পরিবেশ-পাখিরা আবার ফিরে এসেছে by মো. আনোয়ার হোসেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখিমেলা হয়ে গেল জানুয়ারি মাসের শেষ শুক্রবার। এবারে যা ছিল ২৫ জানুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার আন্তরিক প্রয়াস ছিল এ আয়োজন সফল করার। তবে বিশেষভাবে বলতে হয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগ ও সক্রিয়তার কথা।
আমাদের সবার প্রিয় এ ক্যাম্পাসে সুন্দর জলাশয় রয়েছে অনেকগুলো। এখানের লাল শাপলা চোখ জুড়ায়। জলাশয়ের পাড় ও ক্যাম্পাসের নানা স্থানের বৃক্ষরাজির সৌন্দর্যও অতুলন। আর শীতের এই সময়ে সবকিছু ছাপিয়ে যায় পরিযায়ী বা অতিথি পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করে তারা আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতির আকর্ষণে ছুটে আসে। আকাশ থেকে আমরা যদি তাকাই, বাংলাদেশে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগই বেশি মনে হবে। কত যে নদ-নদী-খাল-বিল-হাওর-পুকুর-দীঘি! প্রতিটিতেই সুস্বাদু-সুমিষ্ট পানি। আর রয়েছে পাখির উপযোগী নানা খাবার। তদুপরি এখানে শীত তীব্র নয়। বরফ জমা এলাকা থেকে স্বল্প সময়ের জন্য আবাসস্থল হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিতে পাখিরা দ্বিধা করে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী। স্বাধীনতার উষালগ্নের দিনটি থেকে হাতেগোনা কয়েক দিন আগে এর যাত্রা শুরু। গত ৪২ বছরে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি আমাদের প্রতিষ্ঠানও অনেক বড় হয়েছে। দেশে চাষের জমি কমছে, বনভূমি কমছে। এক সময়ের জলাভূমির ব্যবহার বাড়ছে ঘরবাড়ি ও নানাবিধ অবকাঠামো নির্মাণে। সাড়ে সাত কোটির ভূখণ্ডে বসবাস করছে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ। বর্ধিত জনসংখ্যার খাবার জোগাতে চাষের জমিতে বেশি বেশি বোনা হচ্ছে উচ্চফলনশীল নানা জাতের ধান। বহু যুগের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেসব ধান ও অন্যান্য শস্য আমাদের ভূখণ্ডে স্থান করে নিয়েছিল, তার অনেকগুলো এখন বিলীন হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। লম্বা জাতের ধান ছিল এক সময়। তার স্থান নিয়েছে উচ্চফলনশীল জাত, যেখানে ফলন বেশি কিন্তু গাছের উচ্চতা কম। পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। ফলন বাড়াতে সারের ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপক_ প্রাকৃতিক বা জৈব সার নয়, রাসায়নিক সার। রোগবালাই থেকে ফসল রক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয় কীটনাশক। আগাছা নিধনের জন্য প্রচলিত নিড়ানিরও স্থান নিচ্ছে রাসায়নিক। যুগ যুগ ধরে এ কাজ করত দিনমজুরের দল। এখন তাদের মজুরির হার বেড়েছে। ফলে সহজ পন্থা চাষিদের_ কীটনাশক ব্যবহার, যা ধান গাছ টিকিয়ে রাখবে, কিন্তু মারবে আগাছা। এ যে বিষ, সেটা তারা ভুলে থাকতে চায়। এ বিষ পানিতে মিশে যায় সহজেই। তাতে দূষিত হয় পানি। পরিণতিতে জলজ উদ্ভিদ, মাছ, শামুক_ এসব হারিয়ে যাচ্ছে।
পানির পরিমাণও কমছে। নদী আর আগের মতো প্রবহমান নেই। অপরিকল্পিত বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ তার গতি রোধ করছে। নদ-নদী সংলগ্ন হাওর-বাঁওড়ের পানি নিশ্চল থাকছে। বড় বড় শহরে জলাশয় তো একরূপ বিলীন হতে চলেছে। রাজধানীর হাতিরঝিল ব্যতিক্রম। সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় বিস্তীর্ণ জলরাশি আমাদের চোখ জুড়াচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের অনেক জলাভূমি ইতিমধ্যেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি এবং ফেলছি। পাখির জন্য পরিবেশবান্ধব পরিবেশের যে তাই বড় অভাব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকেও তা আমরা বুঝতে পারি। পাখিরা অনেক বছর এ এলাকাকে তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় বা অভয়ারণ্য মনে করেছে। এ ক্যাম্পাসের বিশাল পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভাঙত পাখির কলকাকলিতে। আকাশে পাখির উড়ে চলা এবং জলকেলি-স্নানের দৃশ্য তাদের মুগ্ধ করত। কিন্তু কিছু পরিকল্পনার ভুলে পাখিবান্ধব পরিবেশ যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। দুটি বড় লেকে ইজারা পদ্ধতিতে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দ্বারা যথার্থই সমালোচিত হয়। হাইব্রিড মাছের ফলন হয় দ্রুত। কিন্তু এ জন্য যে খাবার দেওয়া হয় তা অনেক ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। লেকে চুন দেওয়ার কারণে ক্ষারত্বের মাত্রা বেড়ে যায়। এসব কারণে পাখি কম আসতে থাকে।
আমাদের পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার অভাবও লক্ষণীয় ছিল। লেকের পাড় ঘেঁষে বসা বা চলাফেরা করা এবং মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহার অভয়ারণ্যের পরিবেশের ঠিক উপযোগী নয়। ক্যাম্পাসে যানবাহন সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাস এবং এগুলোর তীক্ষষ্ট হর্ন পাখিরা পছন্দ করে না। এভাবে তাদের জন্য সৃষ্টি হয় আতঙ্কের পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দৃষ্টি পড়ে এসব সমস্যার প্রতি এবং আমরা সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণে সফল হই। ইজারা দেওয়া লেক দুটি থেকে লম্বা ছুটির সময়ে জাল টেনে ছোট-বড় সব মাছ তুলে ফেলা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, সবকিছু খেয়ে ফেলে এমন মাছও ধরা পড়ে। শাপলা ছিল তাদের প্রিয় খাদ্য। আমরা পানিতে চুন দেওয়া বন্ধ করি। গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা যায় যে, এ পদক্ষেপে পানি স্বাভাবিক রূপ ফিরে পেয়েছে। লেকের একেবারে কাছে যেন কেউ না যায় সে জন্য দেওয়া হয় বেড়া। পটকা-ব্যান্ড বাজানোও নিষিদ্ধ করা হয়। বাসগুলোকে লেকের ধারে যেতে দেওয়া হয় না। ওয়ার্কশপ দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। লেক নবরূপ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, নতুন করে রক্তশাপলা বোনা হবে। এ সময় পুরনো কর্মী মজিবর বলেন, মাছ না থাকায় শাপলা এখন আপনাআপনিই গজাবে। আমাদের জন্য অবাক করা ব্যাপার ছিল_ পনের দিনের মধ্যেই লেকে মাথা তুলে দাঁড়াল একে একে অনেক শাপলা।
এবারে শীতের আগমন ঘটেছে বেশ জাঁকালোভাবেই। শীত শুরুর আগেই দেখা গেল জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাসের আকাশে কিছু পাখির আনাগোনা। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু লেকে তেমন নামছে না। অনেকদিন ধরে ক্যাম্পাসে পাখির প্রতি নজর রাখছেন এমন লোকজন জানালেন, এরা হচ্ছে অগ্রবর্তী দল। দলে দলে পাখি আসার পরিবেশ রয়েছে কি-না, সেটা পর্যবেক্ষণে এসেছে এরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা রেকি করতাম এবং এর সঙ্গে যুক্তদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পাখিরাও যে তেমনই করে! তাদেরও তথ্যানুসন্ধানী দল থাকে! এক সময়ে তাদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং সেটা তারা সহজেই ধরে ফেলে। এবারের পরিবর্তন অগ্রবর্তী দলের দৃষ্টি এড়ায়নি এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে শীত নামতে না নামতেই দলে দলে পাখি এসে লেকে বসতে শুরু করে। তাদের বিরক্তির কারণ যেন না ঘটে সে জন্য আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা সচেতন থাকি। কী কী করা যাবে না, সেটা জানিয়ে লাগানো হয় অনেক বিলবোর্ড। এ উদ্যোগে গণমাধ্যমের মেলে আন্তরিক সহযোগিতা। প্রতি বছর দলে দলে পাখিপ্রেমীরা ক্যাম্পাসে আসেন। এবারে তাদের আসার জন্য উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে।
আমাদের পাখিমেলার একটি প্রধান উদ্দেশ্য সারাদেশে পাখিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সচেতনতা বাড়ানো। মানুষ শত্রু নয়, বরং বন্ধু, এটা পাখিদের বুঝতে দিতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে এমন পরিবেশ রয়েছে এবং বিশ্বের এ ধরনের ১০টি সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তাদের স্থান, সেটা ধরে রাখার জন্য আমরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অন্যদের জানাতে চেয়েছি এ মেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এ সময়ে একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল_ কত ধরনের পাখি এসেছে, তা বের করা। একটি দল ৪০ মিনিটে ৪৩ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করে প্রথম হয়েছে।
আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমিকে বলা হয় 'ধনে ধান্য পুষ্প ভরা'। কত কবি যে এর অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। কবিগুরুর 'আমার সোনার বাংলা...' আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের সৌন্দর্য দৈনন্দিন জীবনের অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। আমরা যে সোনার বাংলা ও সোনার মানুষ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি, তেমনটি হলে পাখি আসবেই।
এ ক্ষেত্রে বাধা ও সমস্যা অনেক, সেটা বুঝতে পারি। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে। মানুষ যত বাড়বে, পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর আঘাত তত বেশি পড়তে থাকবে। একদিনে জনসংখ্যার চাপ কমানো যাবে না। তবে চেষ্টা থাকতে হবে। ভূমি দস্যুদের দিক থেকে বাধা সবচেয়ে বেশি। তারা জলাশয় ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খাটানো হয় নামমাত্র মজুরিতে। কিন্তু তাতেই মালিকরা তুষ্ট নয়। তাদের আরও লাভ চাই। এ জন্য কারখানার বর্জ্য পরিশোধন না করেই ফেলা হচ্ছে নদ-নদী ও জলাশয়ে। জাহাঙ্গীরনগরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে বংশী নদী। কী সুন্দর নাম। কিন্তু গার্মেন্ট এবং অন্যান্য কারখানার বর্জ্যে এর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। নদীর পানিতে এখন আর মাছ দেখা যায় না। স্নান করা যায় না। এ পানি সেচের জন্য ব্যবহার করেও ফল মেলে না। নৌকা চলে না দুর্গন্ধের জন্য। আমাদের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় রয়েছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। কিন্তু নদ-নদী রক্ষার আইন প্রয়োগে তাকে উদ্যোগী দেখি না।
ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা যাওয়া-আসার পথে দেখি তুরাগ নদ ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে। এর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। আরও রয়েছে বালু, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ গড়ে তুলতে চান। কিন্তু এ জন্য সর্বাগ্রে তো চাই নদ-নদী পূর্ণরূপে ফিরে পাওয়া।
পাখিমেলা তাই নিছক পাখি দেখা নয়, এর বার্তা আরও গভীরে। আমরা চাই পরিবেশ রক্ষায় সবাই এগিয়ে আসুক। সরকার কিছু কাজ সম্প্রতি করতে শুরু করেছে। হাইকোর্ট চমৎকার কিছু নির্দেশনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকুক, এটাই কাম্য।
আমরা ক্যাম্পাসে প্রজাপতি মেলা করেছি। পাখিমেলা হয়ে গেল। নদীমেলা করার প্রস্তুতি এখন চলছে। ভূগোল ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ উদ্যোগে শামিল হতে হবে। আমাদের পাশ দিয়ে চলা বংশী নদীকে আমরা বাঁচাবই। এভাবে অন্যান্য নদ-নদী রক্ষার জন্য বেগবান হবে সামাজিক প্রয়াস। কারখানার বর্জ্য-দূষিত দ্রব্য কোনোভাবেই নদীতে ফেলা যাবে না। তাদের অবশ্যই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না করে তারা যে অর্থ সাশ্রয় করছেন, দেশের ক্ষতি করছেন তার তুলনায় বহু বহু গুণ বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারে পাখি আসতে শুরু করেছে। তারা ফিরে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই অন্য স্থানে যাওয়া পাখিদের জানাবে এখানের উন্নত পরিবেশের কথা এবং তার প্রভাবে আগামীতে আরও বেশি পাখি আসবে। একইভাবে গোটা দেশ এমন পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠুক, এটাও প্রার্থনা।
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী। স্বাধীনতার উষালগ্নের দিনটি থেকে হাতেগোনা কয়েক দিন আগে এর যাত্রা শুরু। গত ৪২ বছরে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি আমাদের প্রতিষ্ঠানও অনেক বড় হয়েছে। দেশে চাষের জমি কমছে, বনভূমি কমছে। এক সময়ের জলাভূমির ব্যবহার বাড়ছে ঘরবাড়ি ও নানাবিধ অবকাঠামো নির্মাণে। সাড়ে সাত কোটির ভূখণ্ডে বসবাস করছে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ। বর্ধিত জনসংখ্যার খাবার জোগাতে চাষের জমিতে বেশি বেশি বোনা হচ্ছে উচ্চফলনশীল নানা জাতের ধান। বহু যুগের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেসব ধান ও অন্যান্য শস্য আমাদের ভূখণ্ডে স্থান করে নিয়েছিল, তার অনেকগুলো এখন বিলীন হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। লম্বা জাতের ধান ছিল এক সময়। তার স্থান নিয়েছে উচ্চফলনশীল জাত, যেখানে ফলন বেশি কিন্তু গাছের উচ্চতা কম। পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। ফলন বাড়াতে সারের ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপক_ প্রাকৃতিক বা জৈব সার নয়, রাসায়নিক সার। রোগবালাই থেকে ফসল রক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয় কীটনাশক। আগাছা নিধনের জন্য প্রচলিত নিড়ানিরও স্থান নিচ্ছে রাসায়নিক। যুগ যুগ ধরে এ কাজ করত দিনমজুরের দল। এখন তাদের মজুরির হার বেড়েছে। ফলে সহজ পন্থা চাষিদের_ কীটনাশক ব্যবহার, যা ধান গাছ টিকিয়ে রাখবে, কিন্তু মারবে আগাছা। এ যে বিষ, সেটা তারা ভুলে থাকতে চায়। এ বিষ পানিতে মিশে যায় সহজেই। তাতে দূষিত হয় পানি। পরিণতিতে জলজ উদ্ভিদ, মাছ, শামুক_ এসব হারিয়ে যাচ্ছে।
পানির পরিমাণও কমছে। নদী আর আগের মতো প্রবহমান নেই। অপরিকল্পিত বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ তার গতি রোধ করছে। নদ-নদী সংলগ্ন হাওর-বাঁওড়ের পানি নিশ্চল থাকছে। বড় বড় শহরে জলাশয় তো একরূপ বিলীন হতে চলেছে। রাজধানীর হাতিরঝিল ব্যতিক্রম। সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় বিস্তীর্ণ জলরাশি আমাদের চোখ জুড়াচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের অনেক জলাভূমি ইতিমধ্যেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি এবং ফেলছি। পাখির জন্য পরিবেশবান্ধব পরিবেশের যে তাই বড় অভাব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকেও তা আমরা বুঝতে পারি। পাখিরা অনেক বছর এ এলাকাকে তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় বা অভয়ারণ্য মনে করেছে। এ ক্যাম্পাসের বিশাল পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভাঙত পাখির কলকাকলিতে। আকাশে পাখির উড়ে চলা এবং জলকেলি-স্নানের দৃশ্য তাদের মুগ্ধ করত। কিন্তু কিছু পরিকল্পনার ভুলে পাখিবান্ধব পরিবেশ যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। দুটি বড় লেকে ইজারা পদ্ধতিতে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দ্বারা যথার্থই সমালোচিত হয়। হাইব্রিড মাছের ফলন হয় দ্রুত। কিন্তু এ জন্য যে খাবার দেওয়া হয় তা অনেক ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। লেকে চুন দেওয়ার কারণে ক্ষারত্বের মাত্রা বেড়ে যায়। এসব কারণে পাখি কম আসতে থাকে।
