চালচিত্র-অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ ও দ্রুত পচনশীল যন্ত্রণাময় সমাজ by শুভ রহমান

সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, চরম ধৃষ্টতায় ইসলামী ছাত্রশিবির বারবার পুলিশের ওপর সহিংস হামলা চালাচ্ছে। মনে তাদের দুরাশা, আটক যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করবে। দুর্বল ও কীটদষ্ট পুলিশ প্রশাসন আর নষ্ট ছাত্রলীগই শিবিরকে এই আস্পর্ধা দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধটা কার্যত অসমাপ্তই রয়ে গেছে। অর্থবহ হয়নি অর্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না, এর ফলেই সমাজের পচন দ্রুততর ও অপ্রতিরোধ্য। সুশাসন মাথা কুটলেও কায়েম হচ্ছে না। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজে চোখ মেললেই হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে গলায় এসে আটকে যায়। কালকের অবিশ্বাস্য সংবাদকেও ম্লান করে দিচ্ছে আজকের দুঃসংবাদ। উজ্জ্বল দুয়েকটা সুসংবাদ কখনো থাকলেও মহাকাল যেন তার গায়ে কালি লেপটে দিচ্ছে পরমুহূর্তেই। কী হবে সুসংবাদ দিয়ে!
ইতিবাচক সংবাদকে আঁকড়ে ধরার সব প্রচেষ্টাই তো ব্যর্থ করে দিচ্ছে নিত্যনতুন ভয়াবহ দুঃসংবাদ। মানুষ যে সুস্থিরভাবে বেঁচে আছে, এটাই সবচেয়ে বিস্ময়কর। এমনটা তো হতে পারে দেশে একটা যুদ্ধ থাকলে! তবে কি যুদ্ধই চলছে, অদৃশ্য যুদ্ধ! সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধটাই কী শেষ হয়নি? কখন, কিভাবে শেষ হবে! আমাদের জীবনের সবটাই প্রায় শেষ হয়ে গেল। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ বুকভরা স্বপ্নকে তো সফল করতে পারল না। এনে দিতে পারল না নিশ্চিন্ত জীবন-জীবিকা। হারিয়ে গেল বরং হাতের কাছে মজুদ বাঁচার অবলম্বনগুলো। মুক্তিযুদ্ধ যদি সৃজনশীল মানুষ হওয়ার সুযোগই না দিতে পারল, তাহলে যুদ্ধ শেষ হলো কোথায়! এ জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও বুক চিতিয়ে লড়তে হবে- কে ভেবেছিল? হেমিংওয়ের 'দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী'র বৃদ্ধ ধীবর স্যান্টিয়াগোর মতোই জীবন। চারদিকের উন্মত্ত হিংস্র হাঙরগুলোর ক্রমাগত মারমুখী আক্রমণে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের শেষপর্যন্ত শুধু কঙ্কালটাকে নিয়েই ডাঙায় ফিরে স্যান্টিয়াগোর মতো ক্লান্ত হয়ে গভীর সুষুপ্তিতে ঢলে পড়েছে এ জীবন। কিছুই করার নেই। এটাই রূঢ় বাস্তবতা। আবারও নতুন করে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। গভীর সুষুপ্তির মধ্যে স্যান্টিয়াগোর মতো স্বপ্নই বা দেখতে পারছি কই! ঘুমের মধ্যে স্যান্টিয়াগো সিংহের বিরুদ্ধেই লড়ে চলেছে। এ জীবনও কি সেই বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে!
ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড, বাট ক্যান নেভার বি ডিফিটেড। পরাভব মানবে না মানুষ, ধ্বংস হয়ে গেলেও। এ দুর্মর সংকল্প কি আমরা নিতে পারছি! এই মহা আত্মজিজ্ঞাসার মুখে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সংকল্পটা ছিল, 'হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু'তে, আর আজ সেই অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে কী বুক ঠুকে অমন দুর্মর সংকল্প নিতে পারছি! স্বাধীনতা যে কী বিশাল এক সম্ভাবনার নাম, কী বিশাল স্বপ্নের নাম, চারপাশের অবক্ষয়, বিপর্যয়, উৎকট বিভীষিকা কি আমাদের সেই দুর্জয় শক্তিটুকু ধরে রাখতে দিচ্ছে! প্রতিমুহূর্তেই কি মনে হচ্ছে না, আমরা বুঝি শেষপর্যন্ত হেরেই গেলাম!
খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, হিংসা-হানাহানি, চারপাশের প্রায় সর্বগ্রাসী সংকট পরাধীন আমলের সব গ্লানিকেও অতিক্রম করে গেছে।
স্বাধীনতার শত্রুরা এত দীর্ঘসময় মরণপণ যুঝে বেঁচে থাকবে, কে ভেবেছিল! তাদের ফুসফুসে হাওয়া দেওয়ার সব অপশক্তিই অবিশ্বাস্য আয়ু নিয়ে বেঁচে আছে। আমাদের ক্ষমাহীন নিশ্চেষ্টতা আর আত্মপ্রবাদই তাদের অবিশ্বাস্য সক্রিয়তার শক্তি জুগিয়েছে।
আমাদের কোন ব্যর্থতা স্বাধীনতার আত্মস্বীকৃত শত্রুদের এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকার, নতুন করে মাথা তোলার স্পর্ধা দেখানোর সুযোগ করে দিল, শেষ যুদ্ধের জন্য মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আগে তা কি আমরা ভেবে দেখব না, খুঁজে বের করব না?
আমরা সব কিছুর আনুষ্ঠানিকতা নিয়েই যেন নির্বোধের প্রশান্তিতে ডুবে আছি। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা পেয়েছি, আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র পেয়েছি, আনুষ্ঠানিক সংসদ পেয়েছি, ব্যস, যেন সব পাওয়াই হাতের মুঠোয়! সবই যে আসলে পেয়েও পাইনি, আসলে হাত যে এক রকম শূন্যই রয়ে গেছে, কখন হবে সে চৈতন্যোদয়, সে বোধ-বুদ্ধি!
