অদক্ষতার খেসারত বিমানের by আজাদ সুলায়মান
সঠিক সময়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্বপালন করতে না পারার খেসারত দিয়েছে বিমানের ঢাকা-জেদ্দা ও ঢাকা-রিয়াদের ফ্লাইট। পূর্ণ আসন ভর্তি যাত্রী নিয়ে রানওয়ে থেকে ফিরে আসতে হয়েছে দুটো ফ্লাইটকেই।
সতের ঘণ্টা পর ফ্লাইট দুটো ঢাকা ছেড়ে যায়। এ দুটো ফ্লাইট সিডিউল মতো যেতে না পারায় রিয়াদ ও জেদ্দা থেকেও ঢাকাগামী একইভাবে ১৭ ঘণ্টার বিলম্বের শিকার হতে হয়েছে। উভয় দিকের যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে হোটেলে। ঢাকা-জেদ্দা ও রিয়াদের যাত্রীদের হোটেলে রাখার বাবদ খরচ গুণতে হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকার মতো। বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বপালনে সীমাহীন উদাসীনতা ও গাফিলতির এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ার আর কোন এয়ারলাইন্সে নজিরবিহীন। জানতে চাইলে এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ বলেছেনÑ শুনেছি। কেন হয়েছে তা এ মূহূর্তে বলা যাবে না। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তারপর বলা যাবে।রিয়াদগামী ফ্লাইটের যাত্রী মোশাররফ জানান, শুক্রবার রাত ১০টা ৫ মিনিট ও ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে যথাক্রমে রিয়াদ ও জেদ্দার দুটো ফ্লাইট ছিল। দুটো ফ্লাইটই ছিল বোয়িং ৭৭৭। রিয়াদগামী বিমানে যাত্রী ছিল ৪১৯ জন, জেদ্দাগামী বিমানে সাড়ে ৩ শতাধিক। যাত্রীরা সবাই যার যার আসনে বসার পর ক্যাপ্টেন ঘোষণাও দেনÑ এখনই টেক অফ হচ্ছে। সবাই সিট বেল্ট বেধে প্রস্তুত হন। তারপর ফ্লাইট দুটো বোর্ডিং ব্রিজ থেকে বে-আউট করা হয়। রানওয়ের কাছাকাছি যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন দেখতে পান রানওয়ের লাইট সব নিভে গেছে। এতে আর টেক অফ করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়েই দুটো ফ্লাইটকে ফিরে আসতে হয়। সব যাত্রীকে অফলোড করে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরার হোটেলে। সেখানে রাত কাটাতে হয় তাদের। পরদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় জেদ্দা ও সাড়ে ৪টায় রিয়াদের ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যায়। এ দুটো ফ্লাইট ১৭ ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকা ছাড়ায় ওদিকে রিয়াদ ও জেদ্দা থেকে ঢাকাগামী প্রায় আর ৮ শতাধিক যাত্রীও এর শিকার হন। তারাও যথাসময়ে বিমান বন্দরে উপস্থিতও ছিল। এ দুটো ফ্লাইট সময়মতো যেতে না পারায় সেখানকার যাত্রীদেরও বোর্ডিং কার্ড দেয়ার পরও বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হোটেলে।
বিমানের এ্যাকাউন্ট বিভাগ থেকে জানা যায়, ঢাকা-জেদ্দা ও রিয়াদে এ দুটো ফ্লাইট দিয়ে প্রায় দেড় হাজার যাত্রী আনা-নেয়ার সিডিউল ছিল। তাদের সবাইকে ফ্লাইট বিলম্বের কারণে নিতে হয়েছে হোটেলে। যার বিল প্রায় কোটি টাকার মতো। এর সবটাই বিমানকেই পরিশোধ করতে হয়েছে। এমনিতেই আর্থিক দৈন্যদশায় বিমানের যেখানে রক্তক্ষরণ হচ্ছে- সেখানে কেন এভাবে কোটি টাকার গচ্চা দিতে হলো- এমন প্রশ্ন সাধারণ বিমান কর্মীদের। কেন এমন নজিরবিহীন গাফিলতি ও উদাসীনতা? জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা যায়Ñ ফ্লাইট দুটো যখন রানওয়েতে বে-আউট হয় তখন রাত এগারটা বেজে গেছে। এ সময় রানওয়ে সংস্কারের জন্য ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে রাত এগারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত রানওয়ের সংস্কার কাজ চলায় সব ধরনের জাহাজ ওঠানামা বন্ধ থাকে।
সূত্র মতে, ফ্লাইট দুটোর ঢাকা ছাড়ার সিডিউল ছিল রাত ১০টা ও সোয়া ১০টায়। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যেই দুটো ফ্লাইট টেক অফ করতে হবে। কিন্তু যখন টেক অফ করতে গেছে- তখন রাত এগারটা বেজে গেছে। ততোক্ষণে রানওয়ের বাতিও নিভানো হয়ে গেছে।
কেন সঠিক সময়ে টেক অফ করা সম্ভব হয়নি জানতে চাইলে বিমানের স্টেশন ম্যানেজার গোলাম মোর্শেদের দায় চাপিয়েছেন ইমিগ্রেশানের কাজের চাপের ওপর। বলেছেন- ইমিগ্রেশান ঠিক সময়ে সব যাত্রীর পাসপোর্ট ভিসা চেক করে শেষ করতে পারেননি। তাই যাত্রীরা রাত দশটার পরও জাহাজে ওঠেছেন।
এ ব্যাপারে ইমিগ্রেশনের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেছেন- বিমানের দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিমান সঠিক সময়ে চেকইন করতে পারেনি। তারা ব্যস্ত ছিল পরদিনের পিকনিক নিয়ে। এর বড় প্রমাণ শনিবার দিন ছিল বিমান অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের পিকনিক। এ জন্য সবাই বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ফেলে বিমানের কোন অফিসার কর্মস্থলে যোগ দেয়নি। শনিবার দিন হযরত শাহ্জালাল বিমানবন্দরে বিমানের পক্ষে শুধু কর্মচারীরা কাজ করেছে। একজন অফিসারও ছিল না। অথচ প্রতি শিফটে বিমানের ১২ জন অফিসার বিমানবন্দরে ডিউটি করার রোস্টার রয়েছে। ফলে সব কাজ চালিয়েছে কর্মচারীরা। জানতে চাইলে এমডি মোসাদ্দিক আহমদ বলেন, এটা শুনিনি। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনেছি। এটাও খতিয়ে দেখা হবে। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এ অভিযোগ ঠিক নয়। বোয়ার সভাপতি মাজহার জানিয়েছেন, দু’ শিফটের মাত্র দুজন করে অফিসার পিকনিকে যোগ দিয়েছেন। বাকি সবাই ছিলেন। এমনকি শিফট প্রধানদ্বয়ও উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জানার জন্য রবিবার সকালে বিমান অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাজহার ইসলামকে তাঁর অফিসে গিয়েও পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইলটি দিনভর বন্ধ ছিল।
এ দিকে ফ্লাইট দুটো কেন সময় মতো শুক্রবার রাতে ঢাকা ছাড়তে পারেনি জানতে চাইলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং শাখার একজন কর্মচারী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে বিমান যাত্রীদের চেকইন করতে পারেনি। দুটো ফ্লাইট একসঙ্গে চেক করতে হলে যতটা ক্ষিপ্রগতি ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হয় বিমানের দায়িত্ববান কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেভাবে কাজ করতে পারেনি। যে কারণে ফ্লাইটের যাত্রীদের দশটা পর্যন্ত চেক করতে দেখা গেছে। তখন ইমিগ্রেশানের ওপর তো কিছুটা চাপ পড়বেই। আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে এক ঘণ্টা আগে চেকইন শেষ করতে হয়। বিমান সেটা করতে পারেনি।
এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্টেশন ম্যানেজার গোলাম মোর্শেদ বলেন, রাত সাড়ে ৯টা ৩৬ মিনিটে চেকইন কাউন্টার বন্ধ করা হয়েছে।
দায়িত্বা পালনে বিমান কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও উদাসীনতা সম্পর্কে সিভিল এ্যাভিয়েশানের একজন পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, বিমান যদি রাত পৌনে এগারটার দিকেও ফোন করে সিভিল এ্যাভিয়েশানের কাছে রানওয়ে আরও ১৫ মিনিট খোলা রাখার অনুরোধ করত তাহলে সেটাও বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এমন একটা সহজ কাজও বিমান করতে পারেনি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। শুক্রবার রাতে এ দুটো ফ্লাইিট ছাড়ার চার ঘণ্টা আগে থেকে চেকইন শুরু করা হয়। তারপর কেন নির্দিষ্ট সময়ে সব যাত্রীর চেকইন শেষ করা যায়নি তা রহস্যজনক।
No comments