রাহুল গান্ধীর নতুন যাত্রা by সাবা নাকভি

আবেগ ও পদবির বাইরে রাহুল গান্ধীর যে যোগ্যতা আছে, তাতে তিনি ভারতের মতো দেশের রাজনীতি এবং তাঁর নিজ দলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা কতটা রাখেন?
ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে এবং ভারসাম্য রক্ষায় মনোনিবেশ করে এগিয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যায়, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। আজকে তাঁর অবস্থান থেকে বোঝা যায়, অদূরভবিষ্যতে তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করছেন। কিন্তু জয়পুরে তাঁর দেওয়া ভাষণ শোনার পর আমরা বুঝতে পারি, তিনি গুরুদায়িত্ব পালনে কতটা সক্ষম হবেন কিংবা কতটা ব্যর্থ হবেন এবং অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অবস্থান থেকে তিনি দল ও রাষ্ট্রকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, তাঁর দাদার উত্তরসূরি হিসেবে তিনি কি ভারতের জাতীয় উন্নয়নে নতুন কিছু দিতে সক্ষম হবেন? নাকি উত্তরাধিকারী হিসেবে দলের মধ্যে নিজের আসনটিই বড় মনে করবেন। রাজনীতিতে তাঁর নবিশিকালও কি শেষ হয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারি?
জয়পুরে দেওয়া বক্তৃতার শেষাংশে তিনি ভারসাম্যের প্রসঙ্গ এনেছেন। বলেছেন, তিনি ছোট ছেলেদের মতো ব্যাডমিন্টন খেলতে পছন্দ করেন। কারণ, ব্যাডমিন্টন খেলায় ভারসাম্যের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলা শিখেছেন দুজন নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে, যে দুজন তাঁর দাদিকে হত্যা করেছে। দর্শকদের তিনি প্রথমেই কাঁদিয়ে তাদের মধ্যে আবেগ সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছেন। তারপর এসেছেন ক্ষমতার প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, তাঁর মা মনে করেন, ক্ষমতা হচ্ছে এক ধরনের বিষ। এই বিষের প্রতিষেধক হচ্ছে তা থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা যায়, তার চেষ্টা করা। সেই ক্ষমতার কথাই বলছি, যে ক্ষমতা শুধু ক্ষমতার জন্যই আসে। এর তিন দিন পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। তাঁকে দলের নীতিনির্ধারক ও কর্মীদের সঙ্গে দেখা গেল দিলি্লর আকবর রোডের দলীয় কার্যালয়ে। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে বললেন, তিনি ইতিবাচক বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করতে বেশি উৎসাহী।
তবে জয়পুরের বক্তৃতাকে রাজনৈতিক, আবেগ ও দার্শনিক বিবেচনায় তাঁর দেওয়া সেরা বক্তৃতা হিসেবে উল্লেখ করা যাবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস মনে করে গান্ধী পরিবারের প্রতি মানুষের আবেগ, ব্যক্তির কারিশমা কংগ্রেসের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। এটা স্বাভাবিক চিন্তা বলেও মনে করা যায়। সোনিয়ার প্রস্থান এবং রাহুলের প্রবেশ হচ্ছে। প্রবেশকারী রাহুল রাজনীতিতে এখনো তুলনামূলকভাবে নবীন। নবীনের প্রতি তারুণ্যের সমর্থন আছে। বোঝা গেছে তা জয়পুরেও। তামিলনাড়ু থেকে আসা একজন যুবকংগ্রেসের কর্মী তো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। বললেন, দেখুন কেমন তারুণ্যে ভরপুর এবং সৎও বটে। মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাঁকে লড়াই করতে হবে। অথচ রাহুল তাঁর বক্তব্যে এখনো স্পষ্ট করছেন না, আসলে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বকে পছন্দ করেন, নাকি প্রধানমন্ত্রীর জন্য শুধু প্রচারণায় নেমেছেন, তাও বোঝা যায় না স্পষ্টত। এর পরও বলতে হবে, আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রচারে তিনিই হবেন প্রধান।
সমালোচকরা বলছেন, কংগ্রেস যদি নির্বাচনে ভালো করে, তাহলে তিনি সরকারের প্রধান হবেন। আর যদি না পারে তাহলে বলা হবে তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করে গেছেন। বিজেডি থেকে নির্বাচিত এমপি পিনাকী মিশ্র বলেছেন, ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতা ভোগ করার কৌশলটা রাহুল ভালো করেই রপ্ত করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীই যেখানে তাঁকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন, সেখানে তিনি কোন কারণে আগুনে নিজেকে সঁপে দেবেন! তিনি ব্যক্তিগত জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে পারছেন। কোন কারণে তিনি নিজের এই ব্যক্তিগত জীবনকে উৎসর্গ করবেন?
বিখ্যাত এক কংগ্রেস নেতা বলেছেন, এখনো যেমন রাহুল ক্ষমতাকে সর্বতোভাবে কাঙ্ক্ষিত বিষয় নয় বলে মনে করেন, তেমনি ভবিষ্যতেও প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্য তিনি খুব একটা উৎসাহী নাও হতে পারেন। আর তিনি যে সোনিয়ার ভূমিকাকেই গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাও মনে করা যায়। অন্য প্রান্ত থেকে যদি নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে অবতীর্ণ হন, সে ক্ষেত্রে রাহুল গরিববান্ধব পরিচিতিকে নিয়ে এগিয়ে যাবেন। খাদ্য বিলের ব্যাপারে রাহুলের ভূমিকাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তো আছেই।
বহুদলীয় রাজনীতির দেশ ভারতে রাজনৈতিক খেলা চলবে বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে। রাহুল যে তাদের সঙ্গে সমঝোতার পথে যাবেন না, তা নিশ্চিত। কিন্তু উত্তর প্রদেশ ও বিহারে তাদের ফল তো আশাজনক নয়। সংসদ নির্বাচনে কংগ্রেস ভালো করতে পারেনি। দলের অভ্যন্তরে এর সাফাই গাইতে দেখা যায়। তাঁরা বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে পদ্ধতিতে ভোট হয়েছে, এখানে সেটা পরিবর্তিত। যে কারণে তাদের ভোটের হিসাব পাল্টে গেছে।
কংগ্রেসের এক সাবেক মন্ত্রী বলেছেন, এই নির্বাচনগুলোতে কংগ্রেস কী করেছে সেটা বড় কথা নয়। দেখতে হবে আগামীতে তাদের অবস্থান কী হচ্ছে। এনসিপির জেনারেল সেক্রেটারি ডি পি ত্রিপাঠি মন্তব্য করেছেন, রাহুল গান্ধী দলে বড় দায়িত্ব পেয়েছেন এটা ভালো কথা। কিন্তু এই নিয়োগ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমস্যা তৈরি করতে পারে। আমি আপনাদের অর্জুন সিং ও জিতেন্দ্র প্রসাদের ইতিহাস দেখার জন্য অনুরোধ করব। তৎকালীন কংগ্রেসপ্রধান রাজীব গান্ধী ও সীতারাম কেশরী এই পদে তাঁদের বসিয়েছিলেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, রাহুল তাঁর নিজের দলের কিছু বিষয় নিয়েও সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়েও জোর দিয়েছেন। বলেছেন রাজ্যগুলোকে এখনকার চেয়ে আরো শক্তিশালী করার জন্য। রাহুলের দাদি ইন্দিরা গান্ধীর সময় রাজ্যগুলো থেকে এই দাবি জোরালো হয়েছিল।
আমরা আশা করতে পারি, রাহুল গান্ধী ভারতের কংগ্রেসকে নতুন করে কিছু দিতে পারবেন। এটা রাহুলেরই কথা। তিনি দলের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনার কথাও ভাবছেন এটা বোঝা যায়। কিন্তু রাহুলের সামনে বিশাল পথ। তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সেই পথ পারি দিতে হবে।
(সংক্ষিপ্ত)
লেখক : সাংবাদিক।
ভারতের আউটলুক থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন।

No comments

Powered by Blogger.