আমাদের পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার অভাবও লক্ষণীয় ছিল। লেকের পাড় ঘেঁষে বসা বা চলাফেরা করা এবং মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহার অভয়ারণ্যের পরিবেশের ঠিক উপযোগী নয়। ক্যাম্পাসে যানবাহন সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাস এবং এগুলোর তীক্ষষ্ট হর্ন পাখিরা পছন্দ করে না। এভাবে তাদের জন্য সৃষ্টি হয় আতঙ্কের পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দৃষ্টি পড়ে এসব সমস্যার প্রতি এবং আমরা সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণে সফল হই। ইজারা দেওয়া লেক দুটি থেকে লম্বা ছুটির সময়ে জাল টেনে ছোট-বড় সব মাছ তুলে ফেলা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, সবকিছু খেয়ে ফেলে এমন মাছও ধরা পড়ে। শাপলা ছিল তাদের প্রিয় খাদ্য। আমরা পানিতে চুন দেওয়া বন্ধ করি। গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা যায় যে, এ পদক্ষেপে পানি স্বাভাবিক রূপ ফিরে পেয়েছে। লেকের একেবারে কাছে যেন কেউ না যায় সে জন্য দেওয়া হয় বেড়া। পটকা-ব্যান্ড বাজানোও নিষিদ্ধ করা হয়। বাসগুলোকে লেকের ধারে যেতে দেওয়া হয় না। ওয়ার্কশপ দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। লেক নবরূপ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, নতুন করে রক্তশাপলা বোনা হবে। এ সময় পুরনো কর্মী মজিবর বলেন, মাছ না থাকায় শাপলা এখন আপনাআপনিই গজাবে। আমাদের জন্য অবাক করা ব্যাপার ছিল_ পনের দিনের মধ্যেই লেকে মাথা তুলে দাঁড়াল একে একে অনেক শাপলা।
এবারে শীতের আগমন ঘটেছে বেশ জাঁকালোভাবেই। শীত শুরুর আগেই দেখা গেল জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাসের আকাশে কিছু পাখির আনাগোনা। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু লেকে তেমন নামছে না। অনেকদিন ধরে ক্যাম্পাসে পাখির প্রতি নজর রাখছেন এমন লোকজন জানালেন, এরা হচ্ছে অগ্রবর্তী দল। দলে দলে পাখি আসার পরিবেশ রয়েছে কি-না, সেটা পর্যবেক্ষণে এসেছে এরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা রেকি করতাম এবং এর সঙ্গে যুক্তদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পাখিরাও যে তেমনই করে! তাদেরও তথ্যানুসন্ধানী দল থাকে! এক সময়ে তাদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং সেটা তারা সহজেই ধরে ফেলে। এবারের পরিবর্তন অগ্রবর্তী দলের দৃষ্টি এড়ায়নি এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে শীত নামতে না নামতেই দলে দলে পাখি এসে লেকে বসতে শুরু করে। তাদের বিরক্তির কারণ যেন না ঘটে সে জন্য আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা সচেতন থাকি। কী কী করা যাবে না, সেটা জানিয়ে লাগানো হয় অনেক বিলবোর্ড। এ উদ্যোগে গণমাধ্যমের মেলে আন্তরিক সহযোগিতা। প্রতি বছর দলে দলে পাখিপ্রেমীরা ক্যাম্পাসে আসেন। এবারে তাদের আসার জন্য উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে।
আমাদের পাখিমেলার একটি প্রধান উদ্দেশ্য সারাদেশে পাখিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সচেতনতা বাড়ানো। মানুষ শত্রু নয়, বরং বন্ধু, এটা পাখিদের বুঝতে দিতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে এমন পরিবেশ রয়েছে এবং বিশ্বের এ ধরনের ১০টি সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তাদের স্থান, সেটা ধরে রাখার জন্য আমরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অন্যদের জানাতে চেয়েছি এ মেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এ সময়ে একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল_ কত ধরনের পাখি এসেছে, তা বের করা। একটি দল ৪০ মিনিটে ৪৩ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করে প্রথম হয়েছে।
আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমিকে বলা হয় 'ধনে ধান্য পুষ্প ভরা'। কত কবি যে এর অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। কবিগুরুর 'আমার সোনার বাংলা...' আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের সৌন্দর্য দৈনন্দিন জীবনের অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। আমরা যে সোনার বাংলা ও সোনার মানুষ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি, তেমনটি হলে পাখি আসবেই।
এ ক্ষেত্রে বাধা ও সমস্যা অনেক, সেটা বুঝতে পারি। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে। মানুষ যত বাড়বে, পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর আঘাত তত বেশি পড়তে থাকবে। একদিনে জনসংখ্যার চাপ কমানো যাবে না। তবে চেষ্টা থাকতে হবে। ভূমি দস্যুদের দিক থেকে বাধা সবচেয়ে বেশি। তারা জলাশয় ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খাটানো হয় নামমাত্র মজুরিতে। কিন্তু তাতেই মালিকরা তুষ্ট নয়। তাদের আরও লাভ চাই। এ জন্য কারখানার বর্জ্য পরিশোধন না করেই ফেলা হচ্ছে নদ-নদী ও জলাশয়ে। জাহাঙ্গীরনগরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে বংশী নদী। কী সুন্দর নাম। কিন্তু গার্মেন্ট এবং অন্যান্য কারখানার বর্জ্যে এর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। নদীর পানিতে এখন আর মাছ দেখা যায় না। স্নান করা যায় না। এ পানি সেচের জন্য ব্যবহার করেও ফল মেলে না। নৌকা চলে না দুর্গন্ধের জন্য। আমাদের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় রয়েছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। কিন্তু নদ-নদী রক্ষার আইন প্রয়োগে তাকে উদ্যোগী দেখি না।
ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা যাওয়া-আসার পথে দেখি তুরাগ নদ ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে। এর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। আরও রয়েছে বালু, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ গড়ে তুলতে চান। কিন্তু এ জন্য সর্বাগ্রে তো চাই নদ-নদী পূর্ণরূপে ফিরে পাওয়া।
পাখিমেলা তাই নিছক পাখি দেখা নয়, এর বার্তা আরও গভীরে। আমরা চাই পরিবেশ রক্ষায় সবাই এগিয়ে আসুক। সরকার কিছু কাজ সম্প্রতি করতে শুরু করেছে। হাইকোর্ট চমৎকার কিছু নির্দেশনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকুক, এটাই কাম্য।
আমরা ক্যাম্পাসে প্রজাপতি মেলা করেছি। পাখিমেলা হয়ে গেল। নদীমেলা করার প্রস্তুতি এখন চলছে। ভূগোল ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ উদ্যোগে শামিল হতে হবে। আমাদের পাশ দিয়ে চলা বংশী নদীকে আমরা বাঁচাবই। এভাবে অন্যান্য নদ-নদী রক্ষার জন্য বেগবান হবে সামাজিক প্রয়াস। কারখানার বর্জ্য-দূষিত দ্রব্য কোনোভাবেই নদীতে ফেলা যাবে না। তাদের অবশ্যই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না করে তারা যে অর্থ সাশ্রয় করছেন, দেশের ক্ষতি করছেন তার তুলনায় বহু বহু গুণ বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারে পাখি আসতে শুরু করেছে। তারা ফিরে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই অন্য স্থানে যাওয়া পাখিদের জানাবে এখানের উন্নত পরিবেশের কথা এবং তার প্রভাবে আগামীতে আরও বেশি পাখি আসবে। একইভাবে গোটা দেশ এমন পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠুক, এটাও প্রার্থনা।
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments