অনন্য মার্চ ॥ নবীন প্রজন্মকে জানাতে হবে ইতিহাসের সত্য by নিয়ামত হোসেন
আজ শুরু হলো জাতীয় জীবনের অতীব গুরম্নত্বপূর্ণ মাস-অগ্নিঝরা মার্চ। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মার্চের গুরম্নত্ব অপরিসীম। অনেক নামে এ মাসের পরিচয়।
অগি্নঝরা, উত্তাল, গণ-জাগরণের মার্চ। এটা আমাদের পরম পাওয়া স্বাধীনতার মাস। একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরম্নর পরপরই মধ্যরাতে ঘোষিত হলো স্বাধীনতা। পাকিসত্মানী অধীনতা ঔপনিবেশসুলভ শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন, হুকুমদারি_সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেল বাংলাদেশ। শেষ হয়ে গেল পাকিসত্মানের সব ধরনের হুকুমদারি। সর্বাধিক গুরম্নত্বপূর্ণ এই মুহূর্তটি। সর্বাধিক গুরম্নত্বপূর্ণ এই ঘটনা। এই স্বাধীনতা ঘোষণা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। একটা দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে, অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছে দেশের মানুষকে। সেজন্য মার্চের ঘটনাবলী, স্বাধীনতা ঘোষণার তথ্যাদি বহু বছর ঠিকভাবে দেশের মানুষকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানতে দেয়া হয়নি। এই ঘটনা তথা ইতিহাস নিয়ে অনেক রকম উল্টোপাল্টা করা হয়েছে এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই ইতিহাসের প্রধান মানুষকেই নানা কৌশলে এই ইতিহাস থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে অনেক উল্টাপাল্টা প্রচারও করা হয়েছে, তিনি যে স্বাধীনতা সংগ্রামে তেমন বিরাট কোন ভূমিকা রাখেননি, এমন চিত্র নানা বক্তব্যে, লেখায় অতীতের বছরগুলোয় উপস্থাপন করা হয়েছে। সবকিছু করা হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসের নায়ককে হেয় বা খাটো করার জন্য এবং এভাবে দিনের পর দিন তাঁকে খাটোভাবে চিত্রিত করতে গিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামকেই গুরম্নত্বহীন করার চেষ্টা হয়েছে। এসব অপপ্রচার দিনের পর দিন চালানো হয়েছে, যার জন্য এখনও তরম্নণ প্রজন্মের অনেকেই ইতিহাসের সঠিক তথ্য জানে না, অনেকের কাছে এখনও ব্যাপারটা ধোঁয়াশার মতো হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা রোধ এবং সঠিক ইতিহাস জানানোর যে কাজ বেশ কিছুকাল ধরে শুরম্ন হয়েছে তার ফলে অনেকেরই ওই ধোঁয়াশা ভাব চলে গেছে। সত্য তথ্য জানতে পেরে এখন তারা আনন্দিত।কোন স্বাধীন দেশের নাগরিক তার নিজের দেশের স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস পড়ার সুযোগ পাবে না এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে! দেশে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতো থাকতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মতভেদ থাকবে কেন? স্বাধীনতার যিনি প্রধান নায়ক তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন? ঠিক এই ঘটনাই এদেশে বছরের পর বছর দেখা গেছে। ইতিহাস বিকৃতি করার পিছনে যে মতলব ছিল সে মতলব ব্যর্থ হয়ে গেছে। ইতিহাসের সত্যি তথ্য এখন মানুষ জানে। নতুন প্রজন্মের যাদের মনে ভিন্ন তথ্য ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেসব ব্যর্থ হয়ে গেছে। নতুন এই সরকার এসে ইতিহাস বিকৃতি ঠেকানো এবং সত্যিকার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানানোর যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, দ্রম্নত সে সকল উদ্যোগ বাসত্মবায়ন করা উচিত। স্থায়ীভাবে ইতিহাস বিকৃতির ধারাটিকে বন্ধ করতে হবে। সত্যি ইতিহাস যত বেশি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে তত ভালভাবে বিকৃতি রোধ করা সম্ভব হবে।
একাত্তরের মার্চ আমাদের ইতিহাসের সর্বাধিক গুরম্নত্বপূর্ণ মাস। একেবারে শুরম্ন থেকে একাত্তরের এই মাসের প্রতিটি দিন ইতিহাসের একেকটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
সেই দিনগুলো প্রত্যৰ করার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে তাঁরা শুধু সেই দিনগুলোর উত্তাপই শুধু অনুভব করেননি, এগুলোর পিছনে অনেক কালের জমে থাকা ৰোভ ও ক্রোধেরও বহিপর্্রকাশ তাঁরা দেখেছেন। পাকিসত্মান সৃষ্টির পর থেকেই নানা কায়েমী স্বার্থবাদী মহল খুব তৎপর হয়ে ওঠে। এরাই জুড়ে বসে গোটা প্রশাসনে। এরা চরম বাঙালী-বিদ্বেষী, সংস্কৃতিবিরোধী, গণতন্ত্রকে বিকশিত হবার কোন সুযোগ দেয়নি এরা, এদের মেজাজমর্জি, আচার-আচরণ ছিল অগণতান্ত্রিক। এক সময় জারি করা হলো মার্শাল ল। প্রতিষ্ঠিত হলো আইউব খানের একচ্ছত্র শাসন। তিনি জানতেন গণতন্ত্র ছাড়া মানুষ খুশি হবে না, সেজন্য তিনি মানুষকে বোকা ভেবে এক অদ্ভুত ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করলেন। সেটার নাম মৌলিক গণতন্ত্র। ওঁর চারপাশে কিছু দালাল জুটেছিল তাদের সহায়তায় তিনি এক দশক শাসন ৰমতা দখল করে রাখলেন। এবং তাঁর ওই মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তিনি ৰমতাকে আরও দীর্ঘদিন অাঁকড়ে রাখার পরিকল্পনা করছিলেন। আইউব খান যে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন চাটুকার ছাড়া দুনিয়ার কোথাও তা প্রশংসিত হয়নি। দেশের মানুষ ঘৃণাভরে ওই গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে।
তবু আইউব খান তোড়জোড় লাগালেন দেশকে একটা নতুন ধরনের গণতন্ত্র উপহার দেবেন। সেটা তাঁর মৌলিক গণতন্ত্র। তিনি কিছু সুবিধাভোগী, লোভী, চাটুকারদের জোটালেন। বেসিক ডেমোক্রেসি অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য বানালেন কিছু লোককে। ঢাকার রমনা পার্কে এই মৌলিক গণতন্ত্রওয়ালাদের সম্মেলন হলো। লোকজন কৌতূহলের সঙ্গে বিষয়টি দেখল। রমনা পার্কের ওই সম্মেলন থেকে একজন আইউবী মৌলিক গণতন্ত্রী বের হয়েছেন কোথাও তিনি যাবেন। ঘটে গেল এক অভাবিত ঘটনা। ওই মৌলিক গণতন্ত্রী পার্ক থেকে যেই পথে বেরিয়েছেন অমনি একটা ষাঁড় ছুটে এসে তাড়া করল তাকে। একদিকে দাবড়ানো, লোকটা প্রাণভয়ে ছুটছে, অন্যদিকে শিংয়ের গুঁতো! সে এক মহা কা-। ঘটনাটা সাংবাদিকের চোখ এড়ায়নি। পরদিন সে সময়ের এক বিখ্যাত দৈনিকে খবরটি বের হলো। খবরটি যতটা না মজার, তার চেয়ে খবরের হেডিংটা হাজার গুণ বেশি মজার! হেডিং ছিল : চিনিল কেমনে! সে সময় যার চোখে খবরটা পড়েছিল বা যিনি খবরটার কথা শুনেছেন তিনিই অনাবিল আনন্দ পেয়েছেন সেটা থেকে।
ছাত্র জনতার কঠোর লাগাতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক আইউব বিদায় নিলে আগমন ঘটল আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের। নির্বাচন দিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ব্যাপকতম ব্যবধানের ভোটে জয়লাভ করল। ভোটের ফল চমকে দিল পাক শাসকদের। তারপর একের পর এক ষড়যন্ত্র। পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল, হঠাৎ করে ঘোষণা করা হল অধিবেশন স্থগিতের। এদেশের মানুষ ফেটে পড়ল বিৰোভে। সারা বাংলাদেশ বিৰুব্ধ। ঢাক শহর তখন অগি্নগর্ভ। একাত্তরের মার্চের প্রথম দিন থেকে ঢাকার রাসত্মা ৰোভে-বিৰোভে উত্তাল। একের পর এক ঘটনা। তখকার ঘটনাগুলো যিনি দেখেছেন তিনি নিজের চোখে প্রত্যৰ করেছেন ইতিহাসের নতুন নতুন অধ্যায়। অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ আর মানুষ, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাবে একের পর এক ঘটনা। এক পর্যায়ে আলোচনার নামে চলল যড়যন্ত্র, চলল গণ-হত্যার প্রস্তুতি। তারপর এল ২৫ মার্চ। সেই রাতে সশস্ত্র পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনী বাঙালী হত্যায় উৎসবে মেতে উঠল। ঘোষিত হলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো বিচারের জন্য। শুরম্ন হয়ে গেল সার্বিক যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন। ২৫ মার্চ হানাদার সেনাদের অপারেশনের নির্দেশ দিয়ে তিনি ঢাকা থেকে পালালেন। সকল ঘটনা, সবকিছুর জন্য তিনি দায়ী করলেন বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর বিচার হবে, কঠোর শাসত্মি হবে ঘোষণা করলেন তিনি।
ওদিকে শুরম্ন হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। হানাদারদের প্রতিরোধে গোটা দেশ তখন ঐক্যবদ্ধ। হানাদাররা ঠা-ামাথায় শুরম্ন করল ধ্বংসযজ্ঞ। নির্বিচারে বাঙালী হত্যা, গর্ত খুঁড়ে তার পাশে সার বেঁধে মানুষজনকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে সবাইকে হত্যা এবং সেই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া, হাত বেঁধে দলে দলে মানুষ হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন চলানো, নারীদের চরমভাবে নির্যাতন, আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি, হাট-বাজার ভস্মীভূত করে দেয়া, এমন কোন অপরাধের কাজ নেই, যা পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা করেনি। এরপর প্রবল প্রতিরোধ, পাল্টা আঘাত, অর্থাৎ যথাযথ প্রতু্যত্তর দেয়া, এভাবে বাঙালীর হাতে মার খেতে খেতে এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ পযর্ুদসত্ম, পরাভূত হলো হানাদাররা। ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো তারা। শত্রম্নমুক্ত হলো দেশ, নিরঙ্কুশ হলো দেশের স্বাধীনতা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং জনমতের চাপে পাকিসত্মানীরা বাধ্য হলো বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন নিজের দেশে। সেদিন পূর্ণ হলো বিজয়ের আনন্দ, স্বাধীনতার আনন্দ।
এই ঘটনাগুলো ঘটে গেছে দুনিয়ার সামনে। দুনিয়ার মানুষ জানে এই ইতিহাস। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা আমাদের নিজেদের দেশেই এই ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলে প্রবলভাবে, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে নানাভাবে, নানা কৌশলে এই কাজ করা হয়েছে, সবচেয়ে লজ্জাকর কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারী মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। দিনের পর দিন এই জঘন্য কা- চলে। এবার মহাজোট সরকার এসে ইতিহাসের বিকৃতি রোধে যেসব ভূমিকা নিয়েছে তাতে মানুষ খুশি। দেশবাসী চায়, নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানুক, পূর্ব পুরম্নষদের অবদানের কথা জেনে গর্ববোধ করম্নক। কত আন্দোলন, সংগ্রাম, নির্যাতন এবং কী পরিমাণ বিপুল জীবনদানের বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা এসেছে সেটা উপলব্ধি করে নিজেরা নিজেদের স্বাধীন দেশকে বিশ্ব অঙ্গনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথে উদ্দীপ্ত হোক_ এটাই দেশবাসী চায়। প্রত্যেকের সত্য জানার অধিকার রয়েছে। আর নিজের ইতিহাসের সত্য জানার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক মানুষের। মানুষের সে অধিকার সমুন্নত রাখা হোক, মানুষকে জানানো হোক স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস, তার পটভূমি। জানানো হোক একাত্তরের সেই আগুন ঝরানো মার্চের দিনগুলোর কথা। অগি্নগর্ভ একাত্তরের মার্চের স্মৃতিবাহী এবারেও ফিরে এসেছে মার্চ। স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা এ মার্চের_১ মার্চ, ৭ মার্চ, ২৫ এবং ২৬ মার্চ। এসব দিন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বলতম সব তারিখ। এ ইতিহাসকে যত চেষ্টাই হোক বিকৃত করা, উল্টাপাল্টা করা যে সম্ভব নয়, সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে।
No comments