মানবতার জয়গান by দীপিকা ঘোষ
কাজী নজরুলের সর্বাত্মক বিদ্রোহের মূলে তাঁর নির্বাণহীন মানবিকতা। মানবধর্ম রক্ষায় তাঁর সংগ্রামশীল চরিত্রের ভাবরূপই বিদ্রোহের লীলাচাঞ্চল্যে সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর লেখনীতে।
তৎকালীন সমাজজীবন এবং যুগের পরিস্থিতি নিয়ে নজরুলের বিদ্রোহে যে প্রবল ভাববন্যা গভীর আন্তরিকতায় প্রকাশ পেয়েছে, তার জন্ম হয়েছিল কবির বাস্তবঘনিষ্ঠ জীবনবোধ থেকে। কারণ সে সময় রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। শেষ কৈশোরে সৈনিক জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিল তাঁর। কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর জীবনের অবক্ষয় আর ভাঙনের ছবিও খুব কাছের থেকেই দেখেছিলেন নজরুল। ছেলেবেলা থেকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না। আর বিপ্লববাদী আন্দোলনের বিক্ষোভ বন্ধু সংসর্গে তাঁর কবিরসত্তার মর্মমূলে প্রবেশ করেছিল। নজরুলের বিদ্রোহচেতনা তাই তখনকার পরাধীন ভারতের জনসমাজেরই চিন্তাচেতনার নির্ভীক প্রতিনিধিত্ব করেছে। আর এই প্রতিনিধিত্বের গভীরে কাজ করেছিল বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনে পট পরিবর্তনের চেতনা, যা নতুন মন্ত্রে নতুন জীবনে প্রবেশ লাভের দুর্বার আকাক্সক্ষায় উত্তাল হয়ে উঠেছিলÑওরে ভয় নাই আর দুলিয়া উঠেছে হিমালয় চাপা প্রাচী! গৌরীশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী! দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া জাগে মহাযোগী নয়ন মেলিয়া, মহাভারতের মহাবীর জাগে, বলে ‘আমি আসিয়াছি’। নব যৌবন জলতরঙ্গে নাচে রে প্রাচীন প্রাচী! (সব্যসাচী)
এই যৌবন জলতরঙ্গে সর্ববাধামুক্ত বিদ্রোহের জোয়ারে ভারতবাসীর গতানুগতিক জীবনের অচলাতায়ন মনকে ভাসাতে চেয়েছিলেন নজরুল। তাঁর বহ্নিদীপ্ত স্বভাবের উদ্দামতায়, আবেগপ্রবণ সাধারণ বাঙালী জনসমাজ সেদিন সত্যিই যেন ভেসে গিয়েছিল এক অভূতপূর্ব দুরন্ত অনুভূতিতে। কিন্তু সেদিন কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সব রকম অন্যায় অত্যাচার অসাম্য আর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধেই সক্রিয় আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন না তিনি। অসাম্প্রদায়িক ভেদাভেদহীন শোষণমুক্ত মানবসমাজ গড়ে তোলার জন্যও সেদিন উদ্বেলিত হয়েছিলেন নজরুল। তাঁর কর্মধারা আর লেখনীতে তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সাম্যবাদ চেতনার স্বাক্ষর, দ্বন্দ্ব আকাক্সক্ষার সংর্ঘষে তাই মূর্ত হয়ে উঠেছিল বার বার। তাই যে স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে কাজী নজরুল তাঁর জীবনমন্থিত সাম্যবাদের ধারণায় অন্তরঙ্গভাবে বিদ্রোহে সোচ্চার হতে চেয়েছিলেন সেই বিদ্রোহ শুধু দেশের অবহেলিত, দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক, কুলি মজুর, গাড়োয়ান, ধীবর মেথর কিংবা চাঁড়াল জনসমাজের জন্য মুখরিত হয়নি। সব ধর্মের বিভেদ ঘুচিয়ে বিশ্ব মানবসমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও তিনি বলতে চেয়েছিলেন-
গাহি সাম্যের গান - যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান, যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম - ক্রীশ্চান। (সাম্যবাদী)
গাহি সাম্যের গান - মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান, নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। (মানুষ)
নজরুলের এই সাম্যবাদী চেতনা মূলত তাঁর স্বতঃপ্রণোদিত উচ্চতর মানবধর্মের প্রকাশ। এই উচ্চতর মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যই আবেগাসিক্ত হয়ে তিনি বসুধাবক্ষে দুর্বিনীতভাবে নৃশংস হতে চেয়েছেন। বিদ্রোহী ভৃগু হয়ে ভাঙতে চেয়েছেন খেয়ালী বিধাতার পাষাণ হৃদয়কে। পরশুরামের কঠোর কুঠার হয়ে নির্বিচারে নিঃক্ষত্রিয় করতে চেয়েছেন সমস্ত বিশ্বকে। আর এগুলোর সবই তিনি করতে চেয়েছেন সেই নব সৃষ্টির মহানন্দে, যে নতুন সৃষ্ট জগতে-
উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না। (বিদ্রোহী)
নজরুলের বিদ্রোহ মূলত ভালোবাসার প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাস। এক অনন্যসাধারণ জীবনবোধের তাড়ানা। মানবিকতাই তাঁর বিদ্রোহের মর্মকথা তাই। মানবতাবোধের কীর্তন অসাধারণ উত্তেজনায় এবং উদ্দীপনায় রোজকিয়ামতের ঝঞ্ঝার মতো, রুদ্রনাথের মহারোষের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর চেতনার মর্মমূলে। তাই যে অর্থে বিদ্রোহীকে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেই পরিভাষায় নজরুলকে বিদ্রোহী বলা চলে না কখনই। এ কথা ঠিক তিনি অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা উদগীরণ করেছেন, জেলে গিয়েছেন রাজশক্তির বিরুদ্ধে বহ্নিদীপ্ত কবিতা লিখে, তবুও মূলত চেতনায় তিনি রোমান্টিক এবং মানবধর্মের উদার উপাসক। নজরুলের বিদ্রোহের ভাবনা জনমানমানসকে উত্তেজিত করে তুললেও যে সাম্যবাদের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বিদ্রোহের জয়গান গেয়েছেন, জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের সাম্যবাদ সেটা নয়। তাঁর সাম্যবাদ কবির অন্তরস্থিত মানবাত্মার দুর্বার বহির্প্রকাশ। নজরুলের সাম্যবাদে কার্ল মার্ক্সের তাত্ত্বিক প্রজ্ঞার শানানো দীপ্তি নেই। নেই ইউরোপীয় তাত্ত্বিকতার সেই দুর্বার ধার কিংবা প্রচ- গোঁড়ামি। যদিও তিনি সাম্যবাদের চেতনা বয়েই মানবতার জয়গানে মুখর থাকতে চেয়েছেন। যদিও তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব ভূলুণ্ঠিত করতে চেয়ে বলেছেন, তিনিই বিশ্বের চির দুর্জয়রূপে জগদীশ্বর, পুরুষোত্তম সত্য, তবুও এমন কথা বলতেই হয় কার্ল মার্ক্সের তাত্ত্বিক সাম্যবাদ নজরুলের বিদ্রোহের মর্মজ্বালায় তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। যেমন ফেলেছিল তাঁর সমকালীন ইংরেজিশিক্ষিত যুবসমাজের ভাবনায়। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের সংস্পর্শে এসে তিনি হয়ত বা কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, রুশ বিপ্লবের সাফল্যে বোধ করেছিলেন অনুপ্রেরণা, কিন্তু কমিউনিজমের তাত্ত্বিকতা সম্বন্ধে কবির সম্ভবত স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাঁর বিদ্রোহ প্রকাশের ভাবনায় তাই বারবার ভাববাদের সঙ্গে দৃশ্যত বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব প্রায়শই দেখা যায়। আসলে উদারহৃদয় রোমান্টিক নজরুল হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার স্রোতে ভেসেই সোচ্চার হয়েছিলেন মানুষের বেদনায় দুঃখে। অধিকারবঞ্চিত নির্যাতিতের যন্ত্রণায় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবাদের আপোসহীনতায়।
মার্ক্সের সাম্যবাদে অর্থনীতির সমতাই মূল কথা। সেখানে শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যেই এই সাম্যবাদের স্থিতি এবং বিশ্বজগৎজুড়ে তার বাস্তবতা। রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্নতা, সমাজে সমাজসংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা, ধর্মীয়চেতনা কিংবা মানবজীবনে নৈতিকতার প্রতিফলন সেখানে নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রয়োজনটাই সেখানে অস্বীকৃত সম্পূর্ণ। কিন্তু মানবজীবনের কল্যাণার্থে এগুলোর কোনটাকেই প্রয়োজনহীন মনে করেননি কাজী নজরুল। যদিও তিনি উৎপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মুটে, মজুর, কুলির দুঃখে তাত্ত্বিক সাম্যবাদীর মতোই বলেছেনÑ
আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ - হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড় কাটা সে পথের দু পাশে পড়িয়া যাদের হাড়, তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান - (কুলি মজুর)
এবং আরও বলেছেন, এদের অপমান করলে নিখিল জগতে সব মানুষেরই অপমান হয়। এদের রক্তাক্ত শ্রমের বেদনা সমাজের বিত্তশ্রেণীর জানা না থাকলেও সেই শ্রমশক্তির ইতিহাস পথের প্রতিটি ধূলিকণাতেই রেখে যাবে তার সত্যের চিহ্ন। তিনি নাস্তিকের মতোই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, যারা বিশ্বমানবের মহামিলনের পথে অন্তরায় হয়ে আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িকতায় বিভাজন সৃষ্টি করে মানবাত্মার অপমান করে তাদের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, মন্দির মসজিদের সেসব পুরোহিত মোল্লাদের বিরুদ্ধেও যারা নামাজ না পড়ার অপরাধে বুভুক্ষু ভিখিরির খাবার কেড়ে নেয়। মন্দিরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা শীর্ণ দেহ জীর্ণ বস্ত্র পরিহিত সর্বরিক্ত ভুখারির ক্ষিধের আকুল আর্তনাদ স্পর্শ করে না যাদের হৃদয়। এদের শয়তান বলে অভিহিত করে মন্দির মসজিদকে তিনি বলেছেন শয়তানদের মন্ত্রনাগার। নবীন জীবনের নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের ত্রাস সঞ্চারকারী চেঙ্গিস, মাহমুদ এবং কালাপাহাড়কে -
কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার! খোদার ঘওে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা! (মানুষ)
কিন্তু এরপরেই যে কথাগুলো নজরুল বলেছেন সেটা তাত্ত্বিক সাম্যবাদের মতাদর্শ থেকে একেবারেই দলছুট করে দিয়েছে তাঁকেÑ
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ! তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার। (সাম্যবাদী)
এই উদ্বোধন, এই উত্তরণ মানবজীবনের ধর্ম। এই জীবনদর্শন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। কেবল স্বাস্থ্য, অর্থ, শিক্ষা, এবং বিজ্ঞানের শক্তিতে জীবনের সমস্যা কিংবা বিপন্নতা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র বস্তুসর্বস্ব চেতনায় এবং যান্ত্রিকতার বিশ্বায়নে হিংসা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব, সংঘাতের অবসান সম্ভব হয় না কখনোই। বিশ্বজনীন চেতনার দ্বারাই কেবল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। বিশ্বজনীন অনুভবেই অর্জিত হয় মানবমৈত্রী। মানুষের মধ্যেই সেই শাশ্বত প্রেমের প্রকাশ, বেদান্তের প্রজ্ঞাবান ঋষিরা উদাত্ত কণ্ঠে এমন কথাই ঘোষণা করেছিলেন নিরন্তর। এ কথাই বার বার ধ্বনিত হয়েছিল মহাত্মা যিশু, বুদ্ধদেব, মহাবীর এবং কোরানের বাণীতে। নজরুলের সাম্যবাদ এই প্রাচীন সাম্যবাদ ধারার ব্যতিক্রম নয়। যেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে জগতের সবকিছুই পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। কবির সাম্যবাদের অভিব্যক্তিতে অনেক রচনাতেই তাই প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বরের ওপর সুদৃঢ় আস্থা।
তাই সমগ্রভাবে বিচার করলে দেখা যায়, নজরুলের বিদ্রোহ তাঁর জীবনমন্থিত সুগভীর মানবিকতারই উচ্ছল প্রকাশ। যে আধ্যাত্মিক চেতনায় নতুন জীবনের মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হবার কথা বলেছেন, সেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে কবির সকল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে বিরাজিত এক নিরাভরণ ভ্রাতৃত্ববোধের অনুভবের মধ্যে। আর সবার জন্য তাঁর অন্তওে যে সুগভীর ভালবাসা, সেই ভালবাসারই প্রাবল্যে তিনি সহজ সরল স্বাভাবিকতায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন চারপাশের সব অন্যায়, অসত্য এবং অত্যাচারকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য। বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহ তাই মূলত মানবিকতারই জয়গান। অধ্যাত্ম ভাবনা আর রোমান্টিক চেতনা মিলেমিশে সে বিদ্রোহকে মাঝে মাঝেই প্রচলিত বিদ্রোহের ধারণা থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
No comments