ছিনতাই প্রতিরোধে র্যাব, পুলিশ ও আমরা by ড. মিল্টন বিশ্বাস
সম্প্রতি রাত সোয়া ১১টায় আসাদগেট থেকে মিরপুর রোড ধরে শ্যামলী আসার সময় আমার ল্যাপটপের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেল মোটরসাইকেল আরোহী দুই দুর্বৃত্ত। ওই দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য আমি 'ধর' 'ধর' বলে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।
তারা আওরঙ্গজেব রোড ধরে পালিয়ে যায় মোহাম্মদপুরের দিকে। ঘটনার পর পরই আমি র্যাবের মিডিয়া অ্যান্ড লিগ্যাল উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিব সাহেবকে বিষয়টি জানালে তিনি শিয়া মসজিদ র্যাব ক্যাম্পের অধিনায়ক ফয়সাল সাহেবকে ঘটনাটি জানান। কিন্তু র্যাবের টহলদল আসাদগেট থেকে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান করে কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। পরদিন মোহাম্মদপুর থানায় জিডি ও পরে মামলা করি (মামলা নম্বর ৩৫) এবং ওই র্যাব ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগ করেছি। ল্যাপটপের সঙ্গে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ তিনটি পেনড্রাইভ এবং দুটি ইন্টারনেট মডেম ও আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে গত দুই বছরে আমার ল্যাপটপ ও পেনড্রাইভে বিস্তর তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। সেসব তথ্য আর লেখার উপকরণ আমার কাছে আর্থিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য আমার কাতরতাও প্রকাশ করেছি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। এ ঘটনার পরে ছিনতাই ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে র্যাব, পুলিশ সদস্য ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে কিছু মতামত অর্জনে সক্ষম হয়েছি।
ছিনতাই উন্নত বিশ্ব ইউরোপ-আমেরিকাতেও আছে। কিন্তু পুলিশি তৎপরতা সেখানে বেশি বলেই অপরাধীরা সহজেই ধরা পড়ে। বরং জাপান-সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নেই। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এর প্রকোপ কমানো যায়নি। তবে ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে র্যাব ও পুলিশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি থানার নির্দিষ্ট এলাকা যেমন ওই থানার পুলিশ সদস্যদের নখদর্পণে, তেমনি র্যাবের ক্যাম্পগুলোরও নির্দিষ্ট এলাকা নির্দেশ করা আছে। অবশ্য র্যাব ও পুলিশ সদস্য সম্পর্কে জনগণের দুই ধরনের ধারণা। র্যাব সদস্যরা অপরাধী শনাক্ত করা ও ধরার বিষয়ে যতটা চৌকস, পুলিশরা ততটা নন। পুলিশ সদস্যরা স্থানীয় এলাকার জনগণের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারেন। অপরাধী ধরার জন্য তাদের সোর্সের পরিমাণও বেশি। কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে পুলিশের থানা পর্যায়ে, যা আবার র্যাবের ক্ষেত্রে উল্টো। র্যাবের তৎপরতা, দক্ষতা এবং অপরাধ বিষয়ে গবেষণা বেশি অগ্রগামী। অপরাধী, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারে তাদের পরিসংখ্যানও বেশি। উল্লেখ্য, র্যাব পুলিশেরই এলিট ফোর্স। এতদসত্ত্বেও র্যাবের মাইন্ডসেট আলাদা। (এ বিষয়ে আরো ব্যাখ্যার দাবি রাখে, স্বল্প পরিসরে বিষয়টি এড়িয়ে গেলাম) এই উভয় সংস্থা জনগণের জানমাল রক্ষায় কেবল নয়, দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক অবদান রেখেছে। এ জন্য ছিনতাই প্রতিরোধে তাদের একক ভূমিকা নয়; তাদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একত্রিত হওয়া দরকার।
ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে প্রথমে প্রয়োজন আমাদের নিজস্ব সচেতনতা। নিজে যদি আগে থেকে সতর্ক থাকতে পারি, তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিহার সম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সব সময় মানুষ একই ধরনের মানসিক অবস্থায় থাকবে, এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া রয়েছে রাস্তা-ঘাট, পাড়া-মহল্লার বিচিত্র কোলাহল আর নানা কেরিকেচারের মানুষের রং-ঢং। এ জন্য আমরা সর্বদা নিজের বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে এগিয়ে যাব- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একজন বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থার ব্যক্তির জন্য দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিতি সামলানো দুরূহ। কিন্তু মানুষের সচেতনতা কেবল আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার জন্যও তা দরকার। টহলে কিংবা তদন্তে বের হয়ে এসব সংস্থার সদস্যরা প্রত্যাশিত সহযোগিতা পান না। রাস্তার লোকরা দেখলেও ছিনতাই ঘটনার পরে সেই তথ্য পুলিশকে জানানো থেকে বিরত থাকে। কোনো কিছু দেখল কি না তা-ও বলার প্রয়োজন মনে করে না। অন্যের দায়-দায়িত্ব নেওয়ার তার দরকার নেই- এ রকম মানসিকতা বেশির ভাগের। অথচ এ ধরনের ঘটনার শিকার সেই ব্যক্তিরাও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সামাজিক সচেতনার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল সড়কগুলোতে 'সিসিটিভি' কভারেজ অত্যন্ত জরুরি। তাহলে অলিগলিতে পুলিশ-র্যাবের টহল বাড়ানো সম্ভব। এতে ছিনতাইকারীরা অপরাধ করে পালাতে পারবে না।
