ভিন্নমত-ধনীদের অর্থ নিয়ে যত ভয়! by আবু আহমেদ
বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটস বলেছেন, তাঁর এত অর্থের প্রয়োজন নেই। বিল গেটস ৬০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। ব্যক্তির জন্য এই অর্থ বিশাল বটে। তবে বিল গেটস এই অর্থ চুরি করে জমা করেননি।
নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করে সম্পূর্ণভাবে ট্যাক্স দিয়ে এই বিশাল অর্থের মালিক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ায় বিলিয়নিয়ারদের বড়ই মূল্য। তাঁদের সমাজ ও অর্থনীতি লোকদের ধনী হতে উৎসাহ দেয়। ওইসব সমাজের লোকেরা মনে করেন, ধনী লোকেরা সম্পদ সৃষ্টি করতে পারেন। ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজই উপকৃত হয়। দরিদ্র সমাজে দারিদ্র্যকে ভাগাভাগি করা হয় এবং সবাই দরিদ্র থাকে। দরিদ্র থাকলে সমাজে সুস্থ চিন্তা কমে যায়। সম্পদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টার স্থলে সম্পদ চুরির প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে দরিদ্র লোকেরা নৈতিকভাবেও অধঃপতনের দিকে চলে যায়। লুট, হত্যা, রাহাজানি- এসব তখন সমাজের নিত্যসঙ্গী হয়। তবে ধনী হওয়ার যে প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ চালু করেছে, তাতে পুঁজির মালিকরা বা ধনী লোকেরা আরো তাড়াতাড়ি ধনী হন। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া লোকদের প্রকৃত আয় কমতে থাকে, অর্থনীতিতে যখন মন্দা দেখা দেয়। অর্থনীতি ভালো বললে নিম্ন-মধ্যবিত্তের লোকেরাও আয়-ভোগে এগিয়ে যায়, যদিও তাঁদের আয়-ভোগ আনুপাতিক হিসাবে ধনীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সেই অর্থনৈতিক মডেল বাজার অর্থনীতির নামে বিশ্বে এখন সর্বত্র গৃহীত। তবে দেশভেদে এই বাজার অর্থনীতিতে কিছুটা ভিন্নতা তো অবশ্যই আছে। পাশের দেশ ভারতেও এখন বাজার অর্থনীতির জয়জয়কার। এবং এ প্রথায় গত ২০ বছরে যত ধনী লোক সৃষ্টি হয়েছে, তা ওই দেশে এর আগের ৫০ বছরেও সৃষ্টি হয়নি। এখন ভারতীয় ধনীরা দেশের ব্যবসাকে নিয়ে গেছেন বিদেশেও। বলা চলে, পুঁজিবাদী বিশ্বে তাঁরা একটা বড় খুঁটি বটে। বাংলাদেশেও অর্থনীতিতে স্বাধীনতা দেওয়ার পর থেকে আমাদের দেশেও শত শত ধনী লোকের সৃষ্টি হয়েছে, যাঁরা এখন অর্থনীতির চাকা ঘোরানোয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে লোকেরা ধনী হলে অন্য বৈশিষ্ট্যও সমাজে চলে আসে। সেটা হলো, এক ধরনের ভোগবাদ সমাজকে পেয়ে বসে। অন্যদিকে ধনীরা, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের ধনীরা অর্থকে লুকাতে চান। এবং ওই লুকানোর প্রচেষ্টার একটা অংশ হলো, অন্য দেশে অর্থ পাচার করে দেওয়া। বাংলাদেশ থেকে বছরে যত অর্থ বিদেশে যাচ্ছে, তার থেকে অনেক কম অর্থ এই দেশে আসছে। ধনীদের জিজ্ঞেস করুন, তাঁরা কেন তাঁদের অর্থকে লুকাতে চান- তাঁরা বলবেন, এ দেশে অর্থের নিরাপত্তা নেই। হ্যাঁ, অর্থও নিরাপত্তা চায় বটে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের চেয়ে বেশি। সে জন্যই তো অনেক দেশ বর্তমান মন্দার সময়েও ভালো চলছে বিদেশিদের টাকায়। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ কিন্তু খুব উদার। তারা বিদেশিদের অর্থ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইরাক, সিরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে তারা বিনা পরিশ্রমেই শত শত বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে। এসব দেশের ধনীরা অর্থের নিরাপত্তা খোঁজার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ এখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইকেও বেছে নিচ্ছেন। সত্য হলো, দেশের বর্ডার মানুষকে আটকাতে পারে; কিন্তু তাঁদের অর্থকে বর্ডার বা দেশের সীমান্ত বাধা দিতে পারে না। যেসব দেশ অর্থকে আটকানোর জন্য যত বেশি বাধা তৈরি করেছে, সেসব দেশ থেকে অর্থ বেশি বিদেশে পাচার বা স্থানান্তরিত হয়েছে। কেন ধনীরা বাংলাদেশের মতো দেশে তাঁদের সম্পদের সব অংশ রাখতে ভয় পান। তাঁদের প্রথম উত্তর হলো- রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। দ্বিতীয় উত্তর হলো- এই দেশে অর্থ রোজগার করা যত সহজ, কিন্তু অর্থকে এই দেশে রেখে সামগ্রিকভাবে নিরাপদ অনুভব করা যায় না। তাঁদের অনেকে দেশের দীর্ঘমেয়াদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়েও শঙ্কিত। তাঁরা মনে করেন, এই দেশ অনেক জনসংখ্যার দেশ, যে জনসংখ্যাকে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাঁদের মতে, এই জনসংখ্যা আরো বাড়বে এবং জমিসহ প্রাকৃতিক অন্যান্য উপাদানের ওপর ভীষণ চাপের সৃষ্টি করবে। ফলে বাংলাদেশে সব সময়ই এক ধরনের হা হা অবস্থা বিরাজ করবে। এ অবস্থায় কমপক্ষে তাঁদের অর্থের গন্তব্য হওয়া উচিত- ওইসব নিরাপদ ক্ষেত্র ও দেশগুলো, যেখান থেকে তাঁরা যেখানেই থাকুক না কেন অর্থ আনতে ও ব্যয় করতে পারবেন। মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সরকার অনেক আইন পাস করেছে সত্য; কিন্তু সত্য হলো, ওইসব আইন অর্থকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে হস্তান্তর বন্ধ করতে পারেনি। বাংলাদেশে গত ২০ বছরে অনেক লোকই ধনী হয়েছেন। অনেকেই তাঁদের অর্থকড়ির একটা অংশ বিদেশে স্থানান্তর করেছেন। যে লোক গুলশানে ৫০ কোটি টাকার জমি বিক্রি করলেন, তিনিও টাকা নিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর একমাত্র সন্তানের কাছে এবং নিজেও চলে গেছেন। আমাদের বাধা দেওয়ার আইন তাঁকে অর্থ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সামাজিক অস্থিরতা, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব- এসব কোনো দেশে সংঘটিত হলে অবশ্যই ধনী লোকদের অর্থ সীমান্ত পাড়ি দেবে। লিবিয়া তো গাদ্দাফিমুক্ত হলো। কিন্তু লিবিয়ার লোকেরা গরিব হলেন কেন? উত্তর একটাই- গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে-পরে ধনী লিবীয়রা তাঁদের অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছেন। সে জন্য অনেক বড় শক্তি কৌশলে ছোট দেশগুলোতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে। আর প্রচার চালাতে থাকে, ওই দেশের মুদ্রার মানে তো সহসা ধস নামবে। এর অর্থ হলো, ওই দেশের ধনীদের বুঝিয়ে দেওয়া যে তোমাদের সম্পদ তোমাদের দেশের দুর্বল মুদ্রায় নিরাপদ নয়। নিরাপত্তার জন্য ডলার-ইউরো খোঁজো। বাংলাদেশ কতটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে তা নির্ভর করবে এই দেশের ধনীরা এই দেশকে নিরাপদ মনে করেন কি না। তাঁরা যদি বিনিয়োগ না করেন, তাহলে বিদেশিদের দিয়ে এই দেশের উন্নতি আশা করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের চিন্তাশীল মানুষদের উচিত হবে, যাবতীয় সামাজিক অস্থিরতা থেকে দেশকে বাঁচানো। রাজনৈতিক কলহ আর সামাজিক অস্থিরতা চলতে থাকলে এই দেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য বদলাবে না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments