স্বপ্নের শালিমার by মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক
(পূর্ব প্রকাশের পর) পরবর্তীতে এ খালটিকে হানসি নহর বা হাসির জলধারা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল। ১৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বর্তমান ভারতের রাজপুরের জল উৎস থেকে এ খালের মাধ্যমে এখানে জল সরবরাহ করা হতো। খালের প্রবাহিত জল বাগানের মধ্যম চত্বরে শ্বেত পাথরে নির্মিত কৃত্রিম উপত্যকায় নিপতিত হতো এবং সেখান থেকে অন্যত্র জল সিঞ্চন করা হতো।
এ বাগিচার প্রতিটি চত্বরে নির্দিষ্ট পরিমাপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চার শ’ দশটি ঝরনা। তখনকার দিনে এখনকার মতো উপরে জল তোলার জন্য কোনো পাম্প মেশিন ছিল না। আদি প্রযুক্তির সাহায্যে খালের মাধ্যমে আনীত জল বিশেষ ব্যবস্থায় শ্বেত পাথরে নির্মিত উঁচু জলাধারে উঠিয়ে পুনঃসঞ্চালনের মাধ্যমে ঝরনাগুলো সচল রাখা হতো। সে আমলে এ ব্যবস্থা এক আশ্চর্য ঘটনা হিসেবেই আমজনতার কাছে বিবেচিত হতো। বলা বাহুল্য মুঘলদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাই এটি সম্ভব করে তুলেছিল। শুধু সৌন্দর্য বিধানের জন্য ঝরনাধারার মাধ্যমে জল সঞ্চালন করা হতো না, এর মাধ্যমে পুরো বাগিচাটিকে শীতল রাখারও ব্যবস্থা করা হতো। এখনকার মতো তখনকার দিনেও এ এলাকার তাপ মাত্রা ছিল অসহনীয়, কখনও কখনও রোদের উত্তাপ ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও উপনীত হতো। এ অবস্থায় পুরো এলাকার পরিবেশ শীতলকরণের জন্য এ ধরনের ঝরনার অপরিহার্যতা ছিল অত্যাবশ্যক। এখনও যে সমস্ত দেশী-বিদেশী পর্যটক গ্রীষ্মকালে লাহোর ভ্রমণের সময় বাগিচায় পদার্পণ করেন, তারাও ঝরনাধারার পরশে অসহনীয় গরম থেকে কিছুটা সময়ের জন্য নিষ্কৃতি পেয়ে থাকেন।সুপরিকল্পিভাবে বিন্যাসিত সর্বোচ্চ স্তরের চত্বরটিতে স্থাপন করা হয়েছে ১০৫টি মধ্যম চত্বরে ১৫২টি এবং নিচের চত্বরে ১৫৩টি ঝরনা। এ সমস্ত ঝরনাধারা ছাড়াও সমগ্র বাগিচায় পাঁচটি কৃত্রিম জলপ্রপাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। এসব জল প্রপাত সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়েছিল উন্নত মানের মার্বেল পাথর। এর সঙ্গে রাতে চাঁদের আলো ছাড়াও প্রজ্বালন করা হতো নানা রঙের অসংখ্য প্রদীপ। প্রদীপের আলোতে জলধারা পেত এক অনন্য অবয়ব। এর সঙ্গে বাড়তি সৌন্দর্য হিসেবে নৃত্য পটিয়সীদের উপস্থিতিতো ছিলই।
এখানে নানা ধরনের ভবনেরও সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল, সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের আনন্দ বিনোদন সুখ স্বচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে সব কিছুরই সংস্থান রাখা হয়েছিল। যেহেতু এ বাগিচাটিকে স্বর্গের আদলে সৃষ্টি করার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল সেহেতু এখানে যেন কোনো কিছুর ঘাটতি না থাকে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচতেনতা অবলম্বন করা হয়েছিল। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কার্পণ্য করা হয়নি। যে কারণে নির্মাণ করা হয়; বিস্তৃত খোলা চত্বর যেটিকে বলা হয় সোয়ান বাদুম, পরিচর্যকদের জন্য নির্মাণ করা হয় নওকর খানা, সম্রাটের ঘুমানোর জন্য নির্মাণ করা হয় খোয়াব গাও বা স্বপ্নপুরী, স্নানের জন্য রাজকীয় হাম্মামখানা। আড্ডার সমাবেশের জন্য বিশাল বৈঠকখানা, সাময়িক বিশ্রামের জন্য আরাম গাও, সম্রাজ্ঞীদের ঘুমানোর জন্য আলাদা স্বপ্নপুরী যা বিবি সাহেবানদের স্বপ্নপুরী নামে খ্যাত। গ্রীষ্মকালে ঝরনার জলধারা উপভোগের জন্য মহিলাদের স্বতন্ত্র চত্বর, সাধারণের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দেওয়ানই আম, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দেওয়ান-ই খাস, দুটি বিশাল তোরণ এবং সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বাগিচার প্রতি কোণে সুউচ্চ মিনার।
সবুজের প্রতি মুঘলদের নিঝুম হৃদয়ের কোথায় যেন একটি ভাললাগার অনুভূতি জড়িয়ে ছিল, যে কারণে নানা জাতের বৃক্ষ রোপণ ও লালনে এদের সচেতন উদ্যোগ সর্বত্রই পরিদৃষ্ট হয়। এ কারণে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, ফল ও বৃক্ষের বর্ধিষ্ণু সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল পুরো বাগিচায়। অনেক প্রজাতির বৃক্ষের উপস্থিতি এখনও এখানে দৃশ্যমান। এখানে রোপণ করা হয়েছিল; কাঠ বাদাম, আপেল, খুবানি, চেরি, আম, তুঁত, পিস, তাল, ঝাউ, নাশপতি, লতাগুল্ম, টকমিষ্টি প্রজাতির কমলা লেবুসহ আরও অনেক ধরনের সুগন্ধি ফল ও ফুলের গাছ। কিছু কিছু গাছে এখনও ফুল ফোটে, ফল হয়।
লাহোরের বাগবানপুরার যে স্থানটিতে শালিমারবাগ গড়ে উঠেছে সে স্থানটি ছিল মিয়া পরিবারের সম্পত্তি। এই পরিবারের লোকেদের পরিসেবায় পরিতুষ্ট হয়ে মুঘলরা তাদের এক সময় ‘মিয়া’ উপাধি প্রধান করেছিল। মাটির গুণগতমান এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে মুঘলদের নিয়োজিত প্রকৌশলীরা এ স্থানটিকে বাগিচার জন্য নির্বাচন করলেও প্রাথমিক অবস্থায় মিয়ারা এ স্থানটি হাতছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু রাজকীয় প্রকৌশলীদের চাপে পড়ে পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে তারা স্থানটি বাগিচা নির্মাণের নিমিত্ত হস্তান্তর করে। তাদের এই সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে মুঘল সম্রাট শাহজাহান মিয়া পরিবারকে এ বাগিচাটি দেখভালের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। সে সুবাদে নির্মাণের পর থেকে প্রায় ৩৫০ বছর (রাজা রণজিৎ এর শাসনকাল ব্যতীত) এ স্থাপনাটি মিয়া পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। মুঘলরা ক্ষমতার চিত্রপট থেকে অপসৃত হবার পরেও এ বাগিচার কর্তৃত্ব মিয়া পরিবারের হাতেই ন্যস্ত ছিল।
মুঘলদের পরে অবশ্য স্বাধীন শিখ রাজ্যের অধিপতি মহারাজা রণজিৎ সিংয়ে গার্ডেন এর সুধা ষোলো আনা পান করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর দীর্ঘ বিরতি শেষে মহারাজার উপস্থিতিতে এ বাগিচা হয়ে উঠেছিল মর্ত্যরে স্বর্গ। শিখ সম্প্রদায়ের কাছে পাঞ্জাবের সিংহ নামে খ্যাত মহারাজা রণজিৎ সিং সারাজীবন যুদ্ধ বিগ্রহে নিয়োজিত থেকে শেষ দিকে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ সময়কালে ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রায়শ শালিমার বাগে অবস্থান করে এখানকার নান্দনিক পরিবেশে বিশ্রাম নিয়ে তিনি তার ‘ ব্রোকেন বডি’ মেরামত করতেন। ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত রাজা রণজিৎ এখানে এসেই যেন খুঁজে পেতেন তার ঠিকানা। এখানে অবস্থানকালে একদিন তিনি তার এক অমাত্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওরা (মুঘলরা) এই মনোরম উদ্যানকে শালামার বলত কেন?’ অমাত্য প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিল যে, ফরাসী ভাষায় শালামার অর্থ ‘হৃদয়ের পরিতৃপ্তি’, যে কারণে এ বাগিচাকে ও নামে অভিহিত করা হয়েছিল। উত্তর শুনে রণজিৎ বেশ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কারণ ফার্সীতে এর অর্থ হৃদয়ের তৃপ্তি হলেও পাঞ্জাবি ভাষায় এর অর্থ ছিল ‘প্রেমের ঘাতক’। যে কারণে রণজিৎ সিংয়ে গার্ডেনের নাম পরিবর্তন করে এর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রেমিকদের উদ্যান বা ‘শালাবাগ’। অসুস্থতার সময় ছাড়াও রণজিতের শাসনামলে প্রায়ই তিনি এখানে এসে বিনোদনে নিমগ্ন হতেন। লাহোরের প্রচ- গরমের কোপানল থেকে পরিত্রাণের প্রত্যাশায় ছুটে আসতেন মুঘলদের এই মনোমুগ্ধকর বাগিচায়। দরবার, পরামর্শ এবং শাসন কার্যের প্রয়োজন ছাড়াও তিনি এখানে তার অতিথিদের নিয়ে আসর জমাতেন। সে আসরে ঘুঙুরের ধ্বনিতে যেমন মুখরিত হতো রাতের পরিবেশ তেমনি ঝরনাধারার সঙ্গে প্রবাহিত হতো শরাবের নহর। বস্তুত মুঘলরা স্বর্গীয় সুখ আস্বাদনের আশায় স্বর্গের আদলে এ স্থাপনা সৃষ্টি করলেও তা খুব একটা ভোগ করতে পারেনি। কারণ শাহজাহানের পর বাদশাহ আওরঙ্গজেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেও তিনি ছিলেন পার্থিব সুখ বিমুখ। ফলে তার শাসনামলে বাগিচাটি এক প্রকার অব্যবহৃতই ছিল। কিন্তু মহারাজা রণজিৎ এ বাগানের সৌকর্যের শতভাগই উসুল করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এ বাগিচাটি পুনরায় মিয়া পরিবারের কর্তৃত্বে চলে আসে। স্বাধীন পাকিস্তানেও মিয়ারা মুঘল আমলের মতো নিজেদের হয়তোবা প্রভাবশালী মনে করতেন, যে কারণে ১৯৬২ সালে মিয়া পরিবারের বংশধরেরা জেনারেল আইযুব খানের সামরিক শাসনের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। এতে করে উর্দিধারী সেনা শাসক অপমানিত বোধ করে মিয়াদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ওদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে এ বাগিচাটির মালিকানা বাজেয়াপ্ত করে এটিকে জাতীয়করণ করে। এরপর থেকে এ শালিমার বাগ সরকারের সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। একই সঙ্গে সাধারণ জনগণের জন্যও এর দরোজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। (চলবে)
No comments