ব্যক্তিত্ব-'রহস্যময়' বাংলাদেশে এক ভিনদেশি by শেখ আবদুস সালাম
২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা ও তার গ্রেফতারের পরপরই ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। আর এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ যুদ্ধ। আস্তে আস্তে রূপ নেয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে।
দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধে কিছু কুলাঙ্গার ছাড়া অংশগ্রহণ করে সাড়ে ৭ কোটি সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাজ করে মূলত চার ধরনের ডিফেন্স লাইন_ ১. সাধারণ মানুষ; ২. সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা (পরে অংশ নেয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী); ৩. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম এবং ৪. দেশ-বিদেশের অসংখ্য বিবেকবান মানুষ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের মাত্র ৪-৫ বছরের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে আবারও শুরু হয় বাংলাদেশের পেছন যাত্রা। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক ও স্বৈরশাসকরা (কখনওবা গণতান্ত্রিক লেবাসে) চালাতে থাকে স্বৈরশাসন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন এবং চেতনা বিস্মৃত হতে থাকে ক্রমেই। অবশেষে সুদীর্ঘ সেই অন্ধকার রাজনীতির রজনী পার করে মাত্র কয়েক বছর হলো বাংলাদেশে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনের চর্চার । ৪০ বছর পর এ দেশের নতুন প্রজন্মের বহু জিজ্ঞাসা তারা আদায় করে নিতে শুরু করেছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ৪০ বছর ধরে তারা প্রশ্ন করেছে_ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের লাশ কোথায়? কারা তাদের হত্যা করেছিল? আমাদের জাতির জনককে ১৯৭৫ সালে হত্যা করে লাখো-কোটি অনাগত বাঙালি প্রজন্মের মনের কোন প্রকোষ্ঠে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল? ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবনদানকারী শহীদদের জায়গা কোথায়? মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠা আমাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার স্রোতধারা থমকে গেল কেন? আমাদের মানুষের সর্বস্ব ত্যাগের পাশাপাশি বিশ্বের নানা কোণের আরও যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তারা কারা, কোথায়? এমনই সব অসংখ্য প্রশ্ন।
সম্প্রতি স্বাধীনতার ৪১ বছর পূর্তিতে সম্মাননা জানানো হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৬০ বিদেশি বন্ধুকে। এরা কেউ প্রয়াত, কেউ জীবিত। অনেকেই আজ জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে, কেউবা আজও উজ্জ্বল তাদের দেশ এবং দুনিয়াজুড়ে। গত কয়েকদিন তাদেরই একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নাগরিক সৈয়দ আসিক শাহকার_ তার চোখে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য জানতে পেরেছি। সে বয়ানটি পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্যই আমার এ লেখাটি। সৈয়দ আসিক শাহকার বর্তমান সুইডেনের নাগরিক, সে দেশের একজন বিচারপতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাক সরকারের গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তিনি কবিতা লেখা, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। তাকে পাকিস্তান সরকার 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠায়। অতঃপর জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৭৭ সালে তিনি সুইডেন চলে যান। এ বছর বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় এনে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেছে। ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯ ডিসেম্বর এনটিভিতে ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং প্রোগ্রামে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি আসিক শাহকার জানান, বাংলাদেশে এই আগমন তার কাছে মনে হয়েছে 'ধ ঢ়রষমৎরসধমব ঃড় উযধশধ-ধ ংধপৎবফ ষধহফ্থ. এ সময় তিনি বাংলাদেশের অবস্থান ও এগিয়ে চলাকে সমর্থন করে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বাংলাদেশকে উল্লেখ করেন, 'ধ যড়ষু ষধহফ ড়ভ ফবসড়পৎধপু, ধ যড়ষু ষধহফ ড়ভ ংবপঁষধৎরংস' হিসেবে। এনটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এ দেশে বসবাস করার আগ্রহের কথাও ব্যক্ত করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান দুরবস্থার কথা আমরা সবাই জানি। দেশটিতে ইসলামের নামে রাস্তাঘাটে এমনকি মসজিদে বোমা মেরে মানুষ মারা, নারী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত করতে মালালার ওপর গুলিবর্ষণ, ক্রিকেট মাঠে বোমা-গুলি এসব পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সংকটকে কতটা বিপদগ্রস্ত করে তুলছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারি বৈকি। আর এসব কারণে পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী কাদির খান সম্প্রতি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন যে, 'পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা ১৯৭১ সালের চেয়েও খারাপ, ... সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন আমরা (পাকিস্তান) আবারও ভেঙে ভাগ হয়ে যাবে।'
অন্যদিকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে একটি সম্ভাবনাময় দেশ। গত কয়েক বছরে সারাবিশ্বে মন্দা অবস্থা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ সময় ৬ শতাংশের বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১৮ গুণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন বিশ্বের কাছে আজ একটি 'রহস্যময়' বিষয়। আমরা আশা করব সরকার, বিরোধী দল সবাই একত্রে এ 'রহস্যময়' উন্নয়ন চাকাকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশ্ব অবাক হয়ে দেখবে বাংলাদেশ নামক সেই তলাবিহীন ঝুড়িটি আজ কতটা পরিপূর্ণ। বিচারপতি আসিক শাহকারের মতো সারা বিশ্বের মানুষ অনুপ্রাণিত হবে আর অন্তর থেকে গভীর স্পর্শ নিয়ে বলবে, 'বাংলাদেশ তুমি এগিয়ে যাও_ তোমাকে অভিবাদন।'১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের মাত্র ৪-৫ বছরের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে আবারও শুরু হয় বাংলাদেশের পেছন যাত্রা। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক ও স্বৈরশাসকরা (কখনওবা গণতান্ত্রিক লেবাসে) চালাতে থাকে স্বৈরশাসন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন এবং চেতনা বিস্মৃত হতে থাকে ক্রমেই। অবশেষে সুদীর্ঘ সেই অন্ধকার রাজনীতির রজনী পার করে মাত্র কয়েক বছর হলো বাংলাদেশে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনের চর্চার । ৪০ বছর পর এ দেশের নতুন প্রজন্মের বহু জিজ্ঞাসা তারা আদায় করে নিতে শুরু করেছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ৪০ বছর ধরে তারা প্রশ্ন করেছে_ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের লাশ কোথায়? কারা তাদের হত্যা করেছিল? আমাদের জাতির জনককে ১৯৭৫ সালে হত্যা করে লাখো-কোটি অনাগত বাঙালি প্রজন্মের মনের কোন প্রকোষ্ঠে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল? ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবনদানকারী শহীদদের জায়গা কোথায়? মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠা আমাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার স্রোতধারা থমকে গেল কেন? আমাদের মানুষের সর্বস্ব ত্যাগের পাশাপাশি বিশ্বের নানা কোণের আরও যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তারা কারা, কোথায়? এমনই সব অসংখ্য প্রশ্ন।
সম্প্রতি স্বাধীনতার ৪১ বছর পূর্তিতে সম্মাননা জানানো হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৬০ বিদেশি বন্ধুকে। এরা কেউ প্রয়াত, কেউ জীবিত। অনেকেই আজ জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে, কেউবা আজও উজ্জ্বল তাদের দেশ এবং দুনিয়াজুড়ে। গত কয়েকদিন তাদেরই একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নাগরিক সৈয়দ আসিক শাহকার_ তার চোখে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য জানতে পেরেছি। সে বয়ানটি পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্যই আমার এ লেখাটি। সৈয়দ আসিক শাহকার বর্তমান সুইডেনের নাগরিক, সে দেশের একজন বিচারপতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাক সরকারের গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তিনি কবিতা লেখা, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। তাকে পাকিস্তান সরকার 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠায়। অতঃপর জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৭৭ সালে তিনি সুইডেন চলে যান। এ বছর বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় এনে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেছে। ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯ ডিসেম্বর এনটিভিতে ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং প্রোগ্রামে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি আসিক শাহকার জানান, বাংলাদেশে এই আগমন তার কাছে মনে হয়েছে 'ধ ঢ়রষমৎরসধমব ঃড় উযধশধ-ধ ংধপৎবফ ষধহফ্থ. এ সময় তিনি বাংলাদেশের অবস্থান ও এগিয়ে চলাকে সমর্থন করে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বাংলাদেশকে উল্লেখ করেন, 'ধ যড়ষু ষধহফ ড়ভ ফবসড়পৎধপু, ধ যড়ষু ষধহফ ড়ভ ংবপঁষধৎরংস' হিসেবে। এনটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এ দেশে বসবাস করার আগ্রহের কথাও ব্যক্ত করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান দুরবস্থার কথা আমরা সবাই জানি। দেশটিতে ইসলামের নামে রাস্তাঘাটে এমনকি মসজিদে বোমা মেরে মানুষ মারা, নারী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত করতে মালালার ওপর গুলিবর্ষণ, ক্রিকেট মাঠে বোমা-গুলি এসব পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সংকটকে কতটা বিপদগ্রস্ত করে তুলছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারি বৈকি। আর এসব কারণে পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী কাদির খান সম্প্রতি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন যে, 'পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা ১৯৭১ সালের চেয়েও খারাপ, ... সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন আমরা (পাকিস্তান) আবারও ভেঙে ভাগ হয়ে যাবে।'
ড. শেখ আবদুুস সালাম :অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
skasalam@gmail.com
No comments