নিজের বাঙালী পরিচয় যখন পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে! by মাসুদা ভাট্টি
বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জ্বলছে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে, অনত্মর্জালে সর্বত্র এই আগুনের দৃশ্য। কিন্তু এত বাহ্যত, ভেতরে সেখানে কী ঘটছে? এই প্রশ্ন করলে একেক প একেক উত্তর দেবেন, কেউ বলবেন,
সেখানে পাহাড়ীরা বাঙালীদের মারছে, আবার কেউবা বলবেন যে, পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের বাঙালী কচুকাটা করছে। একটি মাত্র বাক্যে যদি বলি তাহলে বলতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, সেখানে কে কাকে হত্যা করছে তা উত্তরের পরবর্তী অংশ কিন্তু সবার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, পাহাড়ে দেদার হত্যাকা-, অগি্নসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হলো, এ কথা গণমাধ্যম বললেও সরকারের প থেকে আমরা এখনও এ নিয়ে কোন কথা শুনিনি। অথচ, আজ এ কথা আমাদের সরকারের কাছ থেকেই জানা উচিত ছিল তারপর প্রকৃত সত্য উদ্াটনের পথে হাঁটতাম আমরা না হয়। কিন্তু সেটা হয়নি, দুঃখটা সেখানেই।পার্বত্য চট্টগ্রামে এই আগুন কবে জ্বলতে শুরম্ন করেছে তার ইতিহাস লিখতে গেলে মহাভারত লিখতে হবে। তার পরও সেই ভারত স্বাধীনতা লাভের সূচনালগ্নে যখন হিন্দু আর মুসলিম নিজেদের মধ্যে ভারত-ভাগে ব্যসত্ম তখন ুদ্র ুদ্র জাতিসত্তা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এবং তাদের সেই আতঙ্ক যে অকারণ ছিল না তার প্রমাণ আমরা পাই পাকিসত্মান আমলে ১৯৫৭ সালে যখন কাপ্তাই বাঁধের কারণে চাকমাদের ৫৪ হাজার একর চাষযোগ্য জমিসহ প্রায় ৪০০ বর্গমাইল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। একই সঙ্গে গৃহহীন হয় প্রায় ১ লাখ পাহাড়ী অধিবাসী। এ সময় সেনাবাহিনী সেখানে যে উচ্ছেদ অভিযান চালায় তা ছিল শতাব্দীর অন্যতম নৃশংসতার নজির। যদিও এ নিয়ে তেমন কোথাও তেমন লেখালেখি হয়নি। পাকিসত্মান আমলে এ বিষয় নিয়ে কারও মাথাব্যথাও ছিল বলে জানা যায় না। তারপর পাকিসত্মান ভাঙল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। যে কোন বাঙালীকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, পাকিসত্মান থেকে বাংলাদেশ নামক ভূখ-ের স্বাধীনতা লাভের জন্য সবচেয়ে কি বেশি দায়ী? তাহলে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, পাকিসত্মান আমলে বাঙালী যে শোষণ, বঞ্চনা, গঞ্জনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় তারই ফলে বাঙালী বাধ্য হয় অস্ত্র ধরতে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। প্রিয় পাঠককে অনুরোধ করছি, আজকের নিবন্ধের এই লাইন ক'টি বিশেষভাবে মনে রাখতে, এবার একটু প্রসঙ্গানত্মরে গিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসো।
স্বাধীন বাংলাদেশে যখন একটি সংবিধান প্রণীত হয় তখন কাকতালীয়ভাবে সকলেই এই পাহাড়ী বাসিন্দাদের কথা বেমালুম ভুলে যান। সেখানে এই ভূখ-ের সংখ্যাগুরম্ন বাংলাভাষীদের কথা থাকলেও সংখ্যালঘু অন্যভাষী ুদ্র জাতিসত্তার কথা কৌশলে চেপে যাওয়া হয় যে কারণে সংবিধান প্রণয়নের দিনই মানবেন্দ্র লারমা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন এই বলে যে, "আপনারা আপনাদের জাতিসত্তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না, আমি বাঙালী নই, আমি চাকমা।" মজার ব্যাপার হলো, পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা যখন ঊর্দু করার ঘোষণা আসে তখন বাঙালীও ঠিক একই কায়দায় জাতীয় পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয়, কারণ তার মাতৃভাষা বাংলা। যাহোক, আমরা পাকিসত্মানের গল্প বলছি না, গল্প বলছি স্বাধীন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতে যখন এ রকম টানাপড়েন শুরম্ন হয় তখন তিনি বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন জানা যায় না, তবে তাকে হত্যার পর পরই পাহাড়ে শুরম্ন হয় ভয়ঙ্কর তা-বলীলা। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নিয়ে আসেন উদ্ভট বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব। তিনি কলকাতার বাঙালি থেকে বাংলাদেশের বাঙালীকে আলাদা করার ল্যে এই বাংলাদেশী তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তিনি যুক্তি দেখালেন যে, যেহেতু ভারত-ভূখ-েও বাঙালী আছে সেহেতু বাংলাদেশের বাঙালীর জাতিসত্তা হবে বাংলাদেশী। কিন্তু মৌলিক যুক্তি হলো যেহেতু বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা মানুষ রয়েছে, সেহেতু নাগরিক পরিচয়ে সকলেই বাংলাদেশী কিন্তু জাতি পরিচয়ে কেউ বাঙালী, কেউ চাকমা, কেউ বা মুরং। কিন্তু জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদ্ভট তত্ত্ব দিলেও সেখানে পাহাড়ের অধিবাসীদের জায়গা তো দিলেনই না উল্টো তার নিজের জেলা বগুড়া আর তার স্ত্রীর জেলা নোয়াখালী থেকে প্রায় লাখ চারেক বাঙালী এনে পাহাড়ে বসিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর প্রত্য তত্ত্বাবধানে পাহাড়ীদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে দেয়া হলো জোর করে বসানো 'আবাদি'দের। যে জমিতে একজন পাহাড়ী অধিবাসীর জন্মগত অধিকার তাই-ই হয়ে গেল, একজন অধিকৃত বাঙালীর। যে কারণে আমরা ইসরায়েলকে গালি দেই, সেই অধিকৃত গাজা ভূখ- থেকে ফিলিসত্মিনীদের উচ্ছেদ করে ইসরায়েলীদের বসানোর মতো বাংলাদেশের পার্বত্য ভূমিতেও চলে উচ্ছেদাভিযান, জোর করে বসতি স্থাপন এবং সরকারের বাহিনীর প্রত্য মদদে জন্মগত অধিকার হরণের কাল।
ঠিক এই সময়েই পরাজিত পাকিসত্মান বাংলাদেশে তাদের হৃত অধিকার পুনর্স্থাপন করতে সম হয়। যে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিসত্মানের বিরম্নদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেই ভারতকে শিা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে অবমুক্ত করে দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় পাকিসত্মানী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ভারতবিরোধী তৎপরতার দ্বিতীয় ফ্রন্ট। এই অবস্থা চলতে থাকে দীর্ঘকাল। আমার পাঠককে এখন, বাঙালী যে কারণে পাকিসত্মানের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল সেই কারণটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, একটু আগেই যা আমি বলেছি। সেই একই কারণেই এই পাহাড়ী অধিবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। শুরম্ন হয় দীর্ঘ রক্তয়ী যুদ্ধপর্ব এবং ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র মতায় এসে পার্বত্য এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি শানত্মিচুক্তি করার আগ পর্যনত্ম দু'পরে হতাহতের তালিকা করতে গেলে আবারও বিরাট মহাভারত লেখা যাবে। কারণ একপ েএকজন মারা গেলে অন্যপ তার বদলায় হত্যা করে ১০০ জনকে। আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯৮০ সালে কাউখালীর ঘটনার কথা। আরও স্মরণ করতে পারি লোগাং হত্যাকাণ্ডের কথা। একাত্তরে টিক্কা খান কিংবা জেনারেল নিয়াজী যেভাবে বাঙালী নিধন করেছে, ঠিক তেমনইভাবে পাহাড়ে গণহত্যার ঘটনা ঘটে। আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে করা পার্বত্য শানত্মি চুক্তি বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট এই চুক্তির কথা উলেস্নখ করে প্রচারণা চালাতে থাকে এই বলে যে, এই চুক্তির ফলে নাকি ফেনী পর্যনত্ম ভারতের দখলে চলে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এখানকারই একটি এলাকা থেকে নির্বাচিত সাংসদ।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট মতায় এসে শানত্মিচুক্তি বাসত্মবায়নতো দূরের কথা এ সময় এই শানত্মিচুক্তিকে কিভাবে সম্পূর্ণ বদলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশানত্ম করে তোলা যায় সে চেষ্টাই করতে থাকে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার আগুন জ্বলে, হত্যাকা- ঘটে, সর্বোপরি পাহাড়ী নারীকে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে। আমরা ভুলতে পারি না কল্পনা চাকমার কথা, যাকে কোন পাকিসত্মানী সেনা সদস্য ধর্ষণ করেনি, তাকে ধর্ষণ করেছে এদেশেরই ক'জন সেনা সদস্য।
এটা ঘটনার একটি দিক। অন্যপীঠে পাহাড়ী অধিবাসীরা নিজেদের অসত্মিত্ব রার লড়াইয়ে নেমে বাঁচি কি মরি জীবনটাকে বাজি রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ভূখণ্ড রাখার সংগ্রাম শুরম্ন করে। বগুড়া কিংবা নোয়াখালী থেকে আসা বাসিন্দাদের ওপর তাদের রাগটা স্বাভাবিক এবং তার প্রকাশও মাঝে মাঝে ঘটে। তখনই শুরম্ন হয় দাঙ্গা এবং সেই দাঙ্গা ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে তলব করা হয় এবং বলাই বাহুল্য যে, তারা বাঙালীর প নিয়ে নির্বিচারে নির্যাতন শুরম্ন করে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ওপর।
আর এ দু'য়ের মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে চলে রাজনীতি। এক প যেহেতু সেখানকার পাহাড়ী অধিবাসীর অধিকার দিতে আগ্রহী এবং অন্যপ যেহেতু এই চার ল বাঙালিকে ওখানে সরকারী হেফাজতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেহেতু দু'পরে রাজনৈতিক বিভাজনটা বেশ তীব্রই বলতে হবে। এখানে আদিবাসীরা একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং অন্যদিকে বাঙালী "আবাদি"রা আরেকটি দলের এবং ভোটের রাজনীতিতেও এখানে দু'দলের রেষারেষির শেষ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামেও গত এক সপ্তাহ ধরে নতুন করে যে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে তাও মতার বাইরে থেকে মতাসীন রাজনৈতিক দল তথা সরকারকে অস্থির করে তোলার প্রচেষ্টা থেকেই করা হচ্ছে বলে বোঝা যায়। নইলে বর্তমান সরকার মতায় আসার মাত্র মাসখানেকের মাথায় ঢাকার পিলখানায় যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল তার বার্ষিকীতে এসেই কেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে উত্তাল করে তোলা হলো? এ প্রশ্ন যদি তোলা হয় সরকারকে গত বছরেরই মতো অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্রের কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে, তাহলে কি ভুল হবে? আমার বিশ্বাস, নয়।
আজ পাকিসত্মান আমলে যেমন বাঙালী নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাহাড়ী জনগোষ্ঠী নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং কাদের দ্বারা? পাকিসত্মান আমলে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালীদের দ্বারা। তাদেরও সমসত্ম অধিকার আজ ভ্থলুণ্ঠিত। এমন অবস্থায় নিজেকে একজন বাঙালী হিসেবে পরিচয় দিতে মাঝে মাঝে মাথা নত হয়ে আসে। এই নত শিরে আজ সরকারের কাছে আবেদন জানাই, দয়া করে পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি ফেরান। সেখানে যে আগুন জ্বলছে তা নিভিয়ে সেখানে শানত্মি ফিরিয়ে আনুন। মানুষের মাংসপোড়া গন্ধে আজ বিদীর্ণ স্বদেশ, এখানে শানত্মির সুবাতাস বইয়ে দিন, নইলে এ আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে; সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।
ঢাকা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, ২০১০।
No comments