পাঠ্যবই নিয়ে নানা কৌশলে বাণিজ্যে মেতেছে নোট গাইড ব্যবসায়ীরা
নতুন বছর শুরু হতেই পাঠ্যবই নিয়ে নানা কৌশলে অবৈধ বাণিজ্যে মেতে উঠেছে ভূঁইফোড় প্রকাশক মুদ্রণ সমিতির নেতা ও নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা। এতদিন কেবল নোট-গাইড নিয়ে বাণিজ্য করলেও এবার তারা হাত দিয়েছে খোদ সারাদেশের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের মানবণ্টনপত্রে।
সরকারীভাবে বিনামূল্যে যে মানবণ্টনপত্র দেয়া হবে তা নিজেরাই ইচ্ছেমতো ছাপিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে এ অসাধুচক্র। আইন অনুসারে কঠোর শাস্তিমূলক অপরাধ হলেও সরকারের বিনামূল্যের মানবণ্টনপত্র নিয়ে এ ধরনের অপকর্ম নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ এ চক্রটি। অবিলম্বে চিহ্নিত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন শিক্ষাবিদ এমনকি পাঠ্যবই ব্যবসায়ীরাও। জানা গেছে, এবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন শিক্ষাবর্ষের পুরো কারিকুলাম যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করেছে। নতুন শিক্ষাক্রম তৈরিতে সময় কেটে যাওয়ায় প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের জন্য মানবণ্টনপত্র এখনও প্রস্তুত হয়নি। এর আগে গত বছরও পাঠ্যবইয়ের পর পরই আলাদা করে মানবণ্টনপত্র সরকার সরবরাহ করেছে। এবার সেই কাজ এখনও সরকার শেষ করতে না পারার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু নোট ও গাইড ব্যবসায়ী নিজেদের মনগড়া মানবণ্টন তৈরি করে নিম্নমানের নোট ও গাইড বই ছেপে খোলাবাজারে অবাধে বিক্রি করছে। এর মধ্যে শীর্ষে আছে পাঞ্জেরী ও লেকচার নামের দুটি প্রকাশনী। এই দুই প্রকাশনীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাংলাবাজারের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই এনসিটিবির কাছে অভিযোগ করেছেন। রাজধানীর বাংলাবাজার ও নীলক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স ও লেকচার প্রকাশনীর নোট-গাইড বই এবং মানবণ্টনপত্রে বাজার সয়লাব। স্কুলগুলোর আশপাশের লাইব্রেরিও ছেয়ে গেছে বেআইনী প্রক্রিয়ায় এ বইয়ে। ‘একের ভিতর এগারো’ ও ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সহায়িকা’ এসব নামে প্রকাশ্যে তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। রাজধানীর সব নামী-দামী স্কুলের পাশের লাইব্রেরিতেই পাওয়া যাচ্ছে পাঞ্জেরী প্রকাশনীর তৃতীয় শ্রেণীর সহায়িকা নামের এসব বই। শিশুদের আকৃষ্ট করতে একটির নাম রাখা হয়েছে ‘একের ভিতর এগারো।’ বইয়ের গায়ে লেখা আছে ‘সৃজনশীল ধারায় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের আলোকে রচিত।’ এই বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় বলা হয়েছে, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী বা এনএপিই’র নির্দেশনা অনুযায়ী যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রসহ মডেল টেস্ট ও উত্তর দেয়া আছে। এ বইটির বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭১ টাকা। এ প্রকাশনীর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার ওপর চার খ-ের একটি বই রয়েছে। বইটির নাম হচ্ছে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সহায়িকা।’ বইয়ের প্রচ্ছদে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘সৃজনশীল ধারায় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের আলোকে রচিত।’ এর ৮ নম্বর পাতায় এনএপিই কর্তৃক প্রবর্তিত সর্বশেষ পরিবর্তিত প্রশ্নপত্র কাঠামো ও নম্বর বিভাজনের আলোকে সম্ভাব্য প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বিভাজনের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিশুদের জন্য সরকার যে বই বা মানবণ্টনপত্র সরবরাহ করছে তা অসাধু ব্যবসায়ীরা কিভাবে বিক্রি করছে এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামালউদ্দিন বলেন, পাঠ্যবই কিংবা মানবণ্টনপত্র নকল করে কেউ শিশুদের নিয়ে বাণিজ্য করলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। দ্রুত তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।এদিকে জানা গেল, প্রাথমিক স্তরের সিলেবাস ও মানবণ্টনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যথাক্রমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও এনএপিই (ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারী এডুকেশন) ময়মনসিংহকে। এনএপিই বা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর মানবণ্টন বিষয়ে এখনও কাজই শুরু করতে পারেনি। মানবণ্টন প্রস্তুত করতে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগবে। অথচ অসাধু প্রকাশকরা প্রচারণা চালাচ্ছে, প্রাথমিক স্তরের বাজারজাতকৃত নোট-গাইড বইগুলো ‘এনএপিই ফরম্যাটে (কাঠামো)’ তৈরি করা হয়েছে। তারা সারাদেশের খুদে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গত ডিসেম্বর থেকেই অবাধে নিম্নমানের নোট-গাইড বই বিক্রি করে আসছে। কিন্তু অসাধু প্রকাশকদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে পুলিশ অবৈধ এই বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। অভিযোগ আছে, সব ক্ষেত্রেই পুলিশের অভিযান পরিচালনার আগাম খবর পৌঁছে যায় অসাধু প্রকাশকদের কাছে। এনএপিইর কর্মকর্তারা বলেছেন, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এনএপিইর নাম ব্যবহার করে সারাদেশে প্রাথমিক স্তরের মানবণ্টনের নকল ফরম্যাট বিক্রি করছে। এটা অপরাধ। জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, নতুন পাঠ্যবইয়ের মানবণ্টন তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এনএপিইকে। তারা এখনও মানবণ্টন প্রস্তুত করেনি। কিন্তু কেউ যদি এনএপিইর নাম ব্যবহার করে বাজারে মানবণ্টন কিংবা নোট-গাইড বিক্রি করে তাহলে অবশ্যই অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুদের বই নিয়ে কাউকে প্রতারণা করতে দেয়া হবে না।
No comments