বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি by মোরসালিন মিজান
সত্যি, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়! মনেই হয় না, এটি ঢাকা! কনক্রিটের শহর যেন হঠাৎ বদলে গেছে। যেদিকে চোখ যায় খোলা প্রান্তর। চাইলেই পুরো আকাশটা দেখে ফেলা যায়। নিঃশ্বাসটুকু নেয়া যায় বুক ভরে। হ্যাঁ, নতুন রূপে প্রকাশিত হাতিরঝিল বেগুনবাড়ী এলাকার কথাই হচ্ছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, ঢাকা ওয়াসা এবং এলজিইডি সম্প্রতি বাস্তবায়ন করেছে এ প্রকল্প। পরামর্শক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। জানা যায়, স্বপ্ন আর বহু শ্রম ঘামে সম্পন্ন করা হয়েছে কাজটি। শুরুতে হাজারটা বিপত্তি ছিল। মোকদ্দমা হয়েছে অসংখ্য। তবে কোন কিছুই শেষ পর্যন্ত রুখতে পারেনি মহতি এ উদ্যোগ। সকল চ্যালেঞ্জ সাহসের সঙ্গে, সততার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। নিরলস পরিশ্রম করে অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এর পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর সর্বসাধারনের জন্য খুলে দেয়া হয় হাতিরঝিল বেগুনবাড়ী এলাকা।গত কয়েকদিন পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, রীতিমতো উৎসবের আমেজ। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারা দিনই আসছে মানুষ। স্বপরিবারে যেমন, তেমনি আসছেন বন্ধুরা মিলে। নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকল্প এলাকা। ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছেন। ছবি তুলছেন। কংক্রিটের বেঞ্চে একলাটি বসে থাকার মজাও কম নয়। তবে বিশেষভাবে আকর্ষণ করছে নান্দনিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় কয়েকটি সেতু। নানা আকৃতি ও চেহারার এসব সেতু থেকে নিচের দিকে তাকালে সত্যি অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য চোখে পড়ে। গাছপালাও লাগানো হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আছে মৌসুমী ফুলের বাগান। একটি প্রবেশ পথেই রয়েছে ২০ হাজারের মতো গাঁদা ফুল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্য। অসংখ্য লাইটের আলোয় নতুন রূপ ধারন করে হাতিরঝিল বেগুনবাড়ী এলাকা। রাতের এই সৌন্দর্য উপভোগ করার লোকও প্রচুর।
তবে এখনও ষোলআনা কাজ শেষ হয়নি। হযোনবাহন চলাচল সীমিত। পুরো কাজ শেষ হলে এলাকাটি ঢাকার সবচেয়ে বড় বিনোদন কেন্দ্র হয়ে ওঠবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। জানা যায়, রাজধানীর পুর্ব থেকে পশ্চিমের যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, যা বাস্তবায়নে ৯৩ শতাংশ অর্থের জোগান দেয় সরকার। ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর একনেকে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরে, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সমন্বিত এ প্রকল্পের প্রাণ হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল। এর দুই পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার সড়ক, চারটি সেতু, আরো চারটি ক্ষুদ্র সেতু (ভায়াডাক্ট) এবং চলাচলের জন্য চারটি ওভারপাস। প্রকল্প এলাকায় চরটি ব্রীজ এবং চারটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। প্রকল্পের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গুলশান সংযোগকারী একটি ব্রীজ এবং রামপুরা ব্রীজের দু’পাশে দু’টি ইউলুপ নির্মাণ। এ দু’টি ইউলুপ নির্মাণের কারণে হাতিরঝিল থেকে আসা সড়কটি রামপুরা প্রগতি সরনীতে এসে মিলেছে। এ জন্য কোন ইন্টারসেকশনের প্রয়োজন হবে না। ফলে বাড়তি যানজটের সৃষ্টি থেকে মুক্ত থাকবে। রামপুরা ব্রীজ এলাকায় বিদ্যমান যানজট কমে যাবে। টঙ্গী ডাইভারশন রোড অংশে ইউলুপ নির্মাণ করা হচ্ছে না। সাতরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এখানে ইউলুপ নির্মাণ করা হলে এই ফ্লাইওভারে গতিপথ বাধাগ্রস্থ হবে। তবে ফ্লাইওভারের একটি র্যাম হাতিরঝিলের একটি সড়কের সঙ্গে মিশে যাবে।
বলা বাহুল্য, এসব পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে প্রকৃতই বদলে যাবে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা। আর সেই বদলে যাওয়া ঢাকা দেখার অপেক্ষায় এখন নগরবাসী।
No comments