১৩ লাখ একর সরকারী জমি বেদখল, তবে দখলদারদের কোন তালিকা নেই- ভূমি দস্যুতা সমাচার ॥ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-১ by রশিদ মামুন
সারাদেশে পাল্লা দিয়ে চলছে ভূমিদস্যুতা। বেদখল জমির পরিমাণ জানলেও সরকারের কাছে ভূমিদস্যুদের হালনাগাদ কোন তালিকা নেই। অভিযোগ রয়েছে, বেদখল জমি উদ্ধারে যথেষ্ট তৎপর নয় জেলা প্রশাসন।
অনেক ক্ষেত্রে জমি দখল করে উল্টো সরকারের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দিচ্ছে ভূমিখেকোরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের গাফিলতিতে সরকারই মামলায় হারছে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, শুধুমাত্র হাইকোর্টে তাদের ১০ হাজার মামলা চলছে।ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হিরা সংসদকে জানিয়েছেন, সারাদেশে সরকারের বেদখল ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ একরের ওপর। তবে এ জমি কারা দখল করে রেখেছে তার কোন হালনাগাদ তালিকা নেই সরকারের কাছে। জাতীয় কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর ভূমিমন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, জেলা প্রশাসকদের কাছে দখলদারদের তালিকা রয়েছে। তবে দেশের সকল বিভাগীয় শহরের জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনারদের দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কাছে দখলদারদের কোন তালিকা নেই। স্ব স্ব এসিল্যান্ড এবং তহসিলদার অফিস ভূমিদসু্যদের তালিকা সংরৰণ করে বলে জানান তারা।
ঢাকার জেলা প্রশাসক জিলস্নুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের কাছে দখলদারদের কোন তালিকা নেই। তবে সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা জেলার নদী দখলদার হিসেবে তাঁরা ৪ হাজার ২১ জনকে চিহ্নিত করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোট খাসজমি থেকে যে পরিমাণ জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট জমিকে বেদখল দেখানো হচ্ছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা জেলায় ১০ সার্কেলে ৭ হাজার ২৮৬ একর জমি বেদখল রয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালিতে ২২ একর, তেজগাঁও সার্কেলে ৩৩২ দশমিক ৩৯ একর, ডেমরায় ২০৪ দশমিক ৭৪ একর, ধানম-িতে ৮৭ দশমিক ৪৮ একর, কেরানীগঞ্জে ২ হাজার ৬৭ একর, ধামরাইয়ে ১৮২ দশমিক ৯৫ একর, সাভারে ৮৪১ দশমিক ৪২ একর, নবাবগঞ্জে ৪৯১ একর, দোহারে ৩ হাজার ১৫ একর জমি বেদখল রয়েছে।
কারা এ জমি দখল করে রেখেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন তাদের নাম জানাতে পারেনি। এসব জমির দখলদাররা সরকারের বিরম্নদ্ধে মামলা করেছে জানালেও কতটি মামলা রয়েছে তারও সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি বছরের পর বছর বেদখল থাকলেও উদ্ধার অভিযানে কোন গতি নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ ৰেত্রে ভূমি অফিসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে দখলদারদের গভীর সম্পর্ক থাকার অভিযোগও পাওয়া গেছে। বন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বনবিভাগের ১১ হাজার ৬৩৯ একর জমি বেদখল রয়েছে। দখলকারীরা ৫৩৯টি মামলা দায়েরের মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযানকে থামিয়ে দিয়েছে। বন মন্ত্রণালয় ঢাকা ও গাজীপুর বনের জমি দখলকারী ৬৯ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। ভূমিদসু্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে রোশেয়া স্পিনিং মিলস (৪.৬৩ একর), পৃথী পোল্ট্রি (এক একর), আরএকে সিরামিকস (৪.২৬ একর), রাজ্জাকুল হায়দার অরণ্য কুটির (৩.৪২ একর), ইকো কটন মিলস (৫.৬২ একর), অটো স্পিনিং মিলস (২.১৪ একর), মেসার্স হংকং মাজজালা টেক্সটাইল (২.৫৭ একর), জয়নাল আবেদীন টিটু কমপেস্নক্স (১.৩৭ একর), ভাওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ (৪.০৪ একর), জেসান এগ্রোভেট লিঃ (দশমিক ৫৫ একর), হোতাপাড়া গার্মেন্টস লিঃ (দশমিক ০২ একর), সানপাওয়ার সিরামিকস লিঃ (দশমিক ৫০ একর), করোনি কম্পোজিট লিঃ (এক একর), শামসুদ্দিন স্পিনিং (৭.১৬ একর), রহমত টেক্সটাইল (৬.৭২ একর), হাইড্রো অক্সাইড লিঃ (৩.৩০ একর), হামিদ স্পিনিং (৬.৭৮ একর), এনএম টেক্সটাইল (১.৬৮ একর), কোকোলা ফুডস (১২.৩৫ একর), সোলার সিরামিক (দশমিক ৭০ একর), হাজী ইসলাম উদ্দিন স্পিনিং (দশমিক ৮০ একর), রয়েল গ্রীন প্রডাক্টস (৬.২৮ একর)। এছাড়া ৪৭ ব্যক্তি বনের জমি দখল করে আছে। এরা দশমিক দশ একর থেকে আড়াই একর পর্যনত্ম জমি দখল করে আছে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মিহির কানত্মি মজুমদার জানিয়েছেন, এদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকার ৪ হাজার ২১টি নদী দখলদারের বিরম্নদ্ধে এপ্রিলে অভিযান শুরম্ন করা হবে বলে জানিয়েছে বিআইডবিস্নউটিএ।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৪৭ হাজার ৮৮৬ একর। এ বিভাগে অর্পিত এক লাখ ২৯ হাজার ৪১৮ একর, পরিত্যক্ত ১৩৭ একর এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৬৪৮ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। রাজশাহী বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৫০৪ একর। এ বিভাগে অর্পিত ৪৭ হাজার ৩২৪ একর, পরিত্যক্ত ৩৪০ একর এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৯০ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৮ একর। এ বিভাগে অর্পিত ৪৮ হাজার ৩০৭ একর, পরিত্যক্ত ৭০১ একর এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৪ হাজার ২১৫ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে।
খুলনা বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৬০৪ একর। এ বিভাগে অর্পিত ৭৯ হাজার ১০৩ একর, পরিত্যক্ত ৪৯ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। বরিশাল বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৯৭০ একর। এ বিভাগে অর্পিত ৩৪ হাজার ৩৬২ একর এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৮৭১ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। সিলেট বিভাগে কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমাণ ১৯ হাজার ১৭০ একর। এ বিভাগে অর্পিত ৩৫ হাজার ৯০৯ একর, পরিত্যক্ত ৩ একর এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৮৭১ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে বেদখল জমি উদ্ধার করতে গেলে সরকারের বিরম্নদ্ধে মামলা ঠুকে দিচ্ছে ভূমিদসু্যরা। প্রায় সবৰেত্রে হাইকোর্ট থেকে রম্নল ও স্থগিতাদেশ নিয়ে সরকারী উদ্ধার তৎপরতায় বাধা সৃষ্টি করছে ভূমিদসু্যরা। এছাড়া জেলা পর্যায়ে সরকারের সাথে হেরে যাওয়া মামলাগুলোতে তারা হাইকোর্টে আপীল করছে। হাইকোর্টে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১০ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মামলা পরিচালনার ৰেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনত্মরিকতার অভাবে সরকার মামলায় হারছে। এৰেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সমন্বয়হীনতার অভিযোগও রয়েছে।
No comments