সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-পুলিশ পদক ও একটি অনভিপ্রেত নজির by আবু সাঈদ খান

জানুয়ারির ২২ তারিখ টেলিভিশনের খবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের 'উক্তিটি' শুনে আমার আক্কেল গুড়ূম। ভাবলাম, ভুল শুনিনি তো? আরেক চ্যানেলে দ্বিতীয়বার উক্তিটি শুনে নিশ্চিত হলাম।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর ঘটনায় বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ কী করে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক পেলেন_ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'তাকে পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই ঘটনাটিও বিবেচনায় আনা হয়েছে।' তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, 'পুলিশকে মূলত দুই কারণে পদক দেওয়া হয়। একটি সাহসিকতা, আরেকটি সেবা। সভা-সমাবেশে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ নেমে বিশৃঙ্খলা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করেন। অবৈধভাবে করা সভা-মিছিল-সমাবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন ডিসি হারুন। হারুন তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের ঊধর্ে্ব উঠে বিশৃঙ্খলা ঠেকিয়েছেন। এ ছাড়া ফারুক ঘৃণ্যভাবে হারুনের বাবা-মা তুলে গালাগাল করেছিলেন। তখন ডিসি হারুন বাধ্য হয়েছিলেন ফারুকের ওপর হামলা চালাতে। পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে হারুনের ওপর এ হামলার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।' (সমকাল, ২৩ জানুয়ারি ২০১৩)।
২০১১ সালের জুলাইতে বিরোধী দলের হরতাল চলাকালে সংসদ ভবন এলাকায় জয়নুল আবদিন ফারুককে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল পুলিশ সদস্যরা। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডিসি হারুন। তখন পুলিশের ভূমিকা অনেকের কাছেই গর্হিত অপরাধ ও নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ঘটনাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, এ ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখবেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ফারুকের আহত হওয়ার ঘটনাকে 'অনভিপ্রেত' আখ্যায়িত করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, কেউ বাড়াবাড়ি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ডিসি হারুনকে বরখাস্ত ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলা হয়েছিল। অথচ বছর দেড়েকের ব্যবধানে বরখাস্ত তো দূরের কথা, তিনি সে কাজের জন্য পেলেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিবেচনায় পুলিশের ওই হামলা নিন্দনীয় নয়। বরং গৌরবের_ যার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে রাষ্ট্রপতি পদক দেওয়া হলো।
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এ বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, সংসদ এলাকায় (যেখানে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ) মিছিল করলে পুলিশ তাদের ওপর হামলা করতে পারে। আর গালি দিলে লাঠিপেটা করতেও পারে। সেটি সাহসের ব্যাপার। আইনসিদ্ধ বিষয় হচ্ছে_ মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ এমন এলাকায় তা করলে সেটিতে পুলিশ বাধা দিতে পারে। তাদের ঘেরাও করে রাখতে পারে, প্রয়োজনে গ্রেফতারও করতে পারে, কিন্তু তাদের ওপর চড়াও হতে পারে না। গালি দিলে পুলিশ প্রতিউত্তরে তার ওপর হামলা করতে পারে না। আর সেটি করলে দেশের প্রচলিত আইনেই তা অন্যায়, দায়িত্বের লঙ্ঘন, যা শাস্তিযোগ্য। অথচ শাস্তির বদলে তিনি পুরস্কৃত হলেন। তবে হারুনের পদকপ্রাপ্তির বৃত্তান্তে বলা হয়েছে, 'তিনি রাজধানীর লালবাগ এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালত ও পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারের জন্য কারাগারের প্রধান ফটকে স্থাপিত আদালতের বিশেষ এজলাস এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। এসব প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।' (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০১৩)।
উলি্লখিত রুটিনওয়ার্কের জন্য রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক দেওয়া যায় কি-না, সে আলোচনায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কারণ পদকপ্রাপ্তির বৃত্তান্তে যা আছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব যে জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর ঘটনাটি পেয়েছে, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট।
এটি যে দলীয় বিবেচনায় হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের সুযোগ নেই। পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় না। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে আশান্বিত হয়েছিলাম, কিন্তু হারুনের পদক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সে আশা শূন্যে মিলিয়ে গেল।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে সত্য, তবে দলীয় বিবেচনায় দেশ পরিচালনা করা যায় না। গণতান্ত্রিক সরকারকে হতে হয় সব মানুষের, সমগ্র জাতির। কিন্তু কাজে যদি দলীয় বিবেচনা থাকে, তবে কারও জন্য কি তা মঙ্গল বয়ে আনবে?
আজ দলীয় বিবেচনার কারণেই পুলিশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের সমর্থক পুলিশদের ভালো পদায়ন ও পদোন্নতি হয়েছে, আর বিএনপি সমর্থক পুলিশরা ওএসডি বা প্রমোশনবঞ্চিত থাকছেন। বিএনপির আমলেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। তখন তাদের সমর্থকরা পদোন্নতি ও ভালো স্থানে পোস্টিং পেয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে চিহ্নিতরা হয়েছিলেন বঞ্চিত। হারুনুর রশীদকে পদক দেওয়ার মধ্য দিয়ে যেটি হলো, তার পরিণতি ভয়াবহ। আগামীতে যদি বিএনপি সরকার গঠিত হয় তবে বিএনপির সমর্থক পুলিশরা আওয়ামী লীগের নেতাদের মাথা ফাটিয়ে পুরস্কারের লোভে ওত পেতে থাকবেন। এভাবেই কি চলতে থাকবে বিরোধী পক্ষকে রক্তাক্ত করার প্রতিযোগিতা? পুলিশকে হীনস্বার্থে ব্যবহারের নীতি যদি না বন্ধ হয়, তবে তা হয়ে উঠবে দেশের আইন-শৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি।
কেবল বিরোধী দল নয়, নাগরিক আন্দোলনের কর্মীদের দমন-পীড়নেও পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক'দিন আগেও এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছে পুলিশ। তাদের কোথাও বসতে দেওয়া হয়নি। এমনকি শহীদ মিনার থেকে তাদের তাড়া করা হয়েছে। নতুন আমদানিকৃত পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিভিন্ন দেশে হিংস্র বন্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়, তা নিরীহ শিক্ষকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিরোধ করতে পুলিশ ফুলের মালা নিয়ে যায় না। এ বক্তব্য কি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আশা করা যায়?
এখানে সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতার স্পর্শ। ক্ষমতা এমনই যে এর স্পর্শে সবাই বেপরোয়া হয়ে যান। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বেলায় কথাটি বেশি সত্য_ যার নির্দেশের অপেক্ষায় সদা প্রস্তুত থাকে পুলিশ বাহিনী। তাই যিনিই ক্ষমতায় যান, তিনি উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করেন। তবে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ক্ষেত্রে এমনটি হবে না বলেই আশা করেছিলাম। তিনি শিক্ষিত ও সজ্জন ব্যক্তি। আমি অনেকবার তার সঙ্গে 'টক শো'তে অংশ নিয়েছি, তার যুক্তিপূর্ণ কথা শুনেছি। তাই তিনি যেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, সেদিন একটি চ্যানেলে আমাকে মন্তব্য করতে বলা হলে আমি বলেছিলাম, তিনি শিক্ষিত এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অতএব, ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন আশা করা যায়। কিন্তু তিনি আজ কথা ও কাজে আমাদের হতাশ করলেন।
এটি মনে রাখা দরকার, যখন অধিকারবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ কোনো পেশাজীবীরা সভা-সমাবেশ করেন, তখন অধিকার নিশ্চিত না করতে অপারগ সরকারকে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে হয়, অক্ষমতার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। এটিই গণতান্ত্রিক রেওয়াজ। আর কোনটি বৈধ, আর কোনটি অবৈধ_ তা নিরূপণের মানদণ্ড কী