শিক্ষা জাতীয়করণ করা হলে বছরে ব্যয় হবে ৪০ হাজার কোটি by বিভাষ বাড়ৈ
বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা জাতীয়করণের সরকারের কোন টাকা লাগবে না বলে শিক্ষক নেতারা দাবি করলেও বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
জাতীয়করণ বা সরকারীকরণ করা হলে সারাদেশের ৩৫ হাজার ৩৯৬টি এমপিওভুক্ত এবং নন-এমপিও (স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বছরে সরকারের ব্যয় হবে ৪০ হাজার ১৮৯ কোটি টাকারও বেশি। কেবল তাই নয়, এই টাকার পরেও যোগান দিতে হবে সারাদেশের শিক্ষকদের পেনশনের বিশাল অঙ্কের টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয়করণ সংক্রান্ত এক পর্যালোচনা রিপোর্টে এমন স্পষ্ট তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। এমন এক বাস্তবতায় শিক্ষক সংগঠনের জাতীয়করণ দাবির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সবার আগে তা নিশ্চিত করা জরুরী। এ দাবি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সঙ্গতিপূর্ণ নয় একটি দরিদ্র এ দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গেও।এদিকে শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন সংগঠনের ধর্মঘটের তীব্র সমালোচনা করে শিক্ষা জাতীয়করণে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। অন্যদিকে চাকরি জাতীয়করণ না হলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েও নানা বিতর্কের মুখে তা প্রত্যাহার করে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা ছেড়েছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের এক অংশের নেতারা। পঞ্চম দিনের মতো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থানরত শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি দিতে সংসদ ভবনে গিয়ে সাংসদদের স্মারকলিপি দিয়েছে। চেয়ারম্যান সেলিম ভূইয়া বলেছেন, আগামী ৩০ মার্চের মধ্যে জাতীয়করণের ঘোষণা না দিলে ৩১ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট। মহাসমাবেশে বাধা দিলে ১ এপ্রিল সারাবাংলাদেশে শিক্ষকরা হরতাল পালন করবেন বলেও হুমকি দেন সেলিম ভূঁইয়া। বলেন, ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে আমরা অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সরকার যদি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সরকার পরিবর্তন করে চাকরি জাতীয়করণ করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন বিএনপিপন্থী এই নেতা। এর আগে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষাঙ্গনে ধর্মঘটের তীব্র সমালোচনা করে শিক্ষা জাতীয়করণে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, কলেজ শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক আসাদুল হক, সংযুক্ত শিক্ষক সমিতির মাহবুর-উল-আলম তালুকদার, সাচিবিক বিদ্যা সমিতির অধ্যাপক রাকিবুল হক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির খান মোশাররফ হোসেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক সিরাজুল হক আলো ও কর্মচারী ফেডারেশনের এক আরজু। অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করলেও জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট ধর্মঘট আহ্বান করেনি। কারণ বিরাজিত পরিস্থিতিতে আমরা উপলব্ধি করি যে, ধর্মঘট না করে যা পাওয়া যাবে, ধর্মঘট করেও এ পর্যায়ে এর বেশি অর্জন সম্ভব হবে না। সে জন্য ধর্মঘটের মতো আন্দোলনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি করা অসমীচীন বিবেচনায় ফ্রন্ট আন্দোলনের কর্মসূচী নিলেও ধর্মঘট আহ্বান না করে শিক্ষক কর্মচারীদের পেশাগত সংগঠনগুলোর মোর্চা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে। আমরা মনে করি কেবল চাকরি নয়, বরং শিক্ষা জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক কর্মচারীসহ শিক্ষা জাতীয়করণ বাস্তবসম্মত। এর অনেকটাই ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। কেন, কিভাবে শিক্ষা জাতীয়করণ সম্ভব তার পক্ষেও যুক্তি দেন শিক্ষক নেতা। বলেন, ফ্রন্ট বিশ্বাস করে প্রাথমিক পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ সময়ের দাবি। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাবিত বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ সুবিধা জাতীয়করণ কর্মসূচীর অধীনে প্রদানের ঘোষণা দিলে তা’ সমগ্র শিক্ষক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হবে। সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। শিক্ষক কর্মচারীরাও জাতীয়করণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি এক সঙ্গে বাস্তবায়নের কথা বলছেন না। তিনি আরও বলেন, ঘোষিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সুবিধা প্রদান প্রসঙ্গে ফ্রন্টের অবস্থান উল্লেখ করা হয়েছে। তবে একটি মহলের বক্তব্য ছিল অসৌজন্যমূলক। ভাষা ছিল অশালীন। আশানুরূপ না হলে আশানুরূপ করার প্রস্তাব দেয়া যায়। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলন-সংগ্রামের সহযাত্রী, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো একজন সৎ, সামর্থ্যরে মধ্যে শিক্ষক কর্মচারীদেরে জন্য যতটুক সম্ভব করতে আন্তরিক মানুষকে গালমন্দ করা ছিল অশোভন, অশিক্ষক সুলভ। আমরা এর নিন্দা জানাই। সংগঠনের নতুন কর্মসূচী সম্পর্কে বলা হয়, ৩০ জানুয়ারি উপজেলায় এবং ১ ফেব্রুয়ারি জেলায় মিছিল। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি (এসএসসি/সমমানের পরীক্ষা চলাকালীন কলেজগুলোতে) পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সভা, এছাড়া পর্যাক্রমে আছে ম্যানেজিং কমিটি/ গবর্নিং বডির সঙ্গে বৈঠক, বার এ্যাসোসিয়েশন, মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক, শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক, এসএসসি পরীক্ষার পর প্রতি জেলায় শহীদ মিনারে প্রতীক অনশন, এইচএসসি পরীক্ষার পর একদিন সকল জেলায় পূর্ণ দিবস ধর্মঘট ইত্যাদি।
এদিকে জাতীয়করণের জন্য সরকারের কোন টাকা লাগবে না বলে শিক্ষক নেতারা দাবি করলেও দেখা গেছে, জাতীয়করণে বছরে সরকারের ব্যায় হবে ৪০ হাজার ১৮৯ কোটি টাকারও বেশি। এই টাকার পরেও যোগান দিতে হবে সারাদেশের শিক্ষকদের পেনশনের বিশাল অংকের টাকা। এর মধ্যে বর্তমানে মাত্র এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকার বছরে ব্যয় করে চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অথচ শিক্ষক সংগঠনগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দাবি করছেন, জাতীয়করণ করলে সরকারের কোন অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো- প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে মাসিক বেতনভাতা বাবদ যে পরিমাণ ফি আদায় করছে, তা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়া হবে। এই অর্থের সঙ্গে এমপিও খাতের অর্থ দিয়েই জাতীয়করণের পর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার আর্থিক সংশ্লেষ করা সম্ভব হবে। জাতীয়করণ করলে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে না- শিক্ষকদের এমন দাবি প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে। এতে দেখা গেছে, সারাদেশে মোট ৩৫ হাজার ৩৯৬টি এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। মাউশি ও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত সাধারণ স্কুল ১৬ হাজার ৮৬টি ও কারিগরি স্কুল আছে ৮৫৫টি, সাধারণ কলেজ ২ হাজার ৩৬৩টি ও কারিগরি কলেজ আছে ৭২৭টি এবং মাউশির অধীনে এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা আছে সাত হাজার ৫৯৮টি ও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে মাদ্রাসা আছে ১৮টি। আর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাউশির অধীনে স্কুল আছে ২ হাজার ৮৫৭টি, কলেজ ৯৫৩টি ও মাদ্রাসা আছে এক হাজার ৯২৩টি। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুল আছে এক হাজার ২১৬টি এবং কলেজ আছে ৮০০টি। দেশে মোট সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ৩১৭টি। এগুলোর জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ আছে ৩০৩ কোটি ৯৭ লাখ ৬১ হাজার টাকা। পেনশন ছাড়া ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য গড়ে বার্ষিক ব্যয় হয় ৯৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৫১ টাকা। সরকারী কলেজ আছে ২৫২টি। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ আছে ৫৬৬ কোটি ৭৪ লাখ ১১ হাজার টাকা। অর্থাৎ গড়ে একটি কলেজের বার্ষিক ব্যয় দাঁড়ায় দুই কোটি ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭২৬ টাকা।
এই হিসেবে ৩৫ হাজার ৩৯৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে প্রতি বছর সরকারের ব্যয় হবে মোট ৪০ হাজার ১৮৯ কোটি ৫০ লাখ ৭৩ হাজার ৫২১ টাকা। আর বর্তমানে এমপিওভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে সরকারের খরচ হচ্ছে ৪১০ থেকে ৪২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় এমপিও খাতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমীর (নায়েম) মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেছেন, সাড়ে তিন হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা জাতীয়করণ সহজ বিষয় নয়। এটি অবাস্তব দাবি। তিনি বলেন, বুঝতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সবার আগে তা নিশ্চিত করা জরুরী। বেসরকারী উদ্যোগে নিজের স্বার্থে দেশের এখানে সেখানে প্রতিষ্ঠান হয়েছে বছরের পর বছর। এখন তার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সরকারের ঘাড়ে। অন্যদিকে আন্দোলন যখন স্তিমিত হচ্ছে ঠিক তখন আন্দোলনরত শিক্ষকদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়ে নতুন জটিলতায় সৃষ্টি করেছে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। নির্দেশনার এক চিঠি জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারসমর্থক শিক্ষক নেতারা। তারা অবিলম্বে মাউশির এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন। শিক্ষকরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ নিলে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা আরও বাড়বে। ইতোমধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষকদের মাঝে।
No comments