অর্থনৈতিক কল্যাণে নারী উদ্যোক্তারা
অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নতির ফলে দেশ এখন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উন্নতির ধারাকে ‘চমকপ্রদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে দেশের কৃষি খাত ও পোশাক শিল্প খাতের অবদান রয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ এতে সন্দেহ নেই। দেশের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অবদান রাখছে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নারীরা নিজেদের সম্পৃক্ত করছে ব্যাপকভাবে। স্বাবলম্বী হওয়ার আত্মপ্রত্যয়ে নারীরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের লিপ্ত করছে। বিবিএস ২০১০ অনুযায়ী গৃহস্থালী কর্মকা- ব্যতীত দেশে মোট এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছে। একজন নারী প্রতিনিধি ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেন। স্বামীর সেবা, সন্তান ধারণ, সন্তানের যতœ, সংসার সামলানো, রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করা, সন্তানের শিক্ষায় শ্রম, বাজারঘাট করা, ধানভাঙ্গা ইত্যাদি মোট ৪৫ ধরনের কাজে একজন নারী নিয়োজিত রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান ২০ শতাংশ দেখানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয় যে, নারীর সামাজিক ও পারিবারিক কল্যাণমূলক কাজের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশে, যা মোট জাতীয় উন্নয়নের প্রায় অর্ধেক বলা যায়। কর্মজীবী নারীরা তাদের চাকরির জন্য সপ্তাহে গড়ে ৪৪ ঘণ্টাও গৃহস্থালি কাজে ৪৯.৮ ঘণ্টা ব্যয় করেন, যা একজন পুরুষের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।রফতানিমুখী শিল্পে নারী শ্রমিকদের চাহিদা ও অংশগ্রহণ বেশি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস যথা তৈরি পোশাক শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাক শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের সাথে নারীরা জড়িত। মোট রফতানি আয়ের ৭৫ ভাগ অর্জনকারী শিল্পের মূল চালিকাশক্তি নারী। কেননা এসব খাতের মোট ৮০ ভাগ শ্রমিকই নারী। নারীরা এখন কেবলমাত্র বিভিন্ন শিল্পে বেতনভোগী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। বলা যায়, এ খাতের বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই নারী। দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান বর্তমানে ১০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১১ সালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য ৫৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এই শিল্পে জড়িত সরাসরি নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭। ২০১০ সালের এক তথ্যমতে, জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের নারী উদ্যোক্তাদের মোট উৎপাদন ও বিক্রির পরিমাণ শতকরা ৪১.৬ শতাংশ, যা মোট রফতানি আয়ের শতকরা ১০.৬ শতাংশ। সরকার এ খাতের উন্নয়নের জন্য আরও ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করছে। সরকারী প্রচেষ্টায় দেশের প্রান্তিক নারীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ দেখা যায়। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ যোগাতে আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে শিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এর ফলে নারী উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের নারী উদ্যোক্তার সাথে পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, ব্যবসা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে সমর্থও হচ্ছে।
প্রতিবন্ধী নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রয় এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য গত ৩০ ডিসেম্বর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় ও অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ বৈঠকে প্রতিবন্ধী নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। দেশে বর্তমানে অনেক প্রতিবন্ধী নারী আর্থিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকার মধ্যে এসব প্রতিবন্ধী নারী উদ্যাক্তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ একান্ত জরুরী বলে বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা উল্লেখ করেন। এছাড়া প্রতিবন্ধী নারী উদ্যোক্তাদের নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রদানের অন্তর্ভুক্তকরণ, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সুবিধা প্রদান, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে তাদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা, সরকারী বেসরকারী ঋণ গ্রহণসহ প্রশিক্ষণ, বিপণনে অবাধ অংশগ্রহণসহ আরও বেশকিছু দাবি করা হয় ওই বৈঠকে। এ সকল সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে প্রতিবন্ধী নারীরা নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে সচেষ্টা হবে বলে আশা করা যায়। সরকার দরিদ্র ও বেকার নারীদের কর্মমুখী করার লক্ষ্যে বিউটিফকেশন ট্রেনি, কম্পিউটার ট্রেনিং, মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিংসহ বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দিচ্ছে। এরপর তাদের সহজশর্তে ঋণ প্রদান করছে। অনেক নারী আজ এর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছে। এ সকল সুবিধার আওতায় প্রতিবন্ধী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব বলে তাদের অবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আরও বাড়বে বলা যায়। নারী উন্নয়ন ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব, তাই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রবাহমান রাখতে নারী উদ্যোক্তাদের কর্মপরিবেশে নিরাপত্তাসহ তাদের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ে সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। নারী উদ্যোক্তাদের চলার পথ সুগম করতে সরকারকে আরও ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। শুধু তাই নয় বেসরকারী প্রচেষ্টায়ও প্রয়োজন। এর ফলে নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে পরিবার ও নিজেকে দারিদ্র্য দশা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। দেশ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে।
ইয়াসমিন হোসেন
No comments