টানা পার্টি কিংবা অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইকারী অপহৃত মালামাল বিক্রি করে ঢাকাসহ দেশের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। চোরাই মাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া চোরাই পণ্য কেউ ক্রয় করলে তাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর এ ধরনের মার্কেট বন্ধ হলে ছিনতাইকারীরা নিরুৎসাহী হবে দুর্বৃত্তপনায়। বেশির ভাগ ছিনতাইকারী মাদকসেবী। মাদকের জন্য ছিনতাই আর হত্যা তাদের রোগের অপর নাম। মাদককে না বলার অভ্যাসটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃঢ়ভাবে প্রচলন করা দরকার। ইদানীং রাস্তাঘাট, পার্ক ও পরিবহনে যেভাবে ধূমপায়ীদের অত্যাচার বেড়েছে, তাতে আইনের সহায়তা চেয়েও এই ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর উপদ্রব থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। ধূমপানের শাস্তি ১০০ টাকা করা হলেও অতীতের মতো বর্তমান সরকারের কঠোর তদারকির অভাব রয়েছে। তবে মহাজোট সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যদিও ছিনতাই বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ আইন থাকলেও এর প্রয়োগের অভাবে জনজীবনে বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই। এ জন্য ছিনতাই প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও সেই আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে এলাকা চিহ্নিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরাধ বিষয়ে প্রতিটি থানা এবং র্যাব ক্যাম্পগুলোতে এলাকাভিত্তিক অপরাধ ও অপরাধীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকে। সে ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের মতো একটি অপরাধ সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণে সামর্থ্য রাখেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অন্যদিকে ছিনতাইয়ের পয়েন্টগুলোতে টহল বাড়ানো হলে অপরাধীদের দমন করা সম্ভব। কিন্তু ছিনতাইকারীরা আরো বেশি তৎপর। তারা এক এলাকার বাসিন্দা হয়ে অন্য এলাকায় ছিনতাই করে; সেই এলাকার অপরাধীরা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে থাকে। এমনকি স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা আইনি বিপত্তি থেকে রক্ষা পায়।
ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারী। তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর দায়িত্ব পুলিশ-র্যাবের। অনেক মোড়ে আলো-অন্ধকারে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করে অপরাধীরা, যাদের বাহনটি আবার চোরাই। অর্থাৎ চোরাই গাড়ি ব্যবহার করেই অপরাধীরা মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাদের প্রতিরোধের একমাত্র উপায়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক অভিযান। ঢাকা শহরে সিএনজি অটোরিকশা যোগে ছিনতাই একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিংবা বিআরটিএ কি লক্ষ করেছে বেশির ভাগ সিএনজি অটোরিকশার খাঁচার দরজার ছিটকিনি ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণে থাকে; তারা মিটারে যাতায়াত করে না। এসব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে বলেই ঢাকার পরিবহন এখন অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দমনে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ঠিকমতো অপরাধ সংঘটনের তথ্য পেলে যেমন পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হবেন তেমনি তাঁদের সফলতাগুলো দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরাও মিডিয়ার দায়িত্ব। অনেক সময় অপরাধীর তথ্যগুলো ঠিকমতো ঠিক জায়গায় পৌঁছায় না, ফলে কার্যকর ফল পাওয়া যায় না। কিংবা একজন র্যাব অথবা পুলিশ সদস্য জনগণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেও মন্দ কথা শুনতে পান। এসব ক্ষেত্রে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পরে গত বছর পর্যন্ত (২০১২) র্যাব সদস্যরা প্রায় দুই হাজার ছিনতাইকারী, মলম ও অজ্ঞান পার্টির অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছেন। অন্যদিকে পুলিশ সদস্যরা কেবল গেল বছর প্রতিটি থানায় বিপুলসংখ্যক অপরাধীদের চিহ্নিত করে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে তাঁদের ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের সাফল্যের প্রচার যেমন মিডিয়ায় হয়নি, তেমনি আমার ল্যাপটপ ছিনতাই হওয়ার