তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের দুই মাস- বিজিএমইএর লোক দেখানো টাস্কফোর্স by গোলাম মর্তুজা ও শুভংকর কর্মকার
পাকিস্তানের করাচিতে ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আলী এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ২৮৯ জন শ্রমিক মারা যান। এ ঘটনার পরপরই কারখানার তিন মালিক আবদুল আজিজ এবং দুই ভাই শহীদ ভাইলা ও আরশাদ ভাইলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়।
তাঁদের পাসপোর্ট এবং সব ধরনের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়। হত্যা মামলাটির বিচার এখনো চলছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা। গত ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা যান ১১১ শ্রমিক। কিন্তু কারখানাটির মালিক দেলোয়ার হোসেন গ্রেপ্তার তো হননি বরং তাঁর পক্ষে গতকাল রোববারও সাফাই গেয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। অথচ ওই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় মালিকের অবহেলা ছিল।
পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সক্রিয় হয় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ। তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের পর সংগঠনটির টাস্কফোর্সও লোক দেখানো। আর শ্রম মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম গত শনিবারও সমালোচনা করে বলেছেন, মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তাজরীনের মালিককে রক্ষা করছে।
টাস্কফোর্স-কাহিনি: তাজরীনের ঘটনার পর দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে পোশাক কারখানাগুলোর পরিস্থিতি দেখতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল বিজিএমইএ। গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স বা শ্রমিকদের কর্মপরিবেশসম্পন্ন চারটি কারখানা পরিদর্শন করে এ টাস্কফোর্স। এ কারখানাগুলো সমিতির সভাপতি, সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও পরিচালক আতিকুল ইসলামের। পরিদর্শনে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও বুয়েটের দল। সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তারপর গত এক মাস চুপচাপ সেই টাস্কফোর্স।
তবে টাস্কফোর্স গঠন নিয়ে বক্তৃতা অবশ্য করেই যাচ্ছে বিজিএমইএ। গতকালও মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদল ঢাকার একটি পোশাক কারখানা সফর করার পর বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন টাস্কফোর্স গঠনের কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছি। টাস্কফোর্সের কয়েকজন সদস্য দেশের বাইরে থাকায় সবাইকে একত্র করা যায়নি।’
বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধির সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছিল বিজিএমইএ। কথা ছিল পর্যায়ক্রমে সব কারখানায় যাবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। অগ্নিকাণ্ডের কারণ চিহ্নিত করে সুপারিশ করবেন। পোশাকমালিকদের সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গত ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে ১০টি কারখানা পরিদর্শন করবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। তারপর কীভাবে এটি পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু সেই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমই শেষ করতে পারেনি বিজিএমইএ। এর মধ্যে নতুন করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাতজন নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
অবশ্য প্রথম দিকেই বিতর্কের মুখে পড়ে টাস্কফোর্স। এখন পর্যন্ত টাস্কফোর্সের সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষক দিনমণি শর্মা টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে প্রথম দিনের কারখানা পরিদর্শনে ছিলেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনের পর বিজিএমইএ আমাদের আর ডাকেনি।’
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল অবশ্য বলেন, ‘এটা টেকনিক্যাল বিষয়। টাস্কফোর্স কমিটি পরীক্ষামূলক কাজটি শেষ করে দিলেই আমরা এগোব। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা এটি করবই।’ টাস্কফোর্সের ব্যাপারে বিজিএমইএ যথেষ্ট আন্তরিক বলেও দাবি করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, দোষী মালিক ও কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও মালিকপক্ষের একগুঁয়েমির কারণেই তৈরি পোশাক খাতে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের সংঘ করার অধিকার না থাকায় এটি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, বিজিএমইএ ক্ষুদ্র মনোবৃত্তি থেকে মালিকের স্বার্থ দেখে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রপ্তানির এ বৃহৎ খাতটির স্বার্থ দেখে না। দুঃখের বিষয়, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে পোশাক খাতের যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
নাশকতা তত্ত্ব ও তদন্ত: তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি কারখানা মালিকের অবহেলা ও রহস্যময় আচরণের কথা বলেছে। পুলিশের করা মামলাতেও অবহেলার অভিযোগের ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবু গ্রেপ্তার হননি মালিক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন মোবাইল ফোনে আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। অথচ তিনি দূর থেকে আগুন দেখে আত্মগোপনে চলে যান। ঘটনার দুই দিন পর অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টিকে দুর্ঘটনা উল্লেখ করে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই ডায়েরিতে হতাহত শ্রমিকদের কথা কিছুই উল্লেখ না করে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি উল্লেখ করেন, মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬৩ কোটি টাকা। থানার জিডি ও পরে সাক্ষ্যে ক্ষতির পরিমাণের এই বিশাল তারতম্যের পেছনে কোনো দুরভিসন্ধিজাত অন্তর্ঘাত আছে কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে।’
গত ১৭ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি নয়জনকে দুর্ঘটনা ও হতাহতের জন্য দায়ী করে। এঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ঘটনার পরদিন পুলিশের করা মামলার এজাহারে দণ্ডবিধির ৩০৪-এর ক ধারায় (অবহেলার দরুন মৃত্যু সংঘটনের) অভিযোগ আনা হয়েছে। ২ জানুয়ারি থেকে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
মামলার তদন্তকারী সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনছুর আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, অবহেলার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাদের অবহেলার কারণে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তা খোঁজা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মালিককে গ্রেপ্তার করা হবে কি না জানতে চাইলে মনছুর আলী বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মালিকের সঙ্গে কথা বলা হবে। মালিকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
ঘটনার পর থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হতে থাকে, বিষয়টি নাশকতা। গত ৩১ ডিসেম্বর বিজিএমইএর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, তাজরীনের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত নাশকতা। পুলিশ ও পরে সিআইডির তদন্ত এখন পর্যন্ত নাশকতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, শুধু দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রচারণা চালানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেও নাশকতার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘অগ্নিসংকেত বেজে ওঠার পরও ব্যবস্থাপকেরা তথ্য গোপন করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করে এবং প্রতিটি তলায় কলাপসিবল ফটকে তালা দিয়ে তারা সটকে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ারও প্রায় ৩০ মিনিট পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, স্বেচ্ছায় কারখানার সুতা ও কাপড়ের গুদামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এটি কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়। সব বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হয়, এর পেছনে কোনো অশুভ শক্তির নাশকতামূলক তৎপরতা ছিল।’
আবার গতকালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাজরীনের ঘটনায় নাশকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা। গত ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা যান ১১১ শ্রমিক। কিন্তু কারখানাটির মালিক দেলোয়ার হোসেন গ্রেপ্তার তো হননি বরং তাঁর পক্ষে গতকাল রোববারও সাফাই গেয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। অথচ ওই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় মালিকের অবহেলা ছিল।
পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সক্রিয় হয় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ। তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের পর সংগঠনটির টাস্কফোর্সও লোক দেখানো। আর শ্রম মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম গত শনিবারও সমালোচনা করে বলেছেন, মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তাজরীনের মালিককে রক্ষা করছে।
টাস্কফোর্স-কাহিনি: তাজরীনের ঘটনার পর দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে পোশাক কারখানাগুলোর পরিস্থিতি দেখতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল বিজিএমইএ। গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স বা শ্রমিকদের কর্মপরিবেশসম্পন্ন চারটি কারখানা পরিদর্শন করে এ টাস্কফোর্স। এ কারখানাগুলো সমিতির সভাপতি, সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও পরিচালক আতিকুল ইসলামের। পরিদর্শনে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও বুয়েটের দল। সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তারপর গত এক মাস চুপচাপ সেই টাস্কফোর্স।
তবে টাস্কফোর্স গঠন নিয়ে বক্তৃতা অবশ্য করেই যাচ্ছে বিজিএমইএ। গতকালও মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদল ঢাকার একটি পোশাক কারখানা সফর করার পর বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন টাস্কফোর্স গঠনের কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছি। টাস্কফোর্সের কয়েকজন সদস্য দেশের বাইরে থাকায় সবাইকে একত্র করা যায়নি।’
বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধির সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছিল বিজিএমইএ। কথা ছিল পর্যায়ক্রমে সব কারখানায় যাবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। অগ্নিকাণ্ডের কারণ চিহ্নিত করে সুপারিশ করবেন। পোশাকমালিকদের সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গত ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে ১০টি কারখানা পরিদর্শন করবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। তারপর কীভাবে এটি পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু সেই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমই শেষ করতে পারেনি বিজিএমইএ। এর মধ্যে নতুন করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাতজন নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
অবশ্য প্রথম দিকেই বিতর্কের মুখে পড়ে টাস্কফোর্স। এখন পর্যন্ত টাস্কফোর্সের সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষক দিনমণি শর্মা টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে প্রথম দিনের কারখানা পরিদর্শনে ছিলেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনের পর বিজিএমইএ আমাদের আর ডাকেনি।’
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল অবশ্য বলেন, ‘এটা টেকনিক্যাল বিষয়। টাস্কফোর্স কমিটি পরীক্ষামূলক কাজটি শেষ করে দিলেই আমরা এগোব। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা এটি করবই।’ টাস্কফোর্সের ব্যাপারে বিজিএমইএ যথেষ্ট আন্তরিক বলেও দাবি করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, দোষী মালিক ও কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও মালিকপক্ষের একগুঁয়েমির কারণেই তৈরি পোশাক খাতে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের সংঘ করার অধিকার না থাকায় এটি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, বিজিএমইএ ক্ষুদ্র মনোবৃত্তি থেকে মালিকের স্বার্থ দেখে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রপ্তানির এ বৃহৎ খাতটির স্বার্থ দেখে না। দুঃখের বিষয়, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে পোশাক খাতের যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
নাশকতা তত্ত্ব ও তদন্ত: তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি কারখানা মালিকের অবহেলা ও রহস্যময় আচরণের কথা বলেছে। পুলিশের করা মামলাতেও অবহেলার অভিযোগের ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবু গ্রেপ্তার হননি মালিক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন মোবাইল ফোনে আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। অথচ তিনি দূর থেকে আগুন দেখে আত্মগোপনে চলে যান। ঘটনার দুই দিন পর অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টিকে দুর্ঘটনা উল্লেখ করে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই ডায়েরিতে হতাহত শ্রমিকদের কথা কিছুই উল্লেখ না করে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি উল্লেখ করেন, মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬৩ কোটি টাকা। থানার জিডি ও পরে সাক্ষ্যে ক্ষতির পরিমাণের এই বিশাল তারতম্যের পেছনে কোনো দুরভিসন্ধিজাত অন্তর্ঘাত আছে কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে।’
গত ১৭ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি নয়জনকে দুর্ঘটনা ও হতাহতের জন্য দায়ী করে। এঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ঘটনার পরদিন পুলিশের করা মামলার এজাহারে দণ্ডবিধির ৩০৪-এর ক ধারায় (অবহেলার দরুন মৃত্যু সংঘটনের) অভিযোগ আনা হয়েছে। ২ জানুয়ারি থেকে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
মামলার তদন্তকারী সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনছুর আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, অবহেলার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাদের অবহেলার কারণে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তা খোঁজা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মালিককে গ্রেপ্তার করা হবে কি না জানতে চাইলে মনছুর আলী বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মালিকের সঙ্গে কথা বলা হবে। মালিকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
ঘটনার পর থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হতে থাকে, বিষয়টি নাশকতা। গত ৩১ ডিসেম্বর বিজিএমইএর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, তাজরীনের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত নাশকতা। পুলিশ ও পরে সিআইডির তদন্ত এখন পর্যন্ত নাশকতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, শুধু দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রচারণা চালানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেও নাশকতার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘অগ্নিসংকেত বেজে ওঠার পরও ব্যবস্থাপকেরা তথ্য গোপন করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করে এবং প্রতিটি তলায় কলাপসিবল ফটকে তালা দিয়ে তারা সটকে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ারও প্রায় ৩০ মিনিট পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, স্বেচ্ছায় কারখানার সুতা ও কাপড়ের গুদামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এটি কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়। সব বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হয়, এর পেছনে কোনো অশুভ শক্তির নাশকতামূলক তৎপরতা ছিল।’
আবার গতকালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাজরীনের ঘটনায় নাশকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
No comments