ইসলামে উদারতা ও মধ্যপন্থা অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
ইসলাম আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ইন্নাদ দীনা ‘ইন্দাল্লাহিল ইসলাম Ñ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম মানব জীবনের যাবতীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম উদারতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের জোর তাকীদ দিয়েছে।
ইসলামে উগ্রতা, চরমপন্থা, জীবনকে স্থবির করে দেয় এমন কোনো পন্থা, কিম্বা মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, খুনোখুনি, মারামারি, গুম, খুন ইত্যাদি কোনোরূপ অমানবিকতার স্থান নেই। কুরআন মজীদে মুসলিমদের মধ্যপন্থী উম্মত বলা হয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তোমাদের মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিÑযাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী হতে পারো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৪৩)।ইসলাম মানব জীবনের যাবতীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম উদারতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের জোর তাকীদ দিয়েছে।
ইসলামে জিহাদের যে নির্দেশ রয়েছে তা কিন্তু চরমপন্থা নয়। সত্যকে, শান্তিকে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মকভাবে বারবার চেষ্টা করার নামই হচ্ছে জিহাদ, সেখানে উগ্রতার কোনো স্থান নেই। ইসলাম সমগ্র মানব জাতিকে একই উম্মত (জাতি) হিসেবে সংস্থাপিত করবার চেতনায় উজ্জীবিত করেছে। ইরশাদ হয়েছে : হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রব-কে ভয় করোÑযিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন (সূরা নিসা : আয়াত ১)।
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আওয়াল মক্কা মুকররমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করে যাবার পর প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনার সনদ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে যে মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন, সেই মদীনা রাষ্ট্রের সেই সনদে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে একটি উম্মত হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই শর্তগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখিত ছিল যে, এই মদীনা সবার কাছে পবিত্র বলে গণ্য হবে, কখনো যদি এই মদীনা বহিশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সবাই সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ উদ্যোগে আক্রমণ প্রতিহত করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ৪৭ ধারা বিশিষ্ট পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত এই শাসনতন্ত্রে এটাও বলা ছিল যে, এই সনদে স্বাক্ষরকারী (ইয়াহুদী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়) কেউ যদি এর কোন একটি ধারা লঙ্ঘন করে তাকে সে জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।
ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই আমরা দেখতে পাবো মুসলিমরা যখনো আগ্রাসী হয়নি বরংআগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনে তাদের যুদ্ধেরও মুকাবিলা করতে হয়েছে এবং তারা বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছে। তারা বন্দীদের প্রতি উদারনীতি প্রদর্শনেই কেবল করেনি, নিজেরা কম খেয়ে বন্দীদের পেটপুরে খেতে দিয়েছে, নিজেরা হেঁটে বন্দীদেরকে বাহনে আরোহণ করিয়েছে।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কাফির-মুশরিকদের সাথে হুদায়বিয়া নামক স্থানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সন্ধি বা শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় তাতে মুসলিমের জন্য কিছুটা অপমানজনক শর্ত থাকলেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইয়হি ওয়া সাল্লাম শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু এই সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় আখ্যায়িত করে ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের দিয়েছি বিজয় যা সুস্পষ্ট বিজয় (সূরা ফাতহ্্ : আয়াত ১)।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তাবত কিছুর মধ্যে উত্তম হচ্ছে মধ্যপন্থা। (মিশকাত শরিফ)।
আমরা প্রতিটা সালাতে যে সূরা ফাতিহা পাঠ করি তাতে আল্লাহর কাছে আমরা দু’আ করি এই বলে : আমাদের প্রদর্শন করো সরল পথ, তাদের পথ, যাদের তুমি নি’আমত দান করেছো (সূরা ফাতিহা : আয়াত ৫-৬)।
আস্্সিরাতুল মুস্্তাকীম বা সহজ-সরল পথই হচ্ছে ইসলাম। ইসলামকে সত্য-(দীনুল হক) বলা হয়। এই দীনের শব্দগত মূল অর্থই হচ্ছে শান্তি, আর সে শান্তি বিশ্ব জগতের তাবত কিছু কল্যাণের শান্তি।
ইসলাম গতানুগতিক আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যা প্রগতিশীল এবং ডায়নামিক।
ইসলাম যে পঞ্চ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রতিটি স্বম্ভ সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তাতে মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত হয়েছে। আমরা যখন লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলি তখন এ প্রত্যয় সুদৃঢ় হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই।
সালাত (ফারসী নামায)-এর মাধ্যমে আমরা যেমন পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহর হুজুরে হাজিরা দেই, আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধও হই। সওম (ফারসী রোযা)-এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, আত্মসমর্পণ অর্জনের প্রশিক্ষণ যেমন নেই তেমনি সামাজিক সৌহার্দ্য ও সমবেদনার অনুভবও আত্মস্থ করি; আবার যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করে সমতার দুনিয়া গড়বার শপথে বলীয়ান হই। হজ্জ পালনের মাধ্যমে আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের এক অনন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
কুরআন মজীদে উদার হবার তাকীদ বারবার এসেছে এবং শান্তি কায়েমের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের পারস্পরিক অভিবাদনেও পরস্পরের শান্তির জন্য দু’আ রয়েছে অর্থাৎ আস্্সালাম,ু ‘আলায়কুম ওয়া আলায়কুমুস সালাম।
কুরআন মজীদে উদার ও ক্ষমাশীল হবার হুকুম দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : এবং ক্ষমা করে দেয়াটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী। তোমরা নিজেদের মধ্যে সদয়শতার কথা বিস্মৃত হয়ে যেয়ো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৩৭)।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি উদার হয় সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, সে জান্নাত ও জনসাধারণের অতি সন্নিকটে থাকে এবং তার অবস্থান হয় জাহান্নামের অগ্নিকু- হতে বহু দূরে। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা থেকে দূরে থাকে, জান্নাত ও জনগণ থেকেও দূরে থাকে, আর সে জাহান্নামের অগ্নিকু-ের অতি নিকটে অবস্থান করে।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তাদের যে জীবিকা (রিযক) দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় (দান) করে। তারই আশা করতে পারে এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই। (সূরা ফাতির : আয়াত ২৯)।
ইসলাম জীবন-যাপনে বিলাসিতা ও অপচয় পরিহার করে ভারসাম্য নীতি ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করার পথনির্দেশনা দেয়। যে সমস্ত ব্যক্তি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপন করে এবং মধ্যপন্থী, তাদের প্রশংসা করে ইরশাদ হয়েছে : আর যারা খরচ করার সময় অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এই দুইয়ের মধ্যখানে মধ্যম পন্থায়। (সূরা ফুরকান : আয়াত ৬৭)।
ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও জোর-জবরদস্তি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : দীনে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)। তোমাদের দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। (সূরা নিসা : আয়াত ১৭১)।
বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে মানুষ! তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক কওম (জাতি) ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসলামের উদারতা ও মধ্যপন্থা ইসলামকে সবখানে বিজয়ীর মসনদে অধিষ্ঠিত করেছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত ধর্মের ওপর একে জয়যুক্ত করবার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা ফাত্্হ : আয়াত ২৮)।
ইসলামে যে উদারতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা রয়েছে তা সঠিকভাবে গ্রহণ করার মধ্যেই বিশ্বশান্তি নিহিত রয়েছে। ইসলামকে যারা মুখের বুলি হিসাবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা অপশক্তির স্বার্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত থাকে তারা মূলত মুনাফিক; আর মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও জঘন্য। ইসলামের বড় শত্রু মুনাফিকরা।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
ইসলামে উদারতা ও মধ্যপন্থা
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
ইসলাম আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ইন্নাদ দীনা ‘ইন্দাল্লাহিল ইসলাম Ñ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম মানব জীবনের যাবতীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম উদারতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের জোর তাকীদ দিয়েছে। ইসলামে উগ্রতা, চরমপন্থা, জীবনকে স্থবির করে দেয় এমন কোনো পন্থা, কিম্বা মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, খুনোখুনি, মারামারি, গুম, খুন ইত্যাদি কোনোরূপ অমানবিকতার স্থান নেই। কুরআন মজীদে মুসলিমদের মধ্যপন্থী উম্মত বলা হয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তোমাদের মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিÑযাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী হতে পারো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৪৩)।
ইসলামে জিহাদের যে নির্দেশ রয়েছে তা কিন্তু চরমপন্থা নয়। সত্যকে, শান্তিকে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মকভাবে বারবার চেষ্টা করার নামই হচ্ছে জিহাদ, সেখানে উগ্রতার কোনো স্থান নেই। ইসলাম সমগ্র মানব জাতিকে একই উম্মত (জাতি) হিসেবে সংস্থাপিত করবার চেতনায় উজ্জীবিত করেছে। ইরশাদ হয়েছে : হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রব-কে ভয় করোÑযিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন (সূরা নিসা : আয়াত ১)।
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আওয়াল মক্কা মুকররমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করে যাবার পর প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনার সনদ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে যে মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন, সেই মদীনা রাষ্ট্রের সেই সনদে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে একটি উম্মত হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই শর্তগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখিত ছিল যে, এই মদীনা সবার কাছে পবিত্র বলে গণ্য হবে, কখনো যদি এই মদীনা বহিশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সবাই সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ উদ্যোগে আক্রমণ প্রতিহত করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ৪৭ ধারা বিশিষ্ট পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত এই শাসনতন্ত্রে এটাও বলা ছিল যে, এই সনদে স্বাক্ষরকারী (ইয়াহুদী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়) কেউ যদি এর কোন একটি ধারা লঙ্ঘন করে তাকে সে জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।
ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই আমরা দেখতে পাবো মুসলিমরা যখনো আগ্রাসী হয়নি বরংআগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনে তাদের যুদ্ধেরও মুকাবিলা করতে হয়েছে এবং তারা বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছে। তারা বন্দীদের প্রতি উদারনীতি প্রদর্শনেই কেবল করেনি, নিজেরা কম খেয়ে বন্দীদের পেটপুরে খেতে দিয়েছে, নিজেরা হেঁটে বন্দীদেরকে বাহনে আরোহণ করিয়েছে।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কাফির-মুশরিকদের সাথে হুদায়বিয়া নামক স্থানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সন্ধি বা শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় তাতে মুসলিমের জন্য কিছুটা অপমানজনক শর্ত থাকলেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইয়হি ওয়া সাল্লাম শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু এই সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় আখ্যায়িত করে ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের দিয়েছি বিজয় যা সুস্পষ্ট বিজয় (সূরা ফাতহ্্ : আয়াত ১)।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তাবত কিছুর মধ্যে উত্তম হচ্ছে মধ্যপন্থা। (মিশকাত শরিফ)।
আমরা প্রতিটা সালাতে যে সূরা ফাতিহা পাঠ করি তাতে আল্লাহর কাছে আমরা দু’আ করি এই বলে : আমাদের প্রদর্শন করো সরল পথ, তাদের পথ, যাদের তুমি নি’আমত দান করেছো (সূরা ফাতিহা : আয়াত ৫-৬)।
আস্্সিরাতুল মুস্্তাকীম বা সহজ-সরল পথই হচ্ছে ইসলাম। ইসলামকে সত্য-(দীনুল হক) বলা হয়। এই দীনের শব্দগত মূল অর্থই হচ্ছে শান্তি, আর সে শান্তি বিশ্ব জগতের তাবত কিছু কল্যাণের শান্তি।
ইসলাম গতানুগতিক আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যা প্রগতিশীল এবং ডায়নামিক।
ইসলাম যে পঞ্চ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রতিটি স্বম্ভ সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তাতে মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত হয়েছে। আমরা যখন লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলি তখন এ প্রত্যয় সুদৃঢ় হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই।
সালাত (ফারসী নামায)-এর মাধ্যমে আমরা যেমন পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহর হুজুরে হাজিরা দেই, আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধও হই। সওম (ফারসী রোযা)-এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, আত্মসমর্পণ অর্জনের প্রশিক্ষণ যেমন নেই তেমনি সামাজিক সৌহার্দ্য ও সমবেদনার অনুভবও আত্মস্থ করি; আবার যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করে সমতার দুনিয়া গড়বার শপথে বলীয়ান হই। হজ্জ পালনের মাধ্যমে আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের এক অনন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
কুরআন মজীদে উদার হবার তাকীদ বারবার এসেছে এবং শান্তি কায়েমের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের পারস্পরিক অভিবাদনেও পরস্পরের শান্তির জন্য দু’আ রয়েছে অর্থাৎ আস্্সালাম,ু ‘আলায়কুম ওয়া আলায়কুমুস সালাম।
কুরআন মজীদে উদার ও ক্ষমাশীল হবার হুকুম দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : এবং ক্ষমা করে দেয়াটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী। তোমরা নিজেদের মধ্যে সদয়শতার কথা বিস্মৃত হয়ে যেয়ো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৩৭)।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি উদার হয় সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, সে জান্নাত ও জনসাধারণের অতি সন্নিকটে থাকে এবং তার অবস্থান হয় জাহান্নামের অগ্নিকু- হতে বহু দূরে। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা থেকে দূরে থাকে, জান্নাত ও জনগণ থেকেও দূরে থাকে, আর সে জাহান্নামের অগ্নিকু-ের অতি নিকটে অবস্থান করে।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তাদের যে জীবিকা (রিযক) দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় (দান) করে। তারই আশা করতে পারে এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই। (সূরা ফাতির : আয়াত ২৯)।
ইসলাম জীবন-যাপনে বিলাসিতা ও অপচয় পরিহার করে ভারসাম্য নীতি ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করার পথনির্দেশনা দেয়। যে সমস্ত ব্যক্তি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপন করে এবং মধ্যপন্থী, তাদের প্রশংসা করে ইরশাদ হয়েছে : আর যারা খরচ করার সময় অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এই দুইয়ের মধ্যখানে মধ্যম পন্থায়। (সূরা ফুরকান : আয়াত ৬৭)।
ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও জোর-জবরদস্তি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : দীনে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)। তোমাদের দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। (সূরা নিসা : আয়াত ১৭১)।
বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে মানুষ! তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক কওম (জাতি) ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসলামের উদারতা ও মধ্যপন্থা ইসলামকে সবখানে বিজয়ীর মসনদে অধিষ্ঠিত করেছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত ধর্মের ওপর একে জয়যুক্ত করবার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা ফাত্্হ : আয়াত ২৮)।
ইসলামে যে উদারতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা রয়েছে তা সঠিকভাবে গ্রহণ করার মধ্যেই বিশ্বশান্তি নিহিত রয়েছে। ইসলামকে যারা মুখের বুলি হিসাবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা অপশক্তির স্বার্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত থাকে তারা মূলত মুনাফিক; আর মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও জঘন্য। ইসলামের বড় শত্রু মুনাফিকরা।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
No comments