তেঁতুলিয়ার সীমান্তঘেঁষা ফকিরপাড়া গ্রাম জনশূন্য- বিএসএফ আতঙ্ক by এ রহমান মুকুল
তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুরের একেবারে ভারতঘেঁষা বাংলাদেশের ফকিরপাড়া গ্রাম। এ গ্রামটিতে ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশী ৩শ’রও বেশি পরিবার বসবাস করত। বংশপরম্পরায় এসব পরিবার ওই গ্রামে বসবাস করে আসছে।
গ্রামের পার্শ্বে মেইন পিলার ৪২৮ নং-এর ২নং সাব পিলার থাকলেও সে সময় কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। পিলারের ৫০ গজ ভেতরে বাংলাদেশী এলাকায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাপ-দাদার ভিটে আঁকড়ে বাস করত দবিরউদ্দিন (৭৫)। শৈশব-কৈশোর কেটে এখন বৃদ্ধ বয়সে বাপ-দাদার ভিটে ছাড়তে হলো তাঁকে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাঁকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করল। সশস্ত্র বিএসএফের অব্যাহত হুমকি-ধমকিতে গত দু’দিন আগে তিনি বাড়িঘর ভেঙ্গে পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্যত্র সরে গেছেন। এখন খাঁ খাঁ পড়ে আছে তাঁর শূন্যভিটা। শুধু দবিরউদ্দিনই নন, এ গ্রামে বাস করত এমন অনেকেই বাড়িঘর ভেঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে চলে গেছেন। বিএসএফ প্রায় প্রতিদিনই রাতে সশস্ত্র অবস্থায় কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ফকিরপাড়া গ্রামে অনধিকার প্রবেশ করে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। এমনকি গত ২৮ ডিসেম্বর রাতে এসে গ্রামবাসীদের গ্রাম ছাড়তে মৌখিকভাবে সাত দিনের চূড়ান্ত নোটিস দিয়ে যায়। কিন্তু বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবিকে গ্রামবাসী সে কথা বিশ্বাসই করাতে পারেনি। ফলে যার চূড়ান্ত পরিণতিতে ওই গ্রামে মাত্র ৫টি পরিবার ছাড়া সব পরিবারই বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।এ প্রসঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবির পঞ্চগড়ের ১৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকির হোসেনের কাছ থেকে বিএসএফের নানা হুমকি-ধমকিতে গ্রামবাসী অন্যত্র সরে যাওয়ার বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিএসএফ গ্রামবাসীদের কখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেনি। গ্রামবাসীরা মিথ্যা বলছে। প্রকৃত সত্য হলো- গ্রামটি জিরোলাইনে হওয়ায় বিজিবি-বিএসএফের টহলের সময় গ্রামবাসী স্বাভাবিকভাবে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। এজন্য ঝামেলা এড়াতে গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে অন্যত্র বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বিজিবি কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বক্তব্যে গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, বিপদের সময় ডাক দিয়েও বিজিবিকে কাছে তারা পাননি। বিএসএফ গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে চলে যাওয়ার পর বিজিবি গ্রামে টহলে যায়। বিএসএফের উস্কানিমূলক কর্মকা- সম্পর্কে তাদের অভিযোগ করলে উল্টো বিএসএফ যা বলেছে তা মেনে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
গ্রামবাসী জানায়, গত কয়েকবছর আগেও এক রাতে আকস্মিক এক থেকে দেড় শ’ বিএসএফ সশস্ত্র অবস্থায় ফকিরপাড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা একের পর এক ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়। পুরো গ্রামে বিএসএফ তা-ব চালায় এবং মহিলাদের মারপিটসহ শ্লীলতাহানি ঘটায়। আতঙ্কিত গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী বিজিবি ক্যাম্পে খবর দিয়েও কোন সহযোগিতা পাননি। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কথা এখনও গ্রামবাসী ভোলেনি। সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর রাতেও বিএসএফের একটি দল গ্রামে অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন বাড়িঘরে ঢুকে আতঙ্ক ছড়ায়। তারা গ্রামবাসীদের সাত দিনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে বলে। এ অবস্থায় নিরুপায় অসহায় গ্রামবাসী বাধ্য হয়ে এখন প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
বুধবার সকালে এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গোটা ফকিরপাড়া গ্রাম জনশূন্য। কিছুদিন আগেও সেখানে ৫০টিরও বেশি পরিবার থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৫টি পরিবার বসবাস করছে। এই পরিবারগুলো আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। ফকিরপাড়া গ্রামটির অবস্থান হচ্ছে ভারতীয় সীমান্তের জিরোলাইনে চা বাগান, এরপর দেড় শ’ গজ দূরে কাঁটাতারের বেড়া। চপড়ামারী বিএসএফ ফাঁড়ি থাকার পরও অমরিকান নামে আরও একটি নতুন বিএসএফ ফঁাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। চা বাগানের পার্শ্ব দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা। রাস্তার ভেতরে ফকিরপাড়া গ্রাম। গ্রামে পড়ে আছে অনেক শূন্যভিটা। দু’একদিন আগেই যে এসব বাড়িঘর সরানো হয়েছে তা শূন্য ভিটের মধ্যে মাটির গর্ত, সরিয়ে নেয়া টিউবওয়েলের প্ল্যাটফর্ম এবং ভাঙ্গা বাঁশের বেড়া দেখলেই বোঝা যায়। গ্রামে ভিটে আঁকড়ে ধরে থাকা গৃহবধূ রাজিয়া (৫০) জানান, ২৮ ডিসেম্বর রাতে পরিবারের সবাই মিলে তাঁরা একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। হঠাৎ কয়েক বিএসএফ সদস্য অস্ত্র নিয়ে গ্রামে ঢুকে হুইসেল দেয়া শুরু করে। তারা ভয়ে খাবার ফেলে পালিয়ে যান। আরেক বাসিন্দা নশিদুল (৪০) বলেন, বিএসএফ গত ১০-১৫ বছরে অসংখ্যবার গ্রামে সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে গ্রামবাসীদের অন্যত্র সরে যেতে নানা ভয়ভীতি দেখাত। বিজিবিকে অভিযোগ করেও কোন কাজ হয়নি। বরং বিএসএফের অপতৎপরতা বেড়েই চলত। পাশের গ্রামে চলে যাওয়া হাজেরা বেগম (৫৫) বলেন, আগে যখন বিএসএফের উৎপাত ছিল না, তখন ৩শ’রও বেশি পরিবার বাস করত। কিন্তু ধীরে ধীরে বিএসএফের উৎপাত, অত্যাচার বাড়তে থাকলে লোকজন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মক্তারুল হক মুকু বলেন, শুধু বিজিবির ওপর ভরসা করলে চলবে না, বিএসএফের অত্যাচারে জনশূন্য ফকিরপাড়া গ্রামটি আবার যেন ভারতের দখলে চলে না যায় সেদিকে জনগণকে সজাগ থাকতে হবে।
No comments