ঘটনাও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসেনি। আমাদের মনে হয়, প্রতিটি থানা কিংবা র্যাব ক্যাম্পে কী কী অভিযোগ জমা পড়ছে অথবা কারা কারা কী অপরাধের মামলা করছে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা এবং প্রচার করা দরকার। একই সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অবদান প্রচার করা হলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে; সাধারণ মানুষ আর হয়রানির শিকার হবে না। তবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অসাধু কিছু সদস্যের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের সম্পর্ক আছে কি না তা-ও যাচাই করে দেখা দরকার। কারণ আমরা সব সময়ের জন্য অপরাধীমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ প্রত্যাশা করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
ছিনতাই উন্নত বিশ্ব ইউরোপ-আমেরিকাতেও আছে। কিন্তু পুলিশি তৎপরতা সেখানে বেশি বলেই অপরাধীরা সহজেই ধরা পড়ে। বরং জাপান-সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নেই। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এর প্রকোপ কমানো যায়নি। তবে ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে র্যাব ও পুলিশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি থানার নির্দিষ্ট এলাকা যেমন ওই থানার পুলিশ সদস্যদের নখদর্পণে, তেমনি র্যাবের ক্যাম্পগুলোরও নির্দিষ্ট এলাকা নির্দেশ করা আছে। অবশ্য র্যাব ও পুলিশ সদস্য সম্পর্কে জনগণের দুই ধরনের ধারণা। র্যাব সদস্যরা অপরাধী শনাক্ত করা ও ধরার বিষয়ে যতটা চৌকস, পুলিশরা ততটা নন। পুলিশ সদস্যরা স্থানীয় এলাকার জনগণের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারেন। অপরাধী ধরার জন্য তাদের সোর্সের পরিমাণও বেশি। কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে পুলিশের থানা পর্যায়ে, যা আবার র্যাবের ক্ষেত্রে উল্টো। র্যাবের তৎপরতা, দক্ষতা এবং অপরাধ বিষয়ে গবেষণা বেশি অগ্রগামী। অপরাধী, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারে তাদের পরিসংখ্যানও বেশি। উল্লেখ্য, র্যাব পুলিশেরই এলিট ফোর্স। এতদসত্ত্বেও র্যাবের মাইন্ডসেট আলাদা। (এ বিষয়ে আরো ব্যাখ্যার দাবি রাখে, স্বল্প পরিসরে বিষয়টি এড়িয়ে গেলাম) এই উভয় সংস্থা জনগণের জানমাল রক্ষায় কেবল নয়, দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক অবদান রেখেছে। এ জন্য ছিনতাই প্রতিরোধে তাদের একক ভূমিকা নয়; তাদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একত্রিত হওয়া দরকার।
ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে প্রথমে প্রয়োজন আমাদের নিজস্ব সচেতনতা। নিজে যদি আগে থেকে সতর্ক থাকতে পারি, তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিহার সম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সব সময় মানুষ একই ধরনের মানসিক অবস্থায় থাকবে, এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া রয়েছে রাস্তা-ঘাট, পাড়া-মহল্লার বিচিত্র কোলাহল আর নানা কেরিকেচারের মানুষের রং-ঢং। এ জন্য আমরা সর্বদা নিজের বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে এগিয়ে যাব- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একজন বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থার ব্যক্তির জন্য দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিতি সামলানো দুরূহ। কিন্তু মানুষের সচেতনতা কেবল আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার জন্যও তা দরকার। টহলে কিংবা তদন্তে বের হয়ে এসব সংস্থার সদস্যরা প্রত্যাশিত সহযোগিতা পান না। রাস্তার লোকরা দেখলেও ছিনতাই ঘটনার পরে সেই তথ্য পুলিশকে জানানো থেকে বিরত থাকে। কোনো কিছু দেখল কি না তা-ও বলার প্রয়োজন মনে করে না। অন্যের দায়-দায়িত্ব নেওয়ার তার দরকার নেই- এ রকম মানসিকতা বেশির ভাগের। অথচ এ ধরনের ঘটনার শিকার সেই ব্যক্তিরাও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সামাজিক সচেতনার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল সড়কগুলোতে 'সিসিটিভি' কভারেজ অত্যন্ত জরুরি। তাহলে অলিগলিতে পুলিশ-র্যাবের টহল বাড়ানো সম্ভব। এতে ছিনতাইকারীরা অপরাধ করে পালাতে পারবে না।
টানা পার্টি কিংবা অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইকারী অপহৃত মালামাল বিক্রি করে ঢাকাসহ দেশের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। চোরাই মাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া চোরাই পণ্য কেউ ক্রয় করলে তাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর এ ধরনের মার্কেট বন্ধ হলে ছিনতাইকারীরা নিরুৎসাহী হবে দুর্বৃত্তপনায়। বেশির ভাগ ছিনতাইকারী মাদকসেবী। মাদকের জন্য ছিনতাই আর হত্যা তাদের রোগের অপর নাম। মাদককে না বলার অভ্যাসটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃঢ়ভাবে প্রচলন করা দরকার। ইদানীং রাস্তাঘাট, পার্ক ও পরিবহনে যেভাবে ধূমপায়ীদের অত্যাচার বেড়েছে, তাতে আইনের সহায়তা চেয়েও এই ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর উপদ্রব থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। ধূমপানের শাস্তি ১০০ টাকা করা হলেও অতীতের মতো বর্তমান সরকারের কঠোর তদারকির অভাব রয়েছে। তবে মহাজোট সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যদিও ছিনতাই বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ আইন থাকলেও এর প্রয়োগের অভাবে জনজীবনে বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই। এ জন্য ছিনতাই প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও সেই আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। ছিনতাই প্রতিরোধ ও নির্মূলে এলাকা চিহ্নিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরাধ বিষয়ে প্রতিটি থানা এবং র্যাব ক্যাম্পগুলোতে এলাকাভিত্তিক অপরাধ ও অপরাধীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকে। সে ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের মতো একটি অপরাধ সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণে সামর্থ্য রাখেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অন্যদিকে ছিনতাইয়ের পয়েন্টগুলোতে টহল বাড়ানো হলে অপরাধীদের দমন করা সম্ভব। কিন্তু ছিনতাইকারীরা আরো বেশি তৎপর। তারা এক এলাকার বাসিন্দা হয়ে অন্য এলাকায় ছিনতাই করে; সেই এলাকার অপরাধীরা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে থাকে। এমনকি স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা আইনি বিপত্তি থেকে রক্ষা পায়।
ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারী। তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর দায়িত্ব পুলিশ-র্যাবের। অনেক মোড়ে আলো-অন্ধকারে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করে অপরাধীরা, যাদের বাহনটি আবার চোরাই। অর্থাৎ চোরাই গাড়ি ব্যবহার করেই অপরাধীরা মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাদের প্রতিরোধের একমাত্র উপায়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক অভিযান। ঢাকা শহরে সিএনজি অটোরিকশা যোগে ছিনতাই একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিংবা বিআরটিএ কি লক্ষ করেছে বেশির ভাগ সিএনজি অটোরিকশার খাঁচার দরজার ছিটকিনি ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণে থাকে; তারা মিটারে যাতায়াত করে না। এসব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে বলেই ঢাকার পরিবহন এখন অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দমনে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ঠিকমতো অপরাধ সংঘটনের তথ্য পেলে যেমন পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হবেন তেমনি তাঁদের সফলতাগুলো দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরাও মিডিয়ার দায়িত্ব। অনেক সময় অপরাধীর তথ্যগুলো ঠিকমতো ঠিক জায়গায় পৌঁছায় না, ফলে কার্যকর ফল পাওয়া যায় না। কিংবা একজন র্যাব অথবা পুলিশ সদস্য জনগণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেও মন্দ কথা শুনতে পান। এসব ক্ষেত্রে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পরে গত বছর পর্যন্ত (২০১২) র্যাব সদস্যরা প্রায় দুই হাজার ছিনতাইকারী, মলম ও অজ্ঞান পার্টির অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছেন। অন্যদিকে পুলিশ সদস্যরা কেবল গেল বছর প্রতিটি থানায় বিপুলসংখ্যক অপরাধীদের চিহ্নিত করে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে তাঁদের ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের সাফল্যের প্রচার যেমন মিডিয়ায় হয়নি, তেমনি আমার ল্যাপটপ ছিনতাই হওয়ার ঘটনাও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসেনি। আমাদের মনে হয়, প্রতিটি থানা কিংবা র্যাব ক্যাম্পে কী কী অভিযোগ জমা পড়ছে অথবা কারা কারা কী অপরাধের মামলা করছে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা এবং প্রচার করা দরকার। একই সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অবদান প্রচার করা হলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে; সাধারণ মানুষ আর হয়রানির শিকার হবে না। তবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অসাধু কিছু সদস্যের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের সম্পর্ক আছে কি না তা-ও যাচাই করে দেখা দরকার। কারণ আমরা সব সময়ের জন্য অপরাধীমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ প্রত্যাশা করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments