বোধোদয় by গুলশান আরা আরজু
আমি শ্যামলী। স্বর্গ এবং নরকের মাঝে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এখনও নির্ধারণ হয়নি কোথায় যাব। হঠাৎ পৃথিবীর বুকে চোখ যায়। একটি বাক্য নজরে পড়ে_'অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল শ্যামলী।
' আরে, এটা তো আমার নাম! ভিতরে কী লেখা আছে পড়ে দেখার আগ্রহ হয়। "চার ভাইবোনের মধ্যে শ্যামলী সবচেয়ে ছোট। তাই সবার অতি আদরের। বাবা নজরুল বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি টিনের ঘর তুলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করে, সাথে চা-ও। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় ভাই সামাদ ভ্যান চালায়, ছোট ভাই জামাল বাবাকে দোকানে সাহায্য করে। পনেরো বছর বয়সী শ্যামলী ছোটকাল থেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিল এবং প্রতিবার মেধার পরিচয় দিয়েছে। তাই তার বাবা ও ভাই শ্যামলীর পড়াশোনা বন্ধ করেনি। এবার সে দশম শ্রেণীতে উঠেছিল। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই পাশের গ্রামের একটি ছেলে সবুজ তাকে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। শ্যামলীর কাছ থেকে আশাপূর্ণ উত্তর না পেয়ে ক্রমাগত প্তি হতে থাকে। স্কুলে যাওয়া- আসার পথে ওঁৎ পেতে থাকে এবং অশালীন অঙ্গভঙ্গি থেকে শুরম্ন করে অপমানজনক মনত্মব্য ছুড়তে থাকে। সমাজপতিদের বিষয়টি জানানো হলে প্রাথমিকভাবে কিছুদিন উত্ত্যক্ত বন্ধ থাকলেও একদিন রাতে সবুজসহ কয়েক ছেলে বাড়িতে এসে শ্যামলীকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার চিৎকারে গ্রামবাসীর সহায়তায় সে উদ্ধার হয়, অতঃপর পরদিন সকালে কীটনাশক খেয়ে শ্যামলী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।' আরে ঘটনাটি কি শুধু এতটুকুই ছিল? যাই বাড়ির অবস্থা কি দেখে আসি। কার সাথে বাবা-মা কথা বলছে? ওদের হাতে কাগজ কলম। কিন্তু ওটা কী? ওহ্হো ওটাতো মাইক্রোফোন। তারা দু'জন সাংবাদিক। টিভিতে রিপোর্টিং-এর জন্য বাবা-মার কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে, আমার ছবি টিভিতে দেখিয়ে তারা বাহ্বা কুড়াচ্ছে। আমার ভাইয়ের সাথে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আপোসের জন্য কথা বলছেন, দরদাম হচ্ছে_ কত টাকায় বিষয়টি মীমাংসা হবে। পত্রিকায় আমার ছবি ছাপিয়ে দিয়েছে আর সেই ছবি দেখে সবুজ হাসছে আর বলছে, বোকা মেয়ে কোথাকার! প্রতিদিন কি দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে আমার পরিবারকে ঘুরতে হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই উপরন্তু সমাজপতিরা মিডিয়ার সামনে সগর্বে বলে যাচ্ছে_ কী জন্য শ্যামলী আত্মহত্যা করেছে তার কারণ আমরা জানি না।' সেই সন্ত্রাসী ছেলেগুলো ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে নির্ভয়ে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? এবং কিভাবে পারছে? আমার ভাবনার দ্বারগুলো খুলে যাচ্ছে। এক অপরাধবোধ কাজ করছে_ কেন আমি এ কাজটি করলাম? এতে কী লাভ হলো? উল্টো পরিবারের যন্ত্রণা আর সন্ত্রাসীর সগর্ব পদচারণার শক্তি বাড়িয়ে দিলাম। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে পৃথিবীর বুকে এবং আত্মহত্যার পথকে দুমড়েমুচড়ে সন্ত্রাসীর কালো থাবা ভেঙ্গে দেবার ইতিহাস গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী হতে লোভে হচ্ছে।
No comments