কামাল চৌধুরীর কবিতা নিয়ে by বিশ্বজিৎ ঘোষ
কামাল চৌধুরীর জন্ম ২৮ জানুয়ারি, ১৯৫৭। সত্তর দশকে আবির্ভাব। ইতিমধ্যেই, পঁয়ত্রিশ বছরের সাধনায় হয়ে উঠেছেন প্রকৃত এক কবি। নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার গান, তার সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ সংগ্রাম আর সাহস সংক্ষোভের অবারিত উৎস।
মিছিলের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কামালের কবিতা মিছিলময় নয়, সোজাসাপটা কথায় রাজনীতির রাঙা পোস্টার হয়ে ওঠেনি; অথচ তার কবিতার অন্তস্রর্োতে সবসময়ই ক্রিয়াশীল থেকেছে রাজনৈতিক ধারাস্রোত। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে কামাল উচ্চকণ্ঠ নয়, অথচ সেখানে সততই শোনা যায় মিছিলের সমান বয়সী যোদ্ধার দীপ্র কণ্ঠ। সত্তরের অধিকাংশ কবির সঙ্গে কামালের পার্থক্য এখানে। তিনি কবিতায় নির্মাণ করেছেন উজ্জীবনের শব্দভাষ্য, উচ্চারণ করেছেন সন্দীপন মন্ত্র।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কামাল চৌধুরীর কবিতার এক অবিনাশী শিল্প-আয়োজন। তার কবিতার অন্তস্রর্োতে বহমান থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ক্রিয়াশীল থাকে বঙ্গবন্ধুর অমলিন স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা আর বঙ্গবন্ধুর কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা কামালের কবিতাভুবনের উজ্জ্বল এক প্রান্ত। নিচের উদ্ধৃতি সেটাই বলছে_
ক. তিনি আসলেন_ মৃত্যুপুরী থেকে জেগে উঠল দেশ
মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল থেকে আতশবাজির মতো
ফুটতে থাকল উল্লাসের বুলেটবৃষ্টি
বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত প্রতিটি সড়ক
ভরে উঠল ভালোবাসার ফুলে
বাতাসে ধ্বনিত হলো 'স্বাগতম'-চতুর্দিকে উৎসব,
চতুর্দিকে আনন্দ, চতুর্দিকে স্বাধীনতা।
('১০ জানুয়ারি ১৯৭২')
ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে জীবন-অনুধ্যান কামাল চৌধুরীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। কামাল জীবনকে তুলে আনেন ইতিহাসের পটভূমিতে, বাঙালির নৃতাত্তি্বক প্রেক্ষাপটে। এই ইতিহাস-ডানা আছে বলেই সমকালের ধস আর ধ্বংস, নিঃসঙ্গতা আর নির্বেদ, প্রলোভন আর প্রতারণা থেকে কামালের কবিতা আশ্চর্যজনকভাবে মুক্ত। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় তার 'নাটক', 'প্রত্নতত্ত্ব', 'এই দেশ তাঁতিপাড়া থেকে দূরে নয়' প্রভৃতি কবিতার কথা।
কামাল চৌধুরীর কবিতায় যেমন আছে দৈশিকতার ছাপ, তেমন আছে আন্তর্জাতিকতার স্পর্শ। বিশ্ববীক্ষাই স্বকালের খণ্ডায়ন প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে তার কবিতাকে। বিশ্ব নাগরিকতাবোধে ঋদ্ধ কামালের কবিতা আমাদের সাহিত্যের ধারায় ভিন্ন এক স্বাদ সঞ্চার করে। প্রসঙ্গত তার 'জলবায়ু পরিবর্তন :কিয়োটো সম্মেলনের ডায়রি', 'কায়রোর ডায়েরি', 'তাজমহলে বৃষ্টি', 'ক্যাপ্টেন জেমস কুকের উদ্দেশে' প্রভৃতি কবিতার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা যায়। অসামান্য শিল্পসফল এক কবিতা 'ক্যাপ্টেন জেমস কুকের উদ্দেশে'।
মিথ ও পুরাণের সৃষ্টিশীল ব্যবহার তার কবিতার বিশিষ্ট এক প্রবণতা। মিথ কবিকে করে তোলে অন্তর্মুখী, পেঁৗছে দেয় লাখো বছরের অভিজ্ঞতার প্রত্ন-ভুবনে। মিথের অনন্ত গহ্বরে জাগে নির্বাণের স্বর। তার কবিতায় পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে মিথ-পুরাণের নানা অনুষঙ্গ। যেমন,
ক. তোমার আগুনে ভাসে বেহুলার তরী ('ছাত্রী নিবাস')
খ. ঠাকুরমা, তোর গল্প-রাক্ষস
এখনও তাড়াতে পারিনি। ('লালকমল')
গ. মাঝখানে ক্যাসান্ড্রা ক্রসিং, আমাদের পুলসিরাত,
নড়বড়ে সাঁকো। ('দৃষ্টি')
ঘ. আমরা দাঁড়িয়ে আছি মহাভারতের মাঠে, কলিঙ্গযুগের কালে
কারবালায় ও পানিপথে ('নাটক')
কামাল চৌধুরী দীর্ঘ সাধনায় সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক কবিভাষা কাব্যরূপক। সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক কাব্যিক ঢং। যা পাঠক হৃদয়ে পেঁৗছে যায় অবলীলায়, দুরূহতা কোনো বাধা তৈরি করে না। তিনি কবিতা লিখবেন, পেরিয়ে যাবেন কবিতার দীর্ঘ বঙ্কিম পথ, ক্রমেই অঙ্গীকার করবেন সিদ্ধিকে, আর সতত উচ্চারণ করবেন এই গর্বিত পঙ্ক্তিমালা_
দাঁড়িয়ে থাকাও আমার কাজ/বসে থাকাও আমার কাজ...
