অস্ত্র ক্রয়ের বিলাসিতা বন্ধ করতে হবে by হায়দার আকবর খান রনো
হঠাৎ করে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার ধুম পড়ে গেল কেন? সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর এবং আট হাজার কোটি টাকার অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের মতো বিপুল অঙ্কের সামরিক অস্ত্র ক্রয়ের মতো বিলাসিতা আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য কি খুব মানানসই?
যেখানে আমাদের প্রয়োজন অস্ত্র নয় বরং অন্ন- সেখানে জনগণকে, পার্লামেন্টকে, এমনকি মন্ত্রিসভাকে অন্ধকারে রেখে হঠাৎ করে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য মেতে উঠলেন কেন প্রধানমন্ত্রী? এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খুব সামান্য ব্যাপার নয়। আমরা এটা পাচ্ছি ঋণ হিসেবে, যা সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের শর্তও খুব সহজ নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই যে এসব বাণিজ্যচুক্তির ব্যাপারে কখনোই জনগণকে জানানো হয় না। এর মধ্যে কি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কোনো ব্যাপার আছে? কী কী অস্ত্র কেনা হবে তা তো জানা হয়েছেই। তবু কেন অহেতুক গোপনীয়তা?
দুষ্ট লোক বলে, সরকারের মেয়াদকালের শেষ সময়ে নাকি বড় অঙ্কের কেনাকাটার হিড়িক পড়ে। কারণ তাতে বড় অঙ্কের কমিশন খাওয়া যায়, যেটা পরবর্তী নির্বাচনের জন্য কাজে লাগবে। আমাদের হাতে অবশ্য এমন কোনো তথ্য নেই। কারণ সব বিষয়ই গোপনে সারা হয়। তাই সন্দেহের দিকটি আরো বেশি গভীর হয়ে ওঠে। জনমনে সন্দেহ তৈরি হয় পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে। কিছুটা সাবজেকটিভ হলেও তার কিছুটা ভিত্তি থাকে। সবচেয়ে বড় কথা- সন্দেহ, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, আস্থা বা অনাস্থা- সবটিই হচ্ছে পাবলিক পারসেপশন। এটা তৈরি হয় দীর্ঘ সময় ধরে, অ্যাকটিভ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
ইতিপূর্বে শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এবং খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অস্ত্র ক্রয়ের বিষয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মিগ ও ফ্রিগেট মামলা উঠেছিল ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের জরুরি আমলে। রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেসব মামলা প্রত্যাহার করা হলেও জনগণের মনে সন্দেহ এখনো খচ খচ করছে।
সেবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়া থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে মিগ-২৯ ক্রয় করেছিল- যা কোনো কাজে আসেনি। কারণ প্রথমত, এত দ্রুতগামী মিগ বিমান আসলেই আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এই মিগ আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত বা মিয়ানমারের আকাশসীমায় পৌঁছে যাবে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা গুলি করে ভূপাতিত করবে। তবে আসল ঘটনা হলো এই যে সেই মিগ বিমানকে কখনো উড়তেই হয়নি। কারণ তা ছিল অচল বিমান। এত বড় অপচয় কী অপরাধযোগ্য নয়? দুর্নীতির কথা তো আছেই।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বড় ধরনের দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিও দুর্নীতি অথবা হলমার্কসহ ব্যাংক কেলেঙ্কারিও দুর্নীতি! এর সঙ্গে সরকারবান্ধব ব্যবসায়ী, সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত আমলা বা এমনকি সরকারি দলের রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছেন বলে মনে করার ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। এসব দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি। আর সবচেয়ে বড় করে এসেছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি। প্রথমদিকে সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এবং দুর্নীতির কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেও পরে তারা স্বীকার করে এবং দুদক তদন্ত ও মামলা শুরু করে। অবশ্য আমরা সবাই জানি যে দুদক একটি মেরুদণ্ডহীন সংস্থা, যা কেবল সর্বোচ্চ সরকারি নির্দেশেই নড়াচড়া করে। কিন্তু প্রশাসনের স্বচ্ছতার ও গণতন্ত্রের চর্চার এমনই হাল-অবস্থা যে আমরা জনগণ এখন পর্যন্ত জানি না, বিশ্বব্যাংকের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী এবং কার কার বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের চিঠিপত্রের লেনদেন কী হয়েছে তা জানার অধিকার থাকা সত্ত্বেও আমাদের, এমনকি সংসদকেও অন্ধকারে রাখা হয়েছে। তা কি কোনো বিশেষ তথ্য গোপন রাখার জন্য? এসব কারণেই সন্দেহ জাগে, রাশিয়ার সঙ্গে এত বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ ও সমরাস্ত্র ক্রয়ের সঙ্গে সরকারবান্ধব কোনো ব্যবসায়ীর মোটা অঙ্কের কমিশনের ঘটনা জড়িত আছে কি না। ধরে নিলাম যে সন্দেহপ্রবণ মন, সন্দেহবাতিক মানুষ অযথা মিথ্যা ধারণার পেছনে ঘুরছে। ধরে নিলাম, সরকার ও সরকারি লোকজনের মন পরিষ্কার, শতভাগ নির্মল, সততার চরম দৃষ্টান্ত। তাহলেও এত টাকা দিয়ে অস্ত্র ক্রয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না। মাত্র মাসখানেক আগে সরকার ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৪৪টি চীনা এমবিটি-২০০০ ট্যাংক কিনেছে। তার পরই এখন ১০০ কোটি ডলারের নতুন করে অস্ত্র কেনার ধুম পড়ে গেল কেন? জনগণের টাকায় কাউকে বড় অঙ্কের কমিশন খাইয়ে দেওয়ার স্বার্থ ছাড়া আর কী স্বার্থ থাকতে পারে এই চরম অপব্যয়ের, যেখানে সব জনগণের জন্য স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি না? এখন বেশির ভাগ মানুষ নিরাময়যোগ্য রোগে চিকিৎসার অভাবে মরে, যদিও ধনীদের জন্য গজিয়ে উঠছে পাঁচতারা হোটেলের মতো হাসপাতাল। অগ্রাধিকার কোথায় দেব? তামাশা করার জন্য সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা লেখা থাকলেও হাসিনা-খালেদার মতো নেতা-নেত্রীদের অথবা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলের ধনীর তোষণ ও গরিবকে শোষণ করার নীতিই অব্যাহত রয়েছে। তাই শিক্ষা জাতীয়করণের কথা উঠলে বলা হয় টাকা নেই। সব মানুষের জন্য বিনা পয়সায় চিকিৎসার (ওষুধ ও অপারেশনসহ) ব্যবস্থা নেই, কারণ অত টাকা নেই। কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস করা হচ্ছে, কারণ টাকা নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে, কারণ আইএমএফ বলেছে, টাকা দেওয়া যাবে না। কিন্তু অস্ত্র কেনার জন্য টাকার অভাব হবে না। যদিও ঋণের টাকা, তবু তো জনগণকে শোধ করতে হবে চড়া হারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, 'পুরনো বন্ধু'। কথাটা পুরো সত্য নয়। কারণ ১৯৭১ সালে যে সমাজতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন- আজকের পুঁজিবাদী রাশিয়া নয়। সমাজতান্ত্রিক দেশের বিদেশনীতির মধ্যে থাকে মতাদর্শিক লক্ষ্য, বিশ্বকে সাম্রাজ্যবাদমুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা। সোভিয়েত-চীনের পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকার মধ্যে শেষের দিকে অনেক বিভ্রান্তি দেখা গেলেও (যেমন- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনের ভূমিকা) সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবির দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল পরাধীন ও অনুন্নত দেশগুলোর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের পক্ষে। আর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদের নীতিই হলো দুনিয়ার মানুষকে শোষণ ও দুনিয়ার সম্পদ লুণ্ঠন করা। সেদিনের রাশিয়া ছিল দুনিয়ার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষের দুর্গ। আর আজকের রাশিয়ার নীতি পরিচালিত হয় নতুন করে তৈরি হওয়া পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে। আজকের রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রয় ও বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রয়ের মধ্যে দুই দেশের লুটেরা ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নেই।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া অবশ্য পুঁজিবাদী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে। যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, কোরিয়া, কিউবা প্রশ্নে আমরা এই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখতে পাই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও জাপ সাম্রাজ্যবাদকে একযোগে অধিকতর দুশমন বিবেচনা করা সংগত। এই আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের সুযোগও নেওয়া উচিত এবং যতটা পারা যায় মানবজাতির এক নম্বর দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশলকে সমর্থন করা উচিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা অথবা ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা) নামে যে নতুন উদীয়মান শক্তির জোটের কথা শোনা যাচ্ছে, তাকে তুলনামূলক বিচারে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সে রকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান থেকে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী?
মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন উপস্থিতি। এমনকি সামরিক উপস্থিতিও ভালোভাবেই আছে। যৌথ সামরিক মহড়া ছাড়াও আমাদের দেশে মার্কিন সৈন্যের যে উপস্থিতি আছে, তা গত বছর জুন মাসে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে ইউএস মেরিনের এশিয়া প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধানের বক্তব্য থেকেই জানা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে বসেই সিআইএ রাখঢাক না করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের জ্ঞাতসারেই। ১৯৯৮ সালের (তখনো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী) জুন মাসে বাংলাদেশ সোফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। মার্কিন সৈন্যরা যেকোনো সময় বিনা ভিসায় সশস্ত্রভাবে (কাস্টম হবে না) প্রবেশ করতে পারবে এবং তারা খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ করলেও বাংলাদেশের আদালতে বিচার করা চলবে না। শেখ হাসিনা (খালেদা জিয়াও) তো ইতিপূর্বেই জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন। মার্কিন দস্যুরা যেদিন আফগানিস্তান দখল করল, তখন লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে মার্কিন হানাদারদের জন্য বাংলাদেশের আকাশ, সমুদ্র ও জমি ব্যবহারের অধিকার প্রদান করেছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এই সরকার যেভাবে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি কনোকো-ফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র তুলে দিয়েছে, তাতে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এতটা নতজানু হওয়া সত্ত্বেও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশ্নে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যায়। তাই কি আরেকটা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশ রাশিয়ার সঙ্গে মাখামাখির পর্ব শুরু হয়েছে? অবশ্য দুই নৌকায় পা রাখলে সর্বনাশ!
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ, অন্যদিকে রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অস্ত্র ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ অপচয় করার পরিণতিতে সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েছে, তবে আর নয়। জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের অর্থ ও সম্পদের অপচয় আর দেখতে চাই না। অস্ত্র নয়, অন্ন চাই। চাই সবার জন্য সমান শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ। আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া- সব সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করেই মুক্তিযুদ্ধের দেশ বাংলাদেশ হিম্মত নিয়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবে সংবিধান বর্ণিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এটাই হোক আমাদের কামনা।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
দুষ্ট লোক বলে, সরকারের মেয়াদকালের শেষ সময়ে নাকি বড় অঙ্কের কেনাকাটার হিড়িক পড়ে। কারণ তাতে বড় অঙ্কের কমিশন খাওয়া যায়, যেটা পরবর্তী নির্বাচনের জন্য কাজে লাগবে। আমাদের হাতে অবশ্য এমন কোনো তথ্য নেই। কারণ সব বিষয়ই গোপনে সারা হয়। তাই সন্দেহের দিকটি আরো বেশি গভীর হয়ে ওঠে। জনমনে সন্দেহ তৈরি হয় পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে। কিছুটা সাবজেকটিভ হলেও তার কিছুটা ভিত্তি থাকে। সবচেয়ে বড় কথা- সন্দেহ, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, আস্থা বা অনাস্থা- সবটিই হচ্ছে পাবলিক পারসেপশন। এটা তৈরি হয় দীর্ঘ সময় ধরে, অ্যাকটিভ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
ইতিপূর্বে শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এবং খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অস্ত্র ক্রয়ের বিষয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মিগ ও ফ্রিগেট মামলা উঠেছিল ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের জরুরি আমলে। রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেসব মামলা প্রত্যাহার করা হলেও জনগণের মনে সন্দেহ এখনো খচ খচ করছে।
সেবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়া থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে মিগ-২৯ ক্রয় করেছিল- যা কোনো কাজে আসেনি। কারণ প্রথমত, এত দ্রুতগামী মিগ বিমান আসলেই আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এই মিগ আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত বা মিয়ানমারের আকাশসীমায় পৌঁছে যাবে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা গুলি করে ভূপাতিত করবে। তবে আসল ঘটনা হলো এই যে সেই মিগ বিমানকে কখনো উড়তেই হয়নি। কারণ তা ছিল অচল বিমান। এত বড় অপচয় কী অপরাধযোগ্য নয়? দুর্নীতির কথা তো আছেই।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বড় ধরনের দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিও দুর্নীতি অথবা হলমার্কসহ ব্যাংক কেলেঙ্কারিও দুর্নীতি! এর সঙ্গে সরকারবান্ধব ব্যবসায়ী, সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত আমলা বা এমনকি সরকারি দলের রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছেন বলে মনে করার ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। এসব দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি। আর সবচেয়ে বড় করে এসেছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি। প্রথমদিকে সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এবং দুর্নীতির কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেও পরে তারা স্বীকার করে এবং দুদক তদন্ত ও মামলা শুরু করে। অবশ্য আমরা সবাই জানি যে দুদক একটি মেরুদণ্ডহীন সংস্থা, যা কেবল সর্বোচ্চ সরকারি নির্দেশেই নড়াচড়া করে। কিন্তু প্রশাসনের স্বচ্ছতার ও গণতন্ত্রের চর্চার এমনই হাল-অবস্থা যে আমরা জনগণ এখন পর্যন্ত জানি না, বিশ্বব্যাংকের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী এবং কার কার বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের চিঠিপত্রের লেনদেন কী হয়েছে তা জানার অধিকার থাকা সত্ত্বেও আমাদের, এমনকি সংসদকেও অন্ধকারে রাখা হয়েছে। তা কি কোনো বিশেষ তথ্য গোপন রাখার জন্য? এসব কারণেই সন্দেহ জাগে, রাশিয়ার সঙ্গে এত বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ ও সমরাস্ত্র ক্রয়ের সঙ্গে সরকারবান্ধব কোনো ব্যবসায়ীর মোটা অঙ্কের কমিশনের ঘটনা জড়িত আছে কি না। ধরে নিলাম যে সন্দেহপ্রবণ মন, সন্দেহবাতিক মানুষ অযথা মিথ্যা ধারণার পেছনে ঘুরছে। ধরে নিলাম, সরকার ও সরকারি লোকজনের মন পরিষ্কার, শতভাগ নির্মল, সততার চরম দৃষ্টান্ত। তাহলেও এত টাকা দিয়ে অস্ত্র ক্রয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না। মাত্র মাসখানেক আগে সরকার ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৪৪টি চীনা এমবিটি-২০০০ ট্যাংক কিনেছে। তার পরই এখন ১০০ কোটি ডলারের নতুন করে অস্ত্র কেনার ধুম পড়ে গেল কেন? জনগণের টাকায় কাউকে বড় অঙ্কের কমিশন খাইয়ে দেওয়ার স্বার্থ ছাড়া আর কী স্বার্থ থাকতে পারে এই চরম অপব্যয়ের, যেখানে সব জনগণের জন্য স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি না? এখন বেশির ভাগ মানুষ নিরাময়যোগ্য রোগে চিকিৎসার অভাবে মরে, যদিও ধনীদের জন্য গজিয়ে উঠছে পাঁচতারা হোটেলের মতো হাসপাতাল। অগ্রাধিকার কোথায় দেব? তামাশা করার জন্য সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা লেখা থাকলেও হাসিনা-খালেদার মতো নেতা-নেত্রীদের অথবা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলের ধনীর তোষণ ও গরিবকে শোষণ করার নীতিই অব্যাহত রয়েছে। তাই শিক্ষা জাতীয়করণের কথা উঠলে বলা হয় টাকা নেই। সব মানুষের জন্য বিনা পয়সায় চিকিৎসার (ওষুধ ও অপারেশনসহ) ব্যবস্থা নেই, কারণ অত টাকা নেই। কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস করা হচ্ছে, কারণ টাকা নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে, কারণ আইএমএফ বলেছে, টাকা দেওয়া যাবে না। কিন্তু অস্ত্র কেনার জন্য টাকার অভাব হবে না। যদিও ঋণের টাকা, তবু তো জনগণকে শোধ করতে হবে চড়া হারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, 'পুরনো বন্ধু'। কথাটা পুরো সত্য নয়। কারণ ১৯৭১ সালে যে সমাজতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন- আজকের পুঁজিবাদী রাশিয়া নয়। সমাজতান্ত্রিক দেশের বিদেশনীতির মধ্যে থাকে মতাদর্শিক লক্ষ্য, বিশ্বকে সাম্রাজ্যবাদমুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা। সোভিয়েত-চীনের পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকার মধ্যে শেষের দিকে অনেক বিভ্রান্তি দেখা গেলেও (যেমন- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনের ভূমিকা) সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবির দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল পরাধীন ও অনুন্নত দেশগুলোর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের পক্ষে। আর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদের নীতিই হলো দুনিয়ার মানুষকে শোষণ ও দুনিয়ার সম্পদ লুণ্ঠন করা। সেদিনের রাশিয়া ছিল দুনিয়ার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষের দুর্গ। আর আজকের রাশিয়ার নীতি পরিচালিত হয় নতুন করে তৈরি হওয়া পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে। আজকের রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রয় ও বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রয়ের মধ্যে দুই দেশের লুটেরা ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নেই।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া অবশ্য পুঁজিবাদী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে। যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, কোরিয়া, কিউবা প্রশ্নে আমরা এই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখতে পাই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও জাপ সাম্রাজ্যবাদকে একযোগে অধিকতর দুশমন বিবেচনা করা সংগত। এই আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের সুযোগও নেওয়া উচিত এবং যতটা পারা যায় মানবজাতির এক নম্বর দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশলকে সমর্থন করা উচিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা অথবা ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা) নামে যে নতুন উদীয়মান শক্তির জোটের কথা শোনা যাচ্ছে, তাকে তুলনামূলক বিচারে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সে রকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান থেকে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী?
মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন উপস্থিতি। এমনকি সামরিক উপস্থিতিও ভালোভাবেই আছে। যৌথ সামরিক মহড়া ছাড়াও আমাদের দেশে মার্কিন সৈন্যের যে উপস্থিতি আছে, তা গত বছর জুন মাসে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে ইউএস মেরিনের এশিয়া প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধানের বক্তব্য থেকেই জানা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে বসেই সিআইএ রাখঢাক না করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের জ্ঞাতসারেই। ১৯৯৮ সালের (তখনো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী) জুন মাসে বাংলাদেশ সোফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। মার্কিন সৈন্যরা যেকোনো সময় বিনা ভিসায় সশস্ত্রভাবে (কাস্টম হবে না) প্রবেশ করতে পারবে এবং তারা খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ করলেও বাংলাদেশের আদালতে বিচার করা চলবে না। শেখ হাসিনা (খালেদা জিয়াও) তো ইতিপূর্বেই জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন। মার্কিন দস্যুরা যেদিন আফগানিস্তান দখল করল, তখন লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে মার্কিন হানাদারদের জন্য বাংলাদেশের আকাশ, সমুদ্র ও জমি ব্যবহারের অধিকার প্রদান করেছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এই সরকার যেভাবে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি কনোকো-ফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র তুলে দিয়েছে, তাতে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এতটা নতজানু হওয়া সত্ত্বেও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশ্নে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যায়। তাই কি আরেকটা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশ রাশিয়ার সঙ্গে মাখামাখির পর্ব শুরু হয়েছে? অবশ্য দুই নৌকায় পা রাখলে সর্বনাশ!
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ, অন্যদিকে রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অস্ত্র ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ অপচয় করার পরিণতিতে সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েছে, তবে আর নয়। জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের অর্থ ও সম্পদের অপচয় আর দেখতে চাই না। অস্ত্র নয়, অন্ন চাই। চাই সবার জন্য সমান শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ। আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া- সব সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করেই মুক্তিযুদ্ধের দেশ বাংলাদেশ হিম্মত নিয়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবে সংবিধান বর্ণিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এটাই হোক আমাদের কামনা।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
No comments