স্বাধীনতা তো এমন হতে পারে না যে একদল পশু নিত্য গণধর্ষণের স্বাধীনতা পেয়ে যাবে! একদল লোভ-লালসায় লালা ঝরানো মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবাধে লুটপাট করে চলবে! এমন তো হতে পারে না যে তারা আমার প্রিয়তম দেশকে বুদ্ধিবৃত্তিশূন্য, মেধাশূন্য, সুকুমারবৃত্তিশূন্য, সংস্কৃতিচর্চাশূন্য করে রাখার সুযোগ পেয়ে যাবে! গোটা জাতি অন্ধত্বের ঠুলি পরে বসে থাকবে! দীর্ঘ চার দশক পরেও! আপন ভাষা-সংস্কৃতির বিপুল সম্পদ-ঐশ্বর্যকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানার কোনো রকম সুযোগ পাবে না, তাগিদই অনুভব করবে না! প্রকট হয়ে উঠবে গোটা জাতির সাংস্কৃতিক দৈন্য!
আমাদের মনে হয়, শেষ যুদ্ধে নামার আগে কেন, কিসের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি এবং এবার শেষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ব, তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ আমাদের করে দেখতেই হবে। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, দুই লাখ মা-বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে, আজও প্রতিমুহূর্তে অগণিত নারী-পুরুষ-শিশুকে দানবীয় নৃশংসতার শিকার হতে হচ্ছে; কেন, কী কারণে তা না জেনেই! স্বাধীনতার শত্রুদের ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ফাঁসিতে লটকাতে হবে জাতির কলঙ্কমোচনের জন্য, সেই সঙ্গে সমাজের সব দুর্বৃত্ত ও অপরাধীকেই নির্মূল করতে হবে যুদ্ধাপরাধমুক্ত দেশকে, সমাজকে সভ্যমানুষের বসবাসের উপযুক্ত করতেই। শুরু হতে যাচ্ছে দেশ ও জাতির জীবনে সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়, এ মুহূর্তে আমরা কি নিজেদের নবজন্মের জন্য প্রস্তুত করব না!
প্রশাসন পচে-গলে গেছে। পাল্টাতে হবে তার খোলনলচেই। সভ্যতা-ভব্যতায় মুখোশ আঁটা লুটেরা, বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলা শোষক, প্রতারক-অমানুষদের থামিয়ে দিতে হবে; ব্যস, আর না। সমাজের অসুস্থ, অযৌক্তিক বিকাশের মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে সুস্থ, যুক্তিসংগত, বিজ্ঞানসম্মত বিকাশের গতিমুখ দ্রুত অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে হবে। সমাজের বিপুল সম্ভাবনাগুলোকে পরম দায়িত্বশীলতায়, সুগভীর দেশপ্রেমে সিঞ্চিত করে নিষ্ঠার সঙ্গে বিকশিত করে তুলতে হবে, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তির আনুকূল্যে ও সংহতিতে। তরুণ প্রজন্ম যেন কিছুতেই নতুন দেশ ও সমাজে নিজেদের প্রতিভা বিকাশে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করে বিশ্বসভায় স্থান করে নেয়, সৃষ্টি করতে হবে তার অপারনিশ্চয়তা।
দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধে আমাদের অনেক পরে যারা জয়ী হয়েছে, তারা কেন সমৃদ্ধিতে, বাসযোগ্যতায় আমাদের ছাড়িয়ে যাবে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, মেধায়- সে আত্মজিজ্ঞাসায় আমরা যেন বিশ্বস্ত ও অস্থির থাকি।
আমরা যারা যুদ্ধ করে আজ এখানে এসে অতীত ও বর্তমানের মূল্যায়ন করছি, আমরা যারা আমাদের মূল্যবান বর্তমান উৎসর্গ করে দিয়েছিলাম আজকের নবীন প্রজন্মের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য, তাদের ভালোভাবে মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশে বিপুল সম্ভাবনাময় জীবন নিয়ে গভীর ও অর্থপূর্ণভাবে বাঁচার জন্য তারা যেন পুরো মনপ্রাণ দিয়ে তা উপলব্ধি করতে পারে- সম্মিলিতভাবে শেষ যুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই। ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি উপকূলে ডি-ডের সৈনিকরা সমাধি ক্ষেত্রে সেই তাদের সমাধিফলকে প্রত্যাশাই উৎকীর্ণ করে রেখেছিল- মনে রেখো, আমরা আমাদের মূল্যবান বর্তমান উৎসর্গ করেছি তোমাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য। সেই একই প্রত্যাশা আমাদেরও নবীন প্রজন্মের কাছে।
আমাদের তরুণদের সব ত্যাগ, সংগ্রাম, সাধনা, লড়াই অর্থময় হোক, বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম নিজেদের জীবনকে বর্ণে-গন্ধে-সুষমায়-সুরভিতে ভরে তুলুক। তাদের অর্জন ও ঐশ্বর্যেই এ দেশ অতীতের সব গ্লানি, পশ্চাৎপদতা, অবমাননা সম্পূর্ণ মুছে ফেলে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক এভারেস্টের উচ্চতায়।

২৭.০১.২০১৩

No comments

Powered by Blogger.