বঙ্গবন্ধুর ॥ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ by ড. শামস্ রহমান
(গত বুধবারের পর) মন্ত্রিত্ব পরিচালনায় ব্যর্থ হলে, তা হোক অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা বা পরিস্থিতিজনিত, কিংবা জনগণের নীরব (চবৎপবরাবফ) অসমর্থনজনিত, মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলে সৃষ্ট হয় এক ধরনের ভারচুয়াস (উৎকর্ষ) চক্র, যা ধাপে ধাপে রাজনৈতিক কাঠামোকে সংহত করে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সহায়ক।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে গণতন্ত্র ও বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ফুটে ওঠে বিভিন্নভাবে এবং আত্মজীবনীর বিভিন্ন অধ্যায়ে। তবে দুটি দিকই একসাথে প্রকাশ পায় ২৫ আগস্ট ১৯৫৫ বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের গণপরিষদে (করাচিতে) প্রদত্ত ভাষণে:‘ঝরৎ (ঃড় ঃযব ংঢ়বধশবৎ), ুড়ঁ রিষষ ংবব ঃযধঃ ঃযবু ধিহঃ ঃড় ঁংব ঃযব ঢ়যৎধংব দঊধংঃ চধশরংঃধহ’ রহংঃবধফ ড়ভ দঊধংঃ ইবহমধষ’. ডব যধাব ফবসধহফবফ সধহু ঃরসবং ঃযধঃ ুড়ঁ ংযড়ঁষফ ঁংব দইবহমধষ’ রহংঃবধফ ড়ভ চধশরংঃধহ. ঞযব ড়িৎফ দইবহমধষ’ যধং ধ যরংঃড়ৎু ধহফ ঃৎধফরঃরড়হ ড়ভ রঃং ড়হি. ণড়ঁ পধহ পযধহমব রঃ ড়হষু ধভঃবৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যধাব নববহ পড়হংঁষঃবফ. ...ডযু ফড় ুড়ঁ ধিহঃ রঃ ঃড় নব ঃধশবহ ঁঢ় ৎরমযঃ হড়?ি ডযধঃ ধনড়ঁঃ ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব, ইবহমধষর? ... ঝড়, ও ধঢ়ঢ়বধষ ঃড় সু ভৎরবহফং ড়হ ঃযধঃ ংরফব ঃড় ধষষড়ি ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ঃড় মরাব ঃযবরৎ াবৎফরপঃ রহ ধহু ধিু, রহ ঃযব ভড়ৎস ড়ভ ৎবভবৎবহফঁস ড়ৎ রহ ঃযব ভড়ৎস ড়ভ ঢ়ষবনরপরঃব’ (পৃ. ২৯৩)।
শত শত বছরের বাসস্থান ত্যাগে জনগোষ্ঠী রূপান্তরিত হয় মহাজিরে, এটা সত্য। তবে মহাজিরে রূপান্তর শুধু ফিজিক্যাল গ-িতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার ভাষা, ইতিহাস ও কৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে সেদিন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল নিজ বাসভূমিতেই বাঙালীদের মহাজির বানাতে। ভদ্রজনোচিত ও মৃদুকণ্ঠে সেদিন বঙ্গবন্ধু সেই কঠিন বিষয়টির প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গণপরিষদে। বলাবাহুল্য, প্রায় ষাট বছর পর সম্প্রতি পাকিস্তানের এক কলামিস্ট মন্তব্য করেন:
‘‘...ঃযব ৎবহধসরহম ড়ভ ঊধংঃ ইবহমধষ ধং ঊধংঃ চধশরংঃধহ রং ঃযব সড়ংঃ ফরারংরাব বাবহঃ রহ ঃযব ঢ়ড়ষরঃরপধষ যরংঃড়ৎু ড়ভ চধশরংঃধহ ধহফ ঃযব পৎরঃরপধষ ভরৎংঃ সরষবংঃড়হব ঃড়ধিৎফং ঃযব ফরারংরড়হ ড়ভ চধশরংঃধহ’ (ঝুবফ অহধিৎ গধযসড়ড়ফ সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২, জবসবসনবৎরহম নৎবধশ-ঁঢ় ড়ভ চধশরংঃধহ, ঞযব ঘবংি ওহঃবৎহধঃরড়হধষ)। নিঃসন্দেহে, ‘পূর্ব বাংলা’র নামের রূপান্তর একটি বিভেদকারী পদক্ষেপ। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ এখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর সকল সিদ্ধান্তই ছিল ভুল, অন্যায় ও অমানবিক। সময় এসেছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অর্থনৈতিক শোষণের এবং ’৭১’র যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায়ের জন্য ংড়ৎৎু বলা।
