নারী নির্যাতন-দুর্ভাগা সমাজ by এলিনা খান
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি সফল আন্দোলন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ওই আন্দোলনে সব নারী সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল।
নারীসমাজ থেকে এর বিচার চেয়েছিলাম। একটা পর্যায়ে সরকার বাধ্য হলো ইয়াসমিন হত্যার বিচার করতে। কিন্তু এর পরের বছরেই আরও একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে রাউজানের থানা হেফাজতে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা না থাকায় সে হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ পর্যন্ত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এখনও নারীরা ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হলো এক স্কুলছাত্রী, যে এখনও জীবনের কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। কিছু হায়েনার লালসার শিকার হয়ে সে এখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সমকালকে ধন্যবাদ বিষয়টিকে সবার সামনে নিয়ে আসার জন্য। তা না হলে আরও পাঁচটা ঘটনার মতো এটাও হয়তো চাপা পড়ে যেত।
রাষ্ট্রকেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এটা শুধুই নারীর বিষয় নয়। যে মেয়েটা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়, পরিবারে তার স্বামী থাকে, ভাই-বোন থাকে, বাবা-মা থাকে। এ রকম ঘটনার পর দেখা যায়, তাদের সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ শুধু নারী বা শিশুই বিপর্যস্ত হচ্ছে_ তা নয়। টাঙ্গাইলের ঘটনাটিই যদি আমরা দেখি, মেয়েটির ভাইও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয়, একটি মেয়েকে চারজন মিলে পশুর মতো নির্যাতন করল; আর মেয়েটির বাবা কি-না ওই পশুদের দলেই শামিল হলেন! তিনি মেয়েটিকে আশ্রয় না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। দুর্ভাগ্য! পরে মামার বাড়িতেও আশ্রয় হলো না মেয়েটির। সমাজও তাকে আশ্রয় না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আমি বলব, ওই সমাজই দুর্ভাগা। দুর্ভাগা এ কারণে যে, সে নারীর নিরাপত্তা দিতে পারল না। এই সমাজ আর কতজনকে বের করে দেবে? আমি মনে করি, ওই বাবা, ওই সমাজ_ সবারই ভুল স্বীকার করা উচিত। মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো উচিত। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এই মেয়েটির কিছুই ফিরিয়ে আনা যাবে না। দিলি্লর মেয়েটির ক্ষেত্রে আন্দোলন শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা রাস্তায় নেমেছিল। আর তাই আসামি ধরা পড়েছে; বিচার হচ্ছে। এখানেও আসামিরা ধরা পড়েছে। কিন্তু ধরা পড়া মানেই সুবিচার নিশ্চিত হওয়া নয়।
নারীদের এখন সচেতন হতে হবে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে। রাস্তায় চলাফেরায় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য অনেক নারী বাসাতেও নিরাপদ নয়। স্পষ্ট করে এসব কথা তারা কাউকে বলতেও পারছে না। কিন্তু এসব ঘটনাকে চেপে রাখা যাবে না; প্রকাশ করতে হবে। যারা অপরাধী, তাদের বিচার করতে হবে। অপরাধীদের সবার সামনে আনতে হবে। এ জন্য কাজ করতে হবে সবাইকেই।
জনপ্রতিনিধিরা কেন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন না? সাধারণ জনগণই কেন সব সময় এগিয়ে যাবে? এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে গেলে নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়তে পারত না। আমরা যারা দূরে আছি, তারা পরে জানছি। কিন্তু যারা কাছে ছিলেন, তারা কেন পরে জানবেন? মাঝে-মধ্যেই দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব ঘটনায় ওই সব জনপ্রতিনিধিকে বয়কট করা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাওয়া উচিত। পুলিশও যে সব সময় সব স্থানে থাকবে_ তা নয়। স্থানীয় সরকারের এ ব্যাপারে কাজ করার কথা। কিন্তু তারা কোনো কাজ করছে না। এভাবে চলতে থাকলে নির্যাতন কমবে না, বরং বাড়বে।
পর্নোগ্রাফির ওপর তৈরি করা আইন শুধু শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ আইন সম্পর্কে গ্রামের মানুষকে জানাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে_ তাদের সুরক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ এখনও রেডিও শোনে না বা টিভি দেখে না। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার এবং মহিলা অধিদফতরকে কাজ করতে হবে। শুধু প্রচারের কারণে যৌতুক, এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা বাংলাদেশে তুলনামূলক অনেক কমেছে।
অনেকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন হলে তারা নিরাপদ হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ধর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার পর চিকিৎসক ইভাকে হত্যার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, ক্ষমতায়নই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। ইভা তার সাহস ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা থেকে রাতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু যার তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সে-ই তার ওপর বর্বরতা চালানোর চেষ্টা করে। নিজেকে ওই পশুর হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে ইভাকে নিজের জীবন দিতে হয়েছে। বর্তমানে যেসব নারী মন্ত্রী রয়েছেন, তারাও নিরাপদ নন। তাদের পেছন থেকে পুলিশ ফোর্স সরে গেলে সাধারণ নারী হিসেবে হাঁটার সময় তিনিও ঝুঁকিপূর্ণ।
নারীদের বলা হয় রাতে রাস্তায় একা চলাচল না করার জন্য। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। বরং রাস্তাকেই নারীর জন্য নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবে হ্যাঁ; নারীর জন্য রাস্তা নিষিদ্ধ হতে পারে, যদি সে রাস্তা একই সময়ে পুরুষের জন্যও নিষিদ্ধ হয়। পুরুষরা রাতে হেঁটে যেতে পারলে নারীরা কেন পারবে না? গার্মেন্ট কর্মীদের বলা হয়, তারা যেন দল বেঁধে হাটে। কিন্তু কেন? যে শ্রমিক কোনো দলে ঢুকতে পারেনি, অথবা নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে; সে কি কাজে যাবে না?
টাঙ্গাইলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে তার বান্ধবী বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ওই বান্ধবী নিজেও কিশোরী। সে নিজে থেকে কিছু করেনি। তাকে দিয়ে করানো হয়েছে। তাকে প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজ করানো হয়। ওই মেয়েটি সচেতন হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন স্কুল-কলেজে পাঠদানের পাশাপাশি সচেতনতা গড়ে তোলা। এখন শুধু সমবেদনা জানালেই চলবে না, মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ সমস্যা কোনো একটি মেয়ের সমস্যা নয়। এটি পরিবারের সমস্যা, সমাজের সমস্যা_ সর্বোপরি এটি রাষ্ট্রের সমস্যা। তাই রাষ্ট্রকেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এলিনা খান :মানবাধিকার কর্মী
রাষ্ট্রকেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এটা শুধুই নারীর বিষয় নয়। যে মেয়েটা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়, পরিবারে তার স্বামী থাকে, ভাই-বোন থাকে, বাবা-মা থাকে। এ রকম ঘটনার পর দেখা যায়, তাদের সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ শুধু নারী বা শিশুই বিপর্যস্ত হচ্ছে_ তা নয়। টাঙ্গাইলের ঘটনাটিই যদি আমরা দেখি, মেয়েটির ভাইও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয়, একটি মেয়েকে চারজন মিলে পশুর মতো নির্যাতন করল; আর মেয়েটির বাবা কি-না ওই পশুদের দলেই শামিল হলেন! তিনি মেয়েটিকে আশ্রয় না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। দুর্ভাগ্য! পরে মামার বাড়িতেও আশ্রয় হলো না মেয়েটির। সমাজও তাকে আশ্রয় না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আমি বলব, ওই সমাজই দুর্ভাগা। দুর্ভাগা এ কারণে যে, সে নারীর নিরাপত্তা দিতে পারল না। এই সমাজ আর কতজনকে বের করে দেবে? আমি মনে করি, ওই বাবা, ওই সমাজ_ সবারই ভুল স্বীকার করা উচিত। মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো উচিত। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এই মেয়েটির কিছুই ফিরিয়ে আনা যাবে না। দিলি্লর মেয়েটির ক্ষেত্রে আন্দোলন শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা রাস্তায় নেমেছিল। আর তাই আসামি ধরা পড়েছে; বিচার হচ্ছে। এখানেও আসামিরা ধরা পড়েছে। কিন্তু ধরা পড়া মানেই সুবিচার নিশ্চিত হওয়া নয়।
নারীদের এখন সচেতন হতে হবে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে। রাস্তায় চলাফেরায় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য অনেক নারী বাসাতেও নিরাপদ নয়। স্পষ্ট করে এসব কথা তারা কাউকে বলতেও পারছে না। কিন্তু এসব ঘটনাকে চেপে রাখা যাবে না; প্রকাশ করতে হবে। যারা অপরাধী, তাদের বিচার করতে হবে। অপরাধীদের সবার সামনে আনতে হবে। এ জন্য কাজ করতে হবে সবাইকেই।
জনপ্রতিনিধিরা কেন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন না? সাধারণ জনগণই কেন সব সময় এগিয়ে যাবে? এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে গেলে নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়তে পারত না। আমরা যারা দূরে আছি, তারা পরে জানছি। কিন্তু যারা কাছে ছিলেন, তারা কেন পরে জানবেন? মাঝে-মধ্যেই দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব ঘটনায় ওই সব জনপ্রতিনিধিকে বয়কট করা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাওয়া উচিত। পুলিশও যে সব সময় সব স্থানে থাকবে_ তা নয়। স্থানীয় সরকারের এ ব্যাপারে কাজ করার কথা। কিন্তু তারা কোনো কাজ করছে না। এভাবে চলতে থাকলে নির্যাতন কমবে না, বরং বাড়বে।
পর্নোগ্রাফির ওপর তৈরি করা আইন শুধু শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ আইন সম্পর্কে গ্রামের মানুষকে জানাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে_ তাদের সুরক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ এখনও রেডিও শোনে না বা টিভি দেখে না। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার এবং মহিলা অধিদফতরকে কাজ করতে হবে। শুধু প্রচারের কারণে যৌতুক, এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা বাংলাদেশে তুলনামূলক অনেক কমেছে।
অনেকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন হলে তারা নিরাপদ হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ধর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার পর চিকিৎসক ইভাকে হত্যার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, ক্ষমতায়নই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। ইভা তার সাহস ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা থেকে রাতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু যার তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সে-ই তার ওপর বর্বরতা চালানোর চেষ্টা করে। নিজেকে ওই পশুর হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে ইভাকে নিজের জীবন দিতে হয়েছে। বর্তমানে যেসব নারী মন্ত্রী রয়েছেন, তারাও নিরাপদ নন। তাদের পেছন থেকে পুলিশ ফোর্স সরে গেলে সাধারণ নারী হিসেবে হাঁটার সময় তিনিও ঝুঁকিপূর্ণ।
নারীদের বলা হয় রাতে রাস্তায় একা চলাচল না করার জন্য। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। বরং রাস্তাকেই নারীর জন্য নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবে হ্যাঁ; নারীর জন্য রাস্তা নিষিদ্ধ হতে পারে, যদি সে রাস্তা একই সময়ে পুরুষের জন্যও নিষিদ্ধ হয়। পুরুষরা রাতে হেঁটে যেতে পারলে নারীরা কেন পারবে না? গার্মেন্ট কর্মীদের বলা হয়, তারা যেন দল বেঁধে হাটে। কিন্তু কেন? যে শ্রমিক কোনো দলে ঢুকতে পারেনি, অথবা নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে; সে কি কাজে যাবে না?
টাঙ্গাইলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে তার বান্ধবী বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ওই বান্ধবী নিজেও কিশোরী। সে নিজে থেকে কিছু করেনি। তাকে দিয়ে করানো হয়েছে। তাকে প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজ করানো হয়। ওই মেয়েটি সচেতন হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন স্কুল-কলেজে পাঠদানের পাশাপাশি সচেতনতা গড়ে তোলা। এখন শুধু সমবেদনা জানালেই চলবে না, মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ সমস্যা কোনো একটি মেয়ের সমস্যা নয়। এটি পরিবারের সমস্যা, সমাজের সমস্যা_ সর্বোপরি এটি রাষ্ট্রের সমস্যা। তাই রাষ্ট্রকেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এলিনা খান :মানবাধিকার কর্মী
No comments