মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-সাঈদীকে দিয়ে বিচার শুরু-'এ দিনটির জন্য জাতি ৪০ বছর অপেক্ষা করেছে'
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছে। আগামী ৭ ডিসেম্বর সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। এই বিচারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ গতকাল রবিবার থেকে সূচনা বক্তব্য শুরু করেছে। আজ সোমবার অসমাপ্ত সূচনা বক্তব্য শেষ করবে রাষ্ট্রপক্ষ।
এই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৪০ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির বিচার শুরু হলো।
এ বিচার শুরু করাকে জাতির জন্য মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউিটর গোলাম আরিফ টিপু। ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেছেন, 'এ বিচার রাজনৈতিক অভিলাষ বা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই এ বিচার।' পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতি এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে ৪০ বছর ধরে।
তবে সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বিচার শুরুকে বেমানান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শুনানি শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'যেখানে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের থাকাটা অনিশ্চিত, সেখানে বিচার শুরু বেমানান।'
এদিকে আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের তালিকা এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক কোন বিবেচনায় বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সে বিষয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষে বিচার শুরুর জন্য গতকাল সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন এবং কোন বিবেচনায় বিচারপতি নিজামুল হক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সাঈদীর আইনজীবীদের সে আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য ছিল। একই সঙ্গে বিচারকাজ তিন মাস মুলতবি রাখতে আসামিপক্ষে আরেকটি আবেদনেরও শুনানি ছিল গতকাল। এ জন্য সকাল সাড়ে ৯টার আগেই সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে সাঈদীর উপস্থিতিতে প্রথমেই বিচারপতি নিজামুল হকের বিচারকাজ পরিচালনার বিষয়ে শুনানি হয়। সাঈদীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন।
সাঈদীর আইনজীবীরা বলেন, ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার স্বার্থে নিজামুল হকের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া উচিত। নিজামুল হকের বিরুদ্ধে গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের সদস্য থাকার অভিযোগ ওঠার পর বিচারকাজ পরিচালনা করা ন্যায়বিচার হবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, 'যাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ, তাঁর বিচার আপনি (নিজামুল হক) করতে পারেন না। এরপরও বিচারকাজ পরিচালনা করলে জনমনে ধারণা হবে, ন্যায়বিচার হয়নি। তাই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক এড়াতে ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যই আপনাকে সরে যাওয়া উচিত। এটা দেশ, জাতি, ট্রাইব্যুনাল ও নিজামুল হকের নিজের জন্য সম্মানজনক হবে।'
সাঈদীর আইনজীবীদের এ বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল বলে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ট্রাইব্যুনালে বলেন, 'আপনি বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। এ অবস্থায় কেউ আপনার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। সেটা তোলা আদালত অবমাননার শামিল। আপনার বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য থাকলে তা আপিল বিভাগে বলতে পারে। এ মামলায় রায় হওয়ার পর যখন আপিল বিভাগে শুনানি হবে তখন তাঁরা বলার সুযোগ পাবেন। মূলত তারা বিচার কাজ বিলম্বিত করার জন্যই এসব কথা তুলছে। তাদের আবেদন খারিজ করে সূচনা বক্তব্য শুরু করুন।'
শুনানির একপর্যায়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে উদ্দেশ করে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, 'আমার প্রত্যাহারের বিষয়ে আপনাদের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ১৪ নভেম্বর আদেশ দেন। এ আদেশে বিষয়টি আমার সুবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমি সব কিছুই দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাইব্যুনালে বসেছি। তাই নতুন করে আবার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কেন?'
পরে বিচারকাজ মুলতবি রাখার আবেদনটি উপস্থাপন করেন সাঈদীর আরেক আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তিনি তিন মাস সময় চেয়ে বলেন, 'রাষ্ট্রপক্ষ এক বছর সময় পেয়েছে। আমরা কিছু ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি। আরো সংগ্রহ করার পথে। বিচারের জন্য আমরা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারিনি। সাক্ষীদের তালিকা ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ এবং তা যাচাই-বাছাই করার জন্য তিন মাস সময় প্রয়োজন।'
উভয় পক্ষের বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন। কোন বিবেচনায় বিচারপতি নিজামুল হক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সেই আবেদনের ওপর ২৩ নভেম্বর আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়। এ ছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয় ৭ ডিসেম্বর। এদিন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষকে এবং এদিন সাঈদীর পক্ষের তালিকা ও ডকুমেন্ট জমা দিতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুপুর ২টা থেকে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় রষ্ট্রপক্ষকে।
ট্রাইব্যুনালের এ আদেশের পর ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন মুলতবি রাখার আবেদন করেন। তবে ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদন নাকচ করে দেন। এরপর দুপুর ২টা ৫ মিনিটে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু সূচনা বক্তব্য শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষের লিখিত সূচনা বক্তব্যের অংশবিশেষ চিফ প্রসিকিউটর উপস্থাপনের পর তিনি বসে পড়েন। এরপর প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান বক্তব্য পাঠ করেন। ৮৭ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্যের মধ্যে গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৬১ পৃষ্ঠা পাঠ করা হয়। এ অবস্থায় গতকালের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আজ অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন।
সূচনা বক্তব্যে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখল, বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের শাসন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণ, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪ দফা, ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা (অপারেশন সার্চলাইট) এবং পরে মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রসঙ্গ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়।
সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, 'আজকের এই আবেগঘন মুহূর্তে স্মরণ করতে চাই বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা। যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। সেদিন স্বজনহারাদের কান্না আজও থামেনি। ইতিহাসের সেই জঘন্যতম অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ বিচার রাজনৈতিক অভিলাষ বা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়।'
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন, দুই লাখের বেশি মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে আলশামস, আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়েছে, শান্তি কমিটি করা হয়েছে। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় শপথ নেয়।
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, ইতিহাসের জঘন্যতম এ অপরাধের সঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়িত। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল খুলনায় জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্ব জামায়াতের ৯৬ জন নেতা-কর্মী রাজাকার বাহিনী গঠন করে। পরে পাকিস্তান সরকার রাজাকার অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে রাজাকার বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়। রাজাকার বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করত জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তান সরকার একই বছরের ৯ এপ্রিল শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিতে গোলাম আযম সদস্য ছিলেন। ১৪ এপ্রিল শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি করা হয়। এতে গোলাম আযম সদস্য ছিলেন। ওই দিন গোলাম আযমসহ বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে পাকিস্তানের পক্ষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিল হওয়ার পরপরই আজিমপুর কলোনিসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে ছাত্রসংঘ জড়িত ছিল।
সাঈদীর অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়, সাঈদী পিরোজপুরে ঘরজামাই ছিলেন। ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁকে ছারছিনা মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ১৯৬০ সালে তিনি আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 'মাওলানা' বা 'আল্লামা' লেখার মতো ডিগ্রি তিনি অর্জন করেননি। কিন্তু নামের সঙ্গে মাওলানা ও আল্লামা লিখে তিনি আইনগত অপরাধ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তে পাওয়া গেছে, সাঈদী পিরোজপুরের পাড়েরহাটে রাস্তার ওপর তেল, লবণ, মরিচ বিক্রি করতেন। তিনি এখন কোটিপতি। ঢাকায় বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে বহু সম্পদের মালিক তিনি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, সাঈদী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামা জমা দেন। এতে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আবু নাঈম মো. দেলোয়ার হোসাঈন। তিনি আবু নাঈম মো. বাদ দিয়ে সাঈদী যুক্ত করেছেন। সাঈদীর নেতৃত্বে পিরোজপুর রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকাররা পিরোজপুরের পাড়েরহাটে ফকিরদাসের বাড়ি দখল করে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে।
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩ মে কর্নেল আতিক, ক্যাপটেন এজাজ, কর্নেল এরশাদসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী পিরোজপুরে যায়। সেখানে তারা গণহত্যা চালায়। সাঈদী ও তাঁর বাহিনী তাদের সহযোগিতা করে। জাতিগত হত্যা, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অপহরণ ছিল তাদের কাজ। ৪ মে পাকিস্তানি বাহিনী পিরোজপুর শহরে আক্রমণ চালায়। তারা মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, পাড়েরহাট, টেংরাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সূচনা বক্তব্যের একপর্যায়ে বিকেল ৪টা বেজে যায়। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল আজ পরবর্তী বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বিচারকাজ মুলতবি করেন।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবং সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক আলাদা ব্রিফ করেন।
সাঈদীর পক্ষে শুনানির সময় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ফকরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম প্রমুখ।
সাঈদীর ২০ অপরাধ
এ বিচার শুরু করাকে জাতির জন্য মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউিটর গোলাম আরিফ টিপু। ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেছেন, 'এ বিচার রাজনৈতিক অভিলাষ বা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই এ বিচার।' পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতি এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে ৪০ বছর ধরে।
তবে সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বিচার শুরুকে বেমানান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শুনানি শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'যেখানে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের থাকাটা অনিশ্চিত, সেখানে বিচার শুরু বেমানান।'
এদিকে আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের তালিকা এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক কোন বিবেচনায় বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সে বিষয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষে বিচার শুরুর জন্য গতকাল সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন এবং কোন বিবেচনায় বিচারপতি নিজামুল হক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সাঈদীর আইনজীবীদের সে আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য ছিল। একই সঙ্গে বিচারকাজ তিন মাস মুলতবি রাখতে আসামিপক্ষে আরেকটি আবেদনেরও শুনানি ছিল গতকাল। এ জন্য সকাল সাড়ে ৯টার আগেই সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে সাঈদীর উপস্থিতিতে প্রথমেই বিচারপতি নিজামুল হকের বিচারকাজ পরিচালনার বিষয়ে শুনানি হয়। সাঈদীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন।
সাঈদীর আইনজীবীরা বলেন, ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার স্বার্থে নিজামুল হকের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া উচিত। নিজামুল হকের বিরুদ্ধে গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের সদস্য থাকার অভিযোগ ওঠার পর বিচারকাজ পরিচালনা করা ন্যায়বিচার হবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, 'যাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ, তাঁর বিচার আপনি (নিজামুল হক) করতে পারেন না। এরপরও বিচারকাজ পরিচালনা করলে জনমনে ধারণা হবে, ন্যায়বিচার হয়নি। তাই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক এড়াতে ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যই আপনাকে সরে যাওয়া উচিত। এটা দেশ, জাতি, ট্রাইব্যুনাল ও নিজামুল হকের নিজের জন্য সম্মানজনক হবে।'
সাঈদীর আইনজীবীদের এ বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল বলে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ট্রাইব্যুনালে বলেন, 'আপনি বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। এ অবস্থায় কেউ আপনার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। সেটা তোলা আদালত অবমাননার শামিল। আপনার বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য থাকলে তা আপিল বিভাগে বলতে পারে। এ মামলায় রায় হওয়ার পর যখন আপিল বিভাগে শুনানি হবে তখন তাঁরা বলার সুযোগ পাবেন। মূলত তারা বিচার কাজ বিলম্বিত করার জন্যই এসব কথা তুলছে। তাদের আবেদন খারিজ করে সূচনা বক্তব্য শুরু করুন।'
শুনানির একপর্যায়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে উদ্দেশ করে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, 'আমার প্রত্যাহারের বিষয়ে আপনাদের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ১৪ নভেম্বর আদেশ দেন। এ আদেশে বিষয়টি আমার সুবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমি সব কিছুই দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাইব্যুনালে বসেছি। তাই নতুন করে আবার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কেন?'
পরে বিচারকাজ মুলতবি রাখার আবেদনটি উপস্থাপন করেন সাঈদীর আরেক আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তিনি তিন মাস সময় চেয়ে বলেন, 'রাষ্ট্রপক্ষ এক বছর সময় পেয়েছে। আমরা কিছু ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি। আরো সংগ্রহ করার পথে। বিচারের জন্য আমরা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারিনি। সাক্ষীদের তালিকা ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ এবং তা যাচাই-বাছাই করার জন্য তিন মাস সময় প্রয়োজন।'
উভয় পক্ষের বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন। কোন বিবেচনায় বিচারপতি নিজামুল হক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, সেই আবেদনের ওপর ২৩ নভেম্বর আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়। এ ছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয় ৭ ডিসেম্বর। এদিন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষকে এবং এদিন সাঈদীর পক্ষের তালিকা ও ডকুমেন্ট জমা দিতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুপুর ২টা থেকে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় রষ্ট্রপক্ষকে।
ট্রাইব্যুনালের এ আদেশের পর ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন মুলতবি রাখার আবেদন করেন। তবে ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদন নাকচ করে দেন। এরপর দুপুর ২টা ৫ মিনিটে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু সূচনা বক্তব্য শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষের লিখিত সূচনা বক্তব্যের অংশবিশেষ চিফ প্রসিকিউটর উপস্থাপনের পর তিনি বসে পড়েন। এরপর প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান বক্তব্য পাঠ করেন। ৮৭ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্যের মধ্যে গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৬১ পৃষ্ঠা পাঠ করা হয়। এ অবস্থায় গতকালের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আজ অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন।
সূচনা বক্তব্যে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখল, বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের শাসন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণ, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪ দফা, ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা (অপারেশন সার্চলাইট) এবং পরে মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রসঙ্গ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়।
সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, 'আজকের এই আবেগঘন মুহূর্তে স্মরণ করতে চাই বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা। যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। সেদিন স্বজনহারাদের কান্না আজও থামেনি। ইতিহাসের সেই জঘন্যতম অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ বিচার রাজনৈতিক অভিলাষ বা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়।'
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন, দুই লাখের বেশি মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে আলশামস, আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়েছে, শান্তি কমিটি করা হয়েছে। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় শপথ নেয়।
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, ইতিহাসের জঘন্যতম এ অপরাধের সঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়িত। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল খুলনায় জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্ব জামায়াতের ৯৬ জন নেতা-কর্মী রাজাকার বাহিনী গঠন করে। পরে পাকিস্তান সরকার রাজাকার অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে রাজাকার বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়। রাজাকার বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করত জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তান সরকার একই বছরের ৯ এপ্রিল শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিতে গোলাম আযম সদস্য ছিলেন। ১৪ এপ্রিল শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি করা হয়। এতে গোলাম আযম সদস্য ছিলেন। ওই দিন গোলাম আযমসহ বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে পাকিস্তানের পক্ষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিল হওয়ার পরপরই আজিমপুর কলোনিসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে ছাত্রসংঘ জড়িত ছিল।
সাঈদীর অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়, সাঈদী পিরোজপুরে ঘরজামাই ছিলেন। ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁকে ছারছিনা মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ১৯৬০ সালে তিনি আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 'মাওলানা' বা 'আল্লামা' লেখার মতো ডিগ্রি তিনি অর্জন করেননি। কিন্তু নামের সঙ্গে মাওলানা ও আল্লামা লিখে তিনি আইনগত অপরাধ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তে পাওয়া গেছে, সাঈদী পিরোজপুরের পাড়েরহাটে রাস্তার ওপর তেল, লবণ, মরিচ বিক্রি করতেন। তিনি এখন কোটিপতি। ঢাকায় বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে বহু সম্পদের মালিক তিনি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, সাঈদী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামা জমা দেন। এতে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আবু নাঈম মো. দেলোয়ার হোসাঈন। তিনি আবু নাঈম মো. বাদ দিয়ে সাঈদী যুক্ত করেছেন। সাঈদীর নেতৃত্বে পিরোজপুর রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকাররা পিরোজপুরের পাড়েরহাটে ফকিরদাসের বাড়ি দখল করে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে।
সূচনা বক্তব্যে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩ মে কর্নেল আতিক, ক্যাপটেন এজাজ, কর্নেল এরশাদসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী পিরোজপুরে যায়। সেখানে তারা গণহত্যা চালায়। সাঈদী ও তাঁর বাহিনী তাদের সহযোগিতা করে। জাতিগত হত্যা, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অপহরণ ছিল তাদের কাজ। ৪ মে পাকিস্তানি বাহিনী পিরোজপুর শহরে আক্রমণ চালায়। তারা মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, পাড়েরহাট, টেংরাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সূচনা বক্তব্যের একপর্যায়ে বিকেল ৪টা বেজে যায়। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল আজ পরবর্তী বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বিচারকাজ মুলতবি করেন।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবং সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক আলাদা ব্রিফ করেন।
সাঈদীর পক্ষে শুনানির সময় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ফকরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম প্রমুখ।
সাঈদীর ২০ অপরাধ
No comments