আমি যখন শুনি/দাঁড়িয়ে থেকেও শুনি/বসে থেকেও শুনি/আর তখন আমার লেখা হাঁটতে থাকে/কবিকে তুমি পথ থেকে সরাতে পারবে না হে ('কবির পথ')
বিশ্বজিৎ ঘোষ :অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কামাল চৌধুরীর কবিতার এক অবিনাশী শিল্প-আয়োজন। তার কবিতার অন্তস্রর্োতে বহমান থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ক্রিয়াশীল থাকে বঙ্গবন্ধুর অমলিন স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা আর বঙ্গবন্ধুর কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা কামালের কবিতাভুবনের উজ্জ্বল এক প্রান্ত। নিচের উদ্ধৃতি সেটাই বলছে_
ক. তিনি আসলেন_ মৃত্যুপুরী থেকে জেগে উঠল দেশ
মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল থেকে আতশবাজির মতো
ফুটতে থাকল উল্লাসের বুলেটবৃষ্টি
বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত প্রতিটি সড়ক
ভরে উঠল ভালোবাসার ফুলে
বাতাসে ধ্বনিত হলো 'স্বাগতম'-চতুর্দিকে উৎসব,
চতুর্দিকে আনন্দ, চতুর্দিকে স্বাধীনতা।
('১০ জানুয়ারি ১৯৭২')
ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে জীবন-অনুধ্যান কামাল চৌধুরীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। কামাল জীবনকে তুলে আনেন ইতিহাসের পটভূমিতে, বাঙালির নৃতাত্তি্বক প্রেক্ষাপটে। এই ইতিহাস-ডানা আছে বলেই সমকালের ধস আর ধ্বংস, নিঃসঙ্গতা আর নির্বেদ, প্রলোভন আর প্রতারণা থেকে কামালের কবিতা আশ্চর্যজনকভাবে মুক্ত। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় তার 'নাটক', 'প্রত্নতত্ত্ব', 'এই দেশ তাঁতিপাড়া থেকে দূরে নয়' প্রভৃতি কবিতার কথা।
কামাল চৌধুরীর কবিতায় যেমন আছে দৈশিকতার ছাপ, তেমন আছে আন্তর্জাতিকতার স্পর্শ। বিশ্ববীক্ষাই স্বকালের খণ্ডায়ন প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে তার কবিতাকে। বিশ্ব নাগরিকতাবোধে ঋদ্ধ কামালের কবিতা আমাদের সাহিত্যের ধারায় ভিন্ন এক স্বাদ সঞ্চার করে। প্রসঙ্গত তার 'জলবায়ু পরিবর্তন :কিয়োটো সম্মেলনের ডায়রি', 'কায়রোর ডায়েরি', 'তাজমহলে বৃষ্টি', 'ক্যাপ্টেন জেমস কুকের উদ্দেশে' প্রভৃতি কবিতার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা যায়। অসামান্য শিল্পসফল এক কবিতা 'ক্যাপ্টেন জেমস কুকের উদ্দেশে'।
মিথ ও পুরাণের সৃষ্টিশীল ব্যবহার তার কবিতার বিশিষ্ট এক প্রবণতা। মিথ কবিকে করে তোলে অন্তর্মুখী, পেঁৗছে দেয় লাখো বছরের অভিজ্ঞতার প্রত্ন-ভুবনে। মিথের অনন্ত গহ্বরে জাগে নির্বাণের স্বর। তার কবিতায় পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে মিথ-পুরাণের নানা অনুষঙ্গ। যেমন,
ক. তোমার আগুনে ভাসে বেহুলার তরী ('ছাত্রী নিবাস')
খ. ঠাকুরমা, তোর গল্প-রাক্ষস
এখনও তাড়াতে পারিনি। ('লালকমল')
গ. মাঝখানে ক্যাসান্ড্রা ক্রসিং, আমাদের পুলসিরাত,
নড়বড়ে সাঁকো। ('দৃষ্টি')
ঘ. আমরা দাঁড়িয়ে আছি মহাভারতের মাঠে, কলিঙ্গযুগের কালে
কারবালায় ও পানিপথে ('নাটক')
কামাল চৌধুরী দীর্ঘ সাধনায় সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক কবিভাষা কাব্যরূপক। সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক কাব্যিক ঢং। যা পাঠক হৃদয়ে পেঁৗছে যায় অবলীলায়, দুরূহতা কোনো বাধা তৈরি করে না। তিনি কবিতা লিখবেন, পেরিয়ে যাবেন কবিতার দীর্ঘ বঙ্কিম পথ, ক্রমেই অঙ্গীকার করবেন সিদ্ধিকে, আর সতত উচ্চারণ করবেন এই গর্বিত পঙ্ক্তিমালা_
দাঁড়িয়ে থাকাও আমার কাজ/বসে থাকাও আমার কাজ...
আমি যখন শুনি/দাঁড়িয়ে থেকেও শুনি/বসে থেকেও শুনি/আর তখন আমার লেখা হাঁটতে থাকে/কবিকে তুমি পথ থেকে সরাতে পারবে না হে ('কবির পথ')
বিশ্বজিৎ ঘোষ :অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments