হৃদয়নন্দন বনে-আমার গেলাস সদাই থাক আধেক পূর্ণ by আলী যাকের
মধ্য ষাট বয়সে এসে আমার এই পরম আশাবাদী মনটাকে আর বদলাতে চাই না। থাকুক না সে যেমন আছে? জীবনের সেই কোনো বিহানবেলা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমার জীবনে রোদ, বৃষ্টি এবং দাবদাহের প্রচণ্ডতা অথবা কালো মেঘের ভয়াবহ কটাক্ষ আমাকে জীবনবিমুখ করতে পারেনি।
বড় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম বোধহয়, যে কারণে আমার জীবনের কোনো সমস্যাকেই আমি মাটিচাপা দিয়ে রাখতে পারিনি। বরং অতি স্বচ্ছন্দে মুখোমুখি হয়েছি তার। জীবন কখনও আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। সব সমস্যার একটা না একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছি। এভাবেই জীবন কেটেছে যুগের পর যুগ। এভাবেই চালিয়ে যেতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আমাদের সমাজে সাম্প্রতিককালে চিন্তাশীল একটি জনগোষ্ঠী অনেক লেখাপড়া করে, অনেক চিন্তাভাবনা করে যে কোনো সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করে। আমি এ পর্যন্ত দেখিনি যে, তারা কখনও কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। বাল্যকালে বাবার কাছে শুনেছি, একজন ইংরেজ সাহেবকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব?' তার উত্তরে তিনি ভেবেচিন্তে বলবেন, 'আমি যদি তুমি হতাম এবং সমস্যাটা যদি ঠিক একই রকম হতো, একচুলও এদিক-ওদিক না হয়ে, তাহলে আমি হয়তো তুমি যা ভাবার চেষ্টা করছ সেই সম্বন্ধে আরও একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ভেবেচিন্তে অতঃপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতাম।' এমনই জটিল ছিল তাদের সহজিকরণ প্রক্রিয়া। কোনো একটা জটিল বিষয় নিয়ে যদি একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি একসঙ্গে বসে সে জটিলতার সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে সাধারণত এই রকম দাঁড়ায়, যেমন লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, 'একটি সম্মেলনের সংজ্ঞা হচ্ছে কতিপয় বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং সবজান্তা মানুষের দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে তর্ক-বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া। এর ফলে তারা একেকজন সমস্যাটির সমাধানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না বটে, তবে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, সমস্যাটির আসলেই কোনো সমাধান নেই।'
হবুচন্দ্র রাজার পায়ে ধুলা লাগে, তাই তার মন্ত্রী গোবুচন্দ্রকে তিনি কড়া ধমক দিয়ে বললেন, এই সমস্যার একটি সমাধান করা দরকার। এরপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় আছে_ "শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন/দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে/পণ্ডিতের হইল মুখ চুন/পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে/রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি/কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে/অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি/কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে-/'যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে/পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!"
আমরা সাধারণ মানুষরা বড় বড় তত্ত্ব কথা শুনে অভ্যস্ত। শুরুতে ভাবতাম যে, এর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো উপদেশ কিংবা পরামর্শ নিশ্চয়ই আছে, যার দ্বারা সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এখন যেন মনে হয়, যে কোনো বিষয়ে অভিমত, কিংবা বচনকে যদি একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে শক্ত করা হয় অথবা যদি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলা যেতে পারে যে এই সমস্যার সমাধান এভাবেও সম্ভব, ওভাবেও সম্ভব, কিন্তু তৃতীয় কিছু চিন্তা করতে হবে, তাহলে বোধহয় পণ্ডিতরা পালে হাওয়া পায়। সাধারণ মানুষ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাবে, 'বাহ, বেশ জবরদস্ত কথা বলেছে তো!' সমস্যাটি কিন্তু যেমন গ্যাঁট হয়ে বসেছিল, তেমনি বসে থাকে। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। কিছু সমস্যা নিজ থেকেই সমাধান হয়ে যায়, অন্যদিকে কিছু সমস্যা কিছুদিন বাদে আর সমস্যা থাকে না। বিশেষজ্ঞরা এতে বড় স্বস্তি পান। সাধারণ মানুষ তাদের কথা ভুলে গিয়ে নিজ নিজ জীবনধারণের চিন্তায় মগ্ন হয়।
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্যার আয়তন ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত আরও বেশি জটিল এবং অবোধগম্য হওয়ায় গণমাধ্যম এ নিয়ে বেশ খেলাধুলা করে। তারা একবার এই কথা বলে, আরেকবার সেই কথা। এসব সমস্যা, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনীতির কূটকচালি, এমনকি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক_ সব বিষয়েই আজকাল মিডিয়া আমাদের অহরহ তাদের মন্তব্যে ভারাক্রান্ত করছে। যদি কোনো ব্যক্তি এ নিয়ে উদ্ভট একটি মন্তব্য করে, আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তাদের জবাব সাধারণত হয় 'ঐ যে অমুক টিভিতে দেখলাম কিংবা তমুক পত্রিকায় পড়লাম?' কেবল পড়া এবং দেখাটাই কি যথেষ্ট? এ কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, 'আমরা তবে আর কী করব? আমরা হতদরিদ্র জনগণ, লোকে যা বলে তাই শুনি।' আজকাল তো এমন হয়েছে যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রায় সবারই একটি নিজস্ব মত আছে। অবশ্য এই মতটি কান-কথার ওপর নির্ভরশীল। কানের কথায় অতি পুরনো একটি কৌতুক মনে পড়ে গেল। এক লোককে বলা হলো, চিলে তার কান নিয়ে গেছে। সে নিজের কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা না করেই চিলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন দান করে ফেলল। এই যে নিজের কানটি আছে কি-না তা না দেখা বা নিজের জ্ঞানের পরিমিতির মধ্যে যে বোধগম্যতা আছে, তা দিয়ে কোনো বিষয় বোঝার চেষ্টা না করে কেবল চিলের পেছনে পেছনে দৌড়ানো_ এতে আমরা দিন দিন বড়ই কাহিল হয়ে পড়ছি।
একটু লক্ষ্য করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, আমাদের এই যে, যে কোনো বিষয়ে ত্বরিত অভিমত সৃষ্টি করা এবং তা নিয়ে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কথাবার্তা অবলীলায় এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে বলে যাওয়া_ এতে করে সমূহ বিপদের আশঙ্কজা থেকেই যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪১ বছর হলো। আমরা সবাই বলে বেড়াই যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে। আমরা যদি এতে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে থাকি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটিও আমাদের জানা দরকার। জানা দরকার কী কারণে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, যুদ্ধের সময় কারা আমাদের বন্ধু ছিল, যুদ্ধের পরেই-বা কারা আমাদের দিকে সব ব্যাপারে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই মৌল বিষয়গুলো যদি আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, তাহলে একটি ইতিবাচক স্থান থেকে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।
সম্প্রতি ২০১৩-তে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। এ সময় সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলবেন, অনেক অভিমত আমরা পাব এবং অনেক জলও গড়াবে বুড়িগঙ্গা দিয়ে। কিন্তু একটু ভাবলে আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের প্রতিটি নতুন বছর আসে, গড়িয়ে যায় অন্তের দিকে, আমরা অনেক নতুন কথা বলি বটে, কিন্তু প্রায় সব কাজই অসমাপ্ত থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। এ বছরও নানা কথা শুনছি, বেশিরভাগই হতাশাব্যঞ্জক কথা। তবে আমি জানি যে, শেষ পর্যন্ত শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা ঠিকই এগিয়ে যাব ২০১৪-এর দিকে। আমাদের হতাশা মুখরোচক চাটনির মতোই কাজ করে মনে হয় আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে। সে জন্য আমি এ নিয়ে বেশি ভাবিত হতে চাই না। আমি জানি না এ ধরনের মন্তব্য করার আগে কেউ কি একবারও ভেবে দেখেন যে, তার মন্তব্যে আসলেই কোনো সারবত্তা আছে কি-না? সেদিন ফেসবুকে আমার এবং তরুণ বন্ধু লিখেছিলেন, 'ইবভড়ৎব ঢ়ধংংরহম ুড়ঁৎ লঁফমসবহঃ, ধংশ!'_কোনো মন্তব্য করার আগে দয়া করে একবার জিজ্ঞেস করুন? এই বিষয়টিতেই আমাদের আগ্রহের সবচেয়ে বড় অভাব। যদি আমরা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই, তাহলে তো আর রসঘন মন্তব্য আমরা করতে পারব না! অথচ আমরা, বাঙালিরা কথা বলতেই ভালোবাসি। সে কথায় কোনো সারবত্তা থাকুক বা না-ই থাকুক। আমি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তরুণদের চিন্তা-ভাবনার কিছু জানতে শুরু করেছি। অস্বীকার করব না যে, আমি ক্রমেই তাদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ছি। এর মধ্যেও যুক্তির দ্যুতি যে একেবারেই নেই, তাও বলা যাবে না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় বেশি হালকা কথা আমাকে পীড়িত করে। আমি জানি যে, হালকা কথার আধিক্য এমন একটি হালকা জায়গায় থাকবেই। কিন্তু খুব গভীর এবং গম্ভীর বিষয় নিয়ে যখন অতি সরলিকরণ করা হয়, কেবল নিজেদের বাকচাতুর্য দেখানোর জন্য, তখন হতাশ হতেই হয়। অতীতে তরুণ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত ছিল, কিন্তু শিক্ষিত যারা ছিল, তারা ছিল পূর্ণ শিক্ষিত। আজকের অধিকাংশ তরুণ অর্ধশিক্ষিত। শঙ্কাটা এখানেই। তবে সব শেষে আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই। কেননা আমি জানি যে, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়/তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়/অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে/প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।"
অতএব, আমি অর্ধপ্রাপ্তিকে পূর্ণপ্রাপ্তি বলেই ধরে নিতে চাই। আশা করি আশাহত হবো না।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমাদের সমাজে সাম্প্রতিককালে চিন্তাশীল একটি জনগোষ্ঠী অনেক লেখাপড়া করে, অনেক চিন্তাভাবনা করে যে কোনো সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করে। আমি এ পর্যন্ত দেখিনি যে, তারা কখনও কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। বাল্যকালে বাবার কাছে শুনেছি, একজন ইংরেজ সাহেবকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব?' তার উত্তরে তিনি ভেবেচিন্তে বলবেন, 'আমি যদি তুমি হতাম এবং সমস্যাটা যদি ঠিক একই রকম হতো, একচুলও এদিক-ওদিক না হয়ে, তাহলে আমি হয়তো তুমি যা ভাবার চেষ্টা করছ সেই সম্বন্ধে আরও একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ভেবেচিন্তে অতঃপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতাম।' এমনই জটিল ছিল তাদের সহজিকরণ প্রক্রিয়া। কোনো একটা জটিল বিষয় নিয়ে যদি একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি একসঙ্গে বসে সে জটিলতার সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে সাধারণত এই রকম দাঁড়ায়, যেমন লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, 'একটি সম্মেলনের সংজ্ঞা হচ্ছে কতিপয় বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং সবজান্তা মানুষের দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে তর্ক-বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া। এর ফলে তারা একেকজন সমস্যাটির সমাধানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না বটে, তবে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, সমস্যাটির আসলেই কোনো সমাধান নেই।'
হবুচন্দ্র রাজার পায়ে ধুলা লাগে, তাই তার মন্ত্রী গোবুচন্দ্রকে তিনি কড়া ধমক দিয়ে বললেন, এই সমস্যার একটি সমাধান করা দরকার। এরপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় আছে_ "শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন/দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে/পণ্ডিতের হইল মুখ চুন/পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে/রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি/কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে/অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি/কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে-/'যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে/পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!"
আমরা সাধারণ মানুষরা বড় বড় তত্ত্ব কথা শুনে অভ্যস্ত। শুরুতে ভাবতাম যে, এর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো উপদেশ কিংবা পরামর্শ নিশ্চয়ই আছে, যার দ্বারা সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এখন যেন মনে হয়, যে কোনো বিষয়ে অভিমত, কিংবা বচনকে যদি একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে শক্ত করা হয় অথবা যদি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলা যেতে পারে যে এই সমস্যার সমাধান এভাবেও সম্ভব, ওভাবেও সম্ভব, কিন্তু তৃতীয় কিছু চিন্তা করতে হবে, তাহলে বোধহয় পণ্ডিতরা পালে হাওয়া পায়। সাধারণ মানুষ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাবে, 'বাহ, বেশ জবরদস্ত কথা বলেছে তো!' সমস্যাটি কিন্তু যেমন গ্যাঁট হয়ে বসেছিল, তেমনি বসে থাকে। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। কিছু সমস্যা নিজ থেকেই সমাধান হয়ে যায়, অন্যদিকে কিছু সমস্যা কিছুদিন বাদে আর সমস্যা থাকে না। বিশেষজ্ঞরা এতে বড় স্বস্তি পান। সাধারণ মানুষ তাদের কথা ভুলে গিয়ে নিজ নিজ জীবনধারণের চিন্তায় মগ্ন হয়।
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্যার আয়তন ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত আরও বেশি জটিল এবং অবোধগম্য হওয়ায় গণমাধ্যম এ নিয়ে বেশ খেলাধুলা করে। তারা একবার এই কথা বলে, আরেকবার সেই কথা। এসব সমস্যা, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনীতির কূটকচালি, এমনকি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক_ সব বিষয়েই আজকাল মিডিয়া আমাদের অহরহ তাদের মন্তব্যে ভারাক্রান্ত করছে। যদি কোনো ব্যক্তি এ নিয়ে উদ্ভট একটি মন্তব্য করে, আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তাদের জবাব সাধারণত হয় 'ঐ যে অমুক টিভিতে দেখলাম কিংবা তমুক পত্রিকায় পড়লাম?' কেবল পড়া এবং দেখাটাই কি যথেষ্ট? এ কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, 'আমরা তবে আর কী করব? আমরা হতদরিদ্র জনগণ, লোকে যা বলে তাই শুনি।' আজকাল তো এমন হয়েছে যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রায় সবারই একটি নিজস্ব মত আছে। অবশ্য এই মতটি কান-কথার ওপর নির্ভরশীল। কানের কথায় অতি পুরনো একটি কৌতুক মনে পড়ে গেল। এক লোককে বলা হলো, চিলে তার কান নিয়ে গেছে। সে নিজের কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা না করেই চিলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন দান করে ফেলল। এই যে নিজের কানটি আছে কি-না তা না দেখা বা নিজের জ্ঞানের পরিমিতির মধ্যে যে বোধগম্যতা আছে, তা দিয়ে কোনো বিষয় বোঝার চেষ্টা না করে কেবল চিলের পেছনে পেছনে দৌড়ানো_ এতে আমরা দিন দিন বড়ই কাহিল হয়ে পড়ছি।
একটু লক্ষ্য করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, আমাদের এই যে, যে কোনো বিষয়ে ত্বরিত অভিমত সৃষ্টি করা এবং তা নিয়ে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কথাবার্তা অবলীলায় এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে বলে যাওয়া_ এতে করে সমূহ বিপদের আশঙ্কজা থেকেই যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪১ বছর হলো। আমরা সবাই বলে বেড়াই যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে। আমরা যদি এতে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে থাকি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটিও আমাদের জানা দরকার। জানা দরকার কী কারণে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, যুদ্ধের সময় কারা আমাদের বন্ধু ছিল, যুদ্ধের পরেই-বা কারা আমাদের দিকে সব ব্যাপারে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই মৌল বিষয়গুলো যদি আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, তাহলে একটি ইতিবাচক স্থান থেকে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।
সম্প্রতি ২০১৩-তে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। এ সময় সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলবেন, অনেক অভিমত আমরা পাব এবং অনেক জলও গড়াবে বুড়িগঙ্গা দিয়ে। কিন্তু একটু ভাবলে আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের প্রতিটি নতুন বছর আসে, গড়িয়ে যায় অন্তের দিকে, আমরা অনেক নতুন কথা বলি বটে, কিন্তু প্রায় সব কাজই অসমাপ্ত থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। এ বছরও নানা কথা শুনছি, বেশিরভাগই হতাশাব্যঞ্জক কথা। তবে আমি জানি যে, শেষ পর্যন্ত শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা ঠিকই এগিয়ে যাব ২০১৪-এর দিকে। আমাদের হতাশা মুখরোচক চাটনির মতোই কাজ করে মনে হয় আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে। সে জন্য আমি এ নিয়ে বেশি ভাবিত হতে চাই না। আমি জানি না এ ধরনের মন্তব্য করার আগে কেউ কি একবারও ভেবে দেখেন যে, তার মন্তব্যে আসলেই কোনো সারবত্তা আছে কি-না? সেদিন ফেসবুকে আমার এবং তরুণ বন্ধু লিখেছিলেন, 'ইবভড়ৎব ঢ়ধংংরহম ুড়ঁৎ লঁফমসবহঃ, ধংশ!'_কোনো মন্তব্য করার আগে দয়া করে একবার জিজ্ঞেস করুন? এই বিষয়টিতেই আমাদের আগ্রহের সবচেয়ে বড় অভাব। যদি আমরা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই, তাহলে তো আর রসঘন মন্তব্য আমরা করতে পারব না! অথচ আমরা, বাঙালিরা কথা বলতেই ভালোবাসি। সে কথায় কোনো সারবত্তা থাকুক বা না-ই থাকুক। আমি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তরুণদের চিন্তা-ভাবনার কিছু জানতে শুরু করেছি। অস্বীকার করব না যে, আমি ক্রমেই তাদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ছি। এর মধ্যেও যুক্তির দ্যুতি যে একেবারেই নেই, তাও বলা যাবে না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় বেশি হালকা কথা আমাকে পীড়িত করে। আমি জানি যে, হালকা কথার আধিক্য এমন একটি হালকা জায়গায় থাকবেই। কিন্তু খুব গভীর এবং গম্ভীর বিষয় নিয়ে যখন অতি সরলিকরণ করা হয়, কেবল নিজেদের বাকচাতুর্য দেখানোর জন্য, তখন হতাশ হতেই হয়। অতীতে তরুণ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত ছিল, কিন্তু শিক্ষিত যারা ছিল, তারা ছিল পূর্ণ শিক্ষিত। আজকের অধিকাংশ তরুণ অর্ধশিক্ষিত। শঙ্কাটা এখানেই। তবে সব শেষে আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই। কেননা আমি জানি যে, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়/তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়/অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে/প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।"
অতএব, আমি অর্ধপ্রাপ্তিকে পূর্ণপ্রাপ্তি বলেই ধরে নিতে চাই। আশা করি আশাহত হবো না।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments