পাকিস্তানে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব
পাকিস্তানে সরকার, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ক্রমেই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে। দেশের সুপ্রিম কোর্ট গতকাল সোমবার আদালত অবমাননার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির প্রতি রুল জারি করেছেন। ওই ঘটনার পরপরই প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে বৈঠক করে পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছেন গিলানি।
এদিকে, প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এবং প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণার দাবি জানিয়ে গতকাল আদালতে আবেদন করেছেন একজন আইনজীবী। বিশ্লেষকেরা বলছেন, জারদারি-গিলানি সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তবে আগের চারবারের সামরিক অভ্যুত্থানের মতো তারা সরাসরি বন্দুকের নলের মুখে জোর করে ক্ষমতায়ও আসতে চাইছে না। তারা চাইছে, সাংবিধানিক উপায়েই সরকারকে বিদায় করতে। এ জন্য বন্দুকের নলটি তারা রেখেছে বিচার বিভাগের কাঁধে। বিচার বিভাগও এ ক্ষেত্রে একের পর এক যথাসম্ভব আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আর আদালতের এসব পদক্ষেপের ফলে দিনে দিনে আরও সংকটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে সরকার।
হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট রুল জারির পরপরই প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গে বৈঠক করেন গিলানি। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্টকে জানান, পার্লামেন্ট চাইলে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি আছেন।
নিজস্ব সূত্রের বরাত দিয়ে এরআরওয়াই নিউজ চ্যানেল জানায়, অবমাননার অভিযোগে আদালতে তলব করার পর ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও শরিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন গিলানি। এ সময়ও তিনি বলেন, তাঁর পদত্যাগে যদি সরকার ও পার্লামেন্ট শক্তিশালী হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি আছেন।
পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে পিপিপি ও শরিক দলগুলোর ওই বৈঠক ডেকেছিলেন গিলানি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ওই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জারদারিও উপস্থিত ছিলেন। আদালত অবমাননার অভিযোগসহ দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো রকম সংঘাতে না জড়ানোর জন্য বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন পিপিপিসহ অন্য দলগুলোর জ্যেষ্ঠ নেতারা। এদিকে গতকাল রাতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে আস্থা ভোটে জিতে গেছেন গিলানি। এতে তাঁর এবং তাঁর সরকারের অবস্থান আগের চেয়ে সংহত হয়েছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই জানায়, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।
প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলো পুনরায় চালু করতে আদালতের দেওয়া নির্দেশনা পালন না করায় গতকাল প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেন সুপ্রিম কোর্ট। তাঁকে আগামী বৃহস্পতিবার আদালতে তলব করা হয়েছে।
বিচারক নাসির উল-মুল্ক আদালতে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ পালন না করায় প্রধানমন্ত্রী গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। তাঁকে সশরীরে ১৯ জানুয়ারি আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
নাসির উল-মুল্ক আরও বলেন, ‘আদালত অবমাননার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।’
২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সরকার ন্যাশনাল রিকনসিলেশন অর্ডিন্যান্স বা এনআরওর মাধ্যমে একটি সাধারণ দায়মুক্তি ঘোষণা করে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ আরও শত শত রাজনৈতিক নেতা দুর্নীতিসহ অন্যান্য অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যান। জারদারি অব্যাহতি পান সুইজারল্যান্ডের আদালতে দায়ের হওয়া অর্থ পাচার মামলা থেকে।
পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে ওই এনআরও সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে এবং সেই থেকে জারদারির বিরুদ্ধে মামলাটি আবার চালু করার জন্য সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার জন্য সরকারকে বলে আসছেন। কিন্তু সরকার তাতে অস্বীকৃতি জানায়। সরকারের বক্তব্য, প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক দায়মুক্তি আছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করলেন সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্বে থাকা কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হলো। আদালতের এই পদক্ষেপের ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দেশটির সামরিক সরকারের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী গিলানির বিরুদ্ধে রুল জারি করা হলেও আদালতের মূল লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট জারদারি।
রুল জারির পর আইনমন্ত্রী মাওলা বক্স চান্দিও সুপ্রিম কোর্টের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়, রীতিমতো অস্বাভাবিক। বিষয়টি নিয়ে আমরা আমাদের পরামর্শক কমিটিতে আলোচনা করব। সংবিধান ও আইনের আলোকেই আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’
সাবেক আইনমন্ত্রী খালিদ আনোয়ার জানিয়েছেন, আদালত অবমাননার অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে জেলে পাঠানো যায়। তিনি বলেন, ‘তবে আমি মনে করছি না তেমনটি ঘটবে। এখানে আশঙ্কার বিষয় হলো, আদালত অবমাননার দায়ে প্রধানমন্ত্রী দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে অযোগ্য হবেন। আর পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারালে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য নন।’
এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট গতকাল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সহযোগিতা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পাঠানো বিতর্কিত ‘গোপন চিঠি’র বিষয়টি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির আবেদন গ্রহণ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল এ বিষয়ে শুনানির পর আদালত সেনাপ্রধানের আবেদনটি গ্রহণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী মনসুর ইজাজ গত অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় একটি নিবন্ধে জানান, আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন হত্যার পর সরকার আশঙ্কা করেছিল সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে। ইজাজের দাবি অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর এই সম্ভাব্য অভ্যুত্থান ঠেকাতে এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কাটছাঁট করতে সহযোগিতা চেয়ে তখন গোপনে মার্কিন সরকারকে একটি চিঠি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।
বিতর্কিত ওই চিঠির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর থেকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনী। তবে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা সমঝোতাও হয়েছিল। সে মোতাবেক পদত্যাগ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে সেনাপ্রধান কায়ানির সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া এবং এর মাধ্যমে সেনাপ্রধান সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে। প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের জবাবে সেনাবাহিনী জানায়, তাঁর এ বক্তব্য দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার সেনাপ্রধান কায়ানির সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন জারদারি। কিন্তু সেনাপ্রধান জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার কিংবা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এর ব্যাখ্যা কিংবা বক্তব্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তিনি সংবিধান অনুযায়ী শুধু পার্লামেন্টের কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্য কারও কাছে নয়।
এদিকে, প্রেসিডেন্ট জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণার দাবি জানিয়ে গতকাল সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন আইনজীবী ওয়াহাব আল খায়েরি।
বিদেশি ব্যাংক থেকে পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রেসিডেন্টকে নির্দেশ দেওয়ার দাবি জানান খায়েরি। তিনি দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট জারদারি ও তাঁর সহযোগীরা দেশের সম্পদ লুটপাট করেছেন। বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে অর্থ রেখেছেন।
আইনজীবী খায়েরি তাঁর আবেদনে আরও বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট যদি দাবি করেন সুইজারল্যান্ডে অর্থ পাচার মামলায় তাঁর দায়মুক্তি আছে, তাহলে তিনি ভুল করবেন।’
এ ছাড়া, পাকিস্তান জাতির মর্যাদাহানি করার লক্ষ্যেই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন খায়েরি। তিনি বলেছেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে ধ্বংস করার জন্যই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। এএফপি, রয়টার্স, পিটিআই, টাইমস অব ইন্ডিয়া।
No comments