিফ

কিছুদিন পর জাবির ছাত্র জুবায়েরের কবরে ঘাস গজাবে, মিডিয়ার নজর তত দিনে চলে যাবে অন্য কোনো হত্যাকাণ্ডের দিকে। শোক-ক্রোধ- প্রতিবাদের উপলক্ষের অভাব ঘটবে না সোনার বাংলায়। এসব উৎপাদনের কারখানাগুলোও পুরোদমে চলতে থাকবে; আমরা শোকার্ত ও প্রতিবাদী হতেই থাকব। কিন্তু দিন বদলাবে না।


কিন্তু জুবায়েরের দৃশ্যমান মৃতদেহ আর অদৃশ্য খুনিদের নিয়ে আমরা কী করব? তদন্ত প্রতিবেদনে লেখা হবে—নৃশংস খুন একটা হয়েছে বটে, কিন্তু খুনি শনাক্ত হয়নি। যেমন প্রায় দুই বছর পরও ঢাবির ছাত্র আবুবকরের খুনিরা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ১৯৯৯ সালে জাবির ছাত্র আনন্দ, এর আগের দীপু কিংবা আরও আগের কবীরের খুনিদের গায়েবি জগতে নাম লেখাবে নতুন খুনিরাও।
বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ নৈতিকতার প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের শিক্ষা দিল: ক্যাম্পাসে খুনিরা সম্পূর্ণ দায়মুক্ত, আইনি চক্ষু বা পুলিশি হাত তাদের দেখতে বা ধরতে পারবে না। এভাবেই রোপিত হলো সম্ভাব্য আরও হত্যাকাণ্ডের এবং সেসবের দায়মুক্তির বীজ। যেমন করে অতীতের অপরাধের দায়মুক্তির সোপান দিয়েই ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল জুবায়েরের খুনিরা।
জুবায়ের হত্যার দ্বিতীয় দিকটি হলো বর্বরতা। সবার চোখের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে, প্রকাশ্য জায়গায়, খোলা আকাশের নিচে ঘণ্টা খানেক সময় নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মাথার খুলি থেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রড দিয়ে ভাঙা, পেটের কাছে কয়েক জায়গায় এফোঁড়-ওফোঁড় করা হয়। তাঁর দেহে অজস্র ক্ষতস্থান বানানো হয়। সেই ক্ষত দিয়েই রক্ত চুইয়ে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে ছেলেটি মারা যায়। পাঠক, নিজের শরীরের ওপর এমন বর্বরতার ফল চিন্তা করুন; কিংবা ভাবুন আপনার আপনজনের সঙ্গে এমনটাই করা হয়েছে, অথবা সেই বর্বর হত্যার দৃশ্যে আপনিও দর্শক হিসেবে উপস্থিত এমন কল্পনা করুন; তারপর বলুন জুবায়ের কত ডিগ্রির বর্বরতার শিকার? আপনার সন্তান, আপনার ভাই, আপনার বন্ধু বা আপনার সহপাঠী বা আত্মীয় বা প্রতিবেশীর হাত দিয়ে এমন বর্বরতা ঘটলে, সেই হাতে কি আপনি হাত মেলাবেন? তাদের স্বীকার করবেন আপনার সন্তান, আপনার ভাই, আপনার বন্ধু বা আপনার সহপাঠী বা আত্মীয় বা প্রতিবেশী হিসেবে?
কে কী করবেন জানি না, কিন্তু জুবায়েরের হত্যাকারীদের রক্ষার চেষ্টায় কোনো কসুর করেনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপাচার্য মহাশয়ের প্রথম উক্তিই ছিল ‘ছাত্রলীগ এ কাজ করতে পারে বিশ্বাস করি না’। প্রতিদানে শোকাহত ও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের অবরোধ থেকে ‘ভিসি তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ নামধারীরা তাঁকে ‘উদ্ধার’ করে। তিনি বলেছেন জাবিতে ছাত্রলীগের কমিটি নেই, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও তা সমর্থন করেছে। কিন্তু মাননীয় উপাচার্য ৩১ জানুয়ারি, ২০১১ তারিখে জাবি ক্যাম্পাসে আয়োজিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তাহলে আপনি কেন গিয়েছিলেন? কাকে সেখানে কেক খাওয়াচ্ছিলেন? তিনি কি ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আসগর আলী নন? জুবায়ের হত্যায় আসগর আলীএবং তাঁর কর্মীরা জড়িত বলেই তো অভিযোগ।
যে তিনজন ছাত্রলীগ কর্মী খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত, উপাচার্য তাঁদের সাময়িক বহিষ্কার করে তাঁদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। পরে আন্দোলনের চাপে চিরতরে বহিষ্কার করেন। কিন্তু এত দিন এরাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের হাতকে শক্তিশালী করে এসেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করেছে। ছিনতাই, সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি করেও তারা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছে, তাই না? এই প্রশ্ন তাই জাগবেই, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো লাগামছাড়া স্বাধীনতা যে গুটি কয়েক ছাত্র উপভোগ করছিল, সেই স্বাধীনতা তাদের কে দিয়েছিল? জুবায়েরের দুই চিহ্নিত খুনিকে তো সদ্য পদত্যাগ করা প্রক্টরই মাইক্রোবাসে করে সশস্ত্র অবস্থায় হলে তুলে দিতে চেয়েছিলেন!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরম অভিভাবক উপাচার্য এবং তাঁর সমর্থক শিক্ষকেরা এমন এক প্রশাসনিক পদ্ধতি জারি রেখেছেন, যার আনুকূল্যে এমন ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদ্ধতিগত দায় অস্বীকার করা যায় না। উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বলে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু আজ্ঞাবহদের পদত্যাগে কি আজ্ঞার মালিকের দায় পরিশোধ হয়? বর্বর খুনিদের যে প্রশাসন আশ্রয় দেয়, এবং এ ধরনের প্রশাসনকে যাঁরা সরকারি ক্ষমতার ঢাল দিয়ে রক্ষা করেন; তাঁদের দায় কি পরিশোধযোগ্য নয়?
সবচেয়ে বড় কথা, জীবনের আশঙ্কার কথা, পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিরাপত্তার প্রয়োজনের কথা জুবায়ের প্রক্টরসহ প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন। এ বাবদ একটি দরখাস্তও প্রশাসন বরাবর পেশ করা ছিল। ঘটনার দিন তিনি নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টরকে ফোন দিয়েছিলেন বলেও দাবি করা হচ্ছে তাঁর সহপাঠীদের পক্ষ থেকে। তাঁর মুঠোফোনের কললিস্টে কিংবা ফোন কোম্পানির হাতে এর রেকর্ড থাকার কথা। ১১ জানুয়ারির প্রথম আলো দেখুন জুবায়ের হত্যা ও পরের পরিস্থিতির পেছনে প্রশাসনিক রাজনীতির দায়টা আরও স্পষ্ট হবে। এসব কারণেই জুবায়েরের বাবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তদন্তে আস্থা হারিয়েবিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছেন।
এখানেই শেষ নয়, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে প্রশাসন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে অপসারণ করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। কার্যত তাঁকে নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদ থেকে সরিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা করা হয়েছে। অবুঝ শিশুও একে শাস্তি বলতে রাজি হবে না। এই ব্যক্তিটি ১৯৯৯ সালে ধর্ষক গ্রুপের হল দখলের সহযোগী ছিলেন। অনির্বাচিত উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির তাঁকে নিরাপত্তা কর্মকর্তা বানান।
অবিচার আর অপরাধের পুরস্কারের এ খাসলতের অপর নাম প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র। স্বয়ং উপাচার্য এর মধ্যমণি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁকে রক্ষার জন্য পুরোনোদের অনেকের পাশাপাশি হাজির নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আরও ২০০ শিক্ষক। এঁদের বেশির ভাগই নিযুক্ত হয়েছেন যোগ্যতার মানদণ্ডে নন, দলীয় আনুকূল্যে। শিক্ষক সমিতির সভায় হাতাহাতি করে এঁরা প্রমাণ করেছেন, নিয়োগদাতার হাত কত শক্তিশালী। আরও ২০-৩০ বছর এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ অলংকৃত করে থাকবেন, যার খেসারত দিতে থাকবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা। এই অযোগ্যরাই বিদ্যাচর্চার থেকে প্রশাসনিক দুধ-মধু আহরণে বেশি জড়িয়ে থাকেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করায় অযোগ্য শিক্ষকদের থেকে কামিয়াব আর কে আছে?
কেবল জাহাঙ্গীরনগরই নয়, দেশের বাদবাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিও কমবেশি এমন। এভাবে হলগুলোকে দুর্বৃত্ত ছাত্রনেতাদের আখড়া বানানো, অপরাধীবান্ধব প্রশাসন চালানো আর অযোগ্য অনুগতদের শিক্ষক বানিয়ে দল ভারী করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অপরাধীকরণ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এই অপরাধীকৃত প্রশাসনের পক্ষেই ক্যাম্পাসে একের পর এক বর্বরতার মঞ্চ সাজিয়ে বসে থাকা সম্ভব।
জুবায়ের যাদের হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু যাদের ক্ষমতা-বিত্তের মোহ ক্যাম্পাসগুলোকে বর্বরতার লীলাক্ষেত্র বানাতে দ্বিধা করছে না, তাদের শাস্তি ছাড়া এই শোক, এই বিবেক আর এই প্রতিবাদ কোনো অর্থ বহন করবে না। জুবায়েরের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্বাচিত উপাচার্যদের অপসারণ করে নির্বাচিত উপাচার্য নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় আইন থেকে উপাচার্যদের একচেটিয়া ক্ষমতা রদ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে গত এক যুগে সব নিয়োগ-দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়া উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানকে অধঃপতন থেকে রক্ষার চিন্তা বাতুলতা মাত্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার, শিক্ষা উপদেষ্টা, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্টরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই মরণযন্ত্রণাকে কি দীর্ঘায়িত করবেন, নাকি যা চলছে তা চলতে দিয়ে মৃত্যুকে এগিয়ে আনবেন?
গত বছরগুলোয় দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র আর সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ করা। উচ্চশিক্ষা বাঁচাতে হলে এই দুয়ের অবসান ঘটাতেই হবে। জাবির আন্দোলনকারীরা এই দাবিকে প্রকাশ করেছেন: খুন-সন্ত্রাস দখলদারি/বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কারও জমিদারি নয়। জাবি ছাত্র জুবায়েরের জীবন ও মৃত্যু এই জমিদারিরই শিকার।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.