১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলেও, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন-বাঙালী ধর্মে গভীর বিশ্বাসী, তবে ধর্মের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি; স্বাধীনতার পর যা অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভের এক স্তম্ভে। যুক্তফ্রন্টে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেন গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া আসনে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান ঠান্ডা মিয়া। ধনবান এই প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে অবলম্বন করেন ধর্মকে। এলাকার মওলানাদের সংবদ্ধ করে ফতোয়া দেয়ার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আমাকে (বঙ্গবন্ধুকে) ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে’ (পৃ.২৫৬)। সেই সাথে আরও সেøাগান- (আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে) ‘পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে, ... মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মাতা। ... (আওয়ামী লীগ) হিন্দুদের দালাল, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা এক করতে চায়’ (পৃ.২৫৮)। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর ধারণা জন্মেÑ ‘জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে সেøাগান দিয়ে ধোঁকা দেয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না...’ (পৃ.২৫৮।
ধর্মকে মূলধন করে যারা রাজনীতি করে তাদের এ স্নোগানগুলো আমাদের অতি পরিচিত। ১৯৭০’র নির্বাচনেও শুনেছি এ ধরনের সেøাগান। তথাপি, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মতো ১৯৭০-এর নির্বাচনেও দেখেছি মুসলিম নীগ-জামাতের ভরাডুবি। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা ইসলামের জন্য একই সেøাগান তুলে আর কাজ করে মানবতার বিরুদ্ধে (‘আমাদের দেহ ও প্রাণ শুধু এবং শুধুই ইসলামের জন্য। আমরা ইসলামের জন্যই এসব কাজ করেছি (হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি)।....আমরা পাকিস্তানকে উপাস্য মনে করে নয়, মসজিদ মনে করে আমাদের ঝুঁকি ও আমাদের ভবিষ্যতকে এর ওপর ন্যাস্ত করেছিলাম’Ñডিসেম্বরে বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানের আল-বদর প্রধান আলী আহসান মোজাহিদের সমবেত আল-বদরের উদ্যোগে প্রদত্ত ভাষণের অংশ (জনকণ্ঠ, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২)। আজ ২০১২-তেও শুনি তাদের একই সেøাগানের ধ্বনি। তাদের কাজকর্মের ধারাবাহিকতায় বার বার প্রমাণ করে এরা ধর্মের নামে ধ্বংস ও হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারা ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী। তাদের শাস্তি পেতেই হবে মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায়ের জন্য। বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন এদের বিচার। অনেকের সাজাও হয়েছিল সে বিচারে। যারা বলে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেছেন, তারা মিথ্যা বলে। সাধারণ ক্ষমা তাদেরকেই করেছিলন, যাদের বিরুদ্ধে খুন-ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগের কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এগুলো কথার কথা নয়, এগুলো ডকুমেন্টেড ফ্যাক্ট (ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস্ বঙ্গবন্ধু হত্যা, পৃ .৫০; এবং জনকণ্ঠ, ১৪ ডিসেম্বর,২০১২)।
১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে তারা প্রতিবিপ্লবী। তাই তারা স্বাধীনতার পরাজিত ঘৃণ্যশক্তি রাজাকার-আলবদর, জামায়াত-মুসলিম লীগারদের পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে; আর পুনর্বহাল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। যারা যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বার্সিত করে, যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ব্যবসা করে; যারা ২০১২ সালের বিজয়ের মাসে ঢাকার পথে পথে হরতালের নামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংস ও হত্যার রাজনীতিকে সমর্থন জুগিয়েছেন; যারা যুদ্ধাপরাধী বিচারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে, তারা সব একই সূত্রে গাথা। তাদের শহীদ মিনারে কিংবা বৃদ্ধিজীবীদের সমাধিস্থলে যাওয়ার, অথবা বিজয়ের পতাকাতলে স্থান পাবার অধিকার আছে কি? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য, শুধু অসংলগ্নভাবে জানা নয়, বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের ঘটনা ধারাবাহিকতার সাথে বোঝা ও উপলব্ধির প্রয়োজন। তাই, স্বাধীনতাউত্তর প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু পাঠ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
১৯৭৩ থেকে ২০১২। প্রায় চল্লিশ বছর। ১৯৭৩ সালে বহির্বিশ্বের বহু সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশের মতামতকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছিলেন। নিঃসন্দেহে, এতে বঙ্গন্ধুর সাহসিকতার প্রমাণ মেলে; তবে সেদিনের বিচারের দ- দীর্ঘস্থায়ী হয়নি প্রতিবিপ্লবীদের থেকে অসর্তকতার কারণে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আবার শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধী বিচার। এ বিচারকার্যের মাঝে বাংলাদেশের আজকের সরকার প্রমাণ করেছে বঙ্গবন্ধুর সরকারের মতো তারাও সাহসী এবং গণমানুষের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এবারের বিচারের রায়কে স্থায়িত্বশীল করার জন্য প্রতিবিপ্লবীদের থেকে সতর্কের বিকল্প নেই। হত্যা ও ধ্বংসে এরা সিদ্ধহস্ত। ১৯৭১, ১৯৭৫ এবং ২০০৪-এর মতো যে কোন সময় তারা আবার আঘাত হানতে পারে। সেই সাথে সতর্ক থাকতে হবে বুদ্ধিজীবীদের, যারা তাদের লেখনীর মাঝে ক্রমাগত উন্মোচন করছেন ঘাতক দালাল, জামায়াত-শিবির এবং তাদের দোসরদের প্রকৃত চেহারা। রাজনৈতিক জীবনের বাইরে রাজনীতিকদেরও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন থাকে। বঙ্গবন্ধুরও ছিল। তবে তা রাজনীতির কারণে উপেক্ষিত হয়েছে। বার বার এবং তা এতটাই উপেক্ষিত হয় যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত সন্তানের কাছে পিতা রয়ে যায় যে কোন পুরুষরূপে (‘কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে?’ পৃ. ১৮৪)। যখন তাদের বিয়ে হয় তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হয়ত তের। আর তার সহধর্মিণী রেণুর বয়স তিন। পুতুল-পুতুল বিয়ে, পরবর্তিতে ফুলশয্যা এবং সময়ে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে এক সুন্দর সম্পর্ক। রেণু একদিকে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার উৎস, অন্যদিকে পালন করেছেন সংসারের ষোলো আনা দায়িত্ব। রাজনৈতিক কারণে টৃঙ্গিপাড়ার সংসার ছেড়ে কখনও তিনি কলকাতায়, কখনও ঢাকায়, কখন বা জেলে থাকা সত্ত্বেও, আত্মজীবনীতে এটা স্পষ্ট, তাদের মাঝের পার্থিব দীর্ঘ দূরত্বের পথ হৃদয়পটে রয়ে গেছে নাতিদীর্ঘ পথ হয়ে।
‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’তে খুঁজে পাওয়া যায় এক সাধারণ বাঙালীকে, যিনি দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার, নির্যাতন সহ্য, আর ক্ষমতার মোহ উপেক্ষা করে উত্তীর্ণ হয়েছেন এক মহান ব্যক্তিত্বে। তবে এটাও সত্য, যারা ইরম চরপঃঁৎব দেখে, তাদের জন্য খুঁটিনাটি দেখার সময় কোথায়? যারা দেশ দেখে, তাদের কাছে অনিচ্ছাকৃত উপেক্ষিত হয় সংসার। এ দোষে গান্ধীর মতো বঙ্গবন্ধুও দোষী। (সমাপ্ত)
লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, অর.এম.আই.টি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবর্ন, অস্ট্রেলিয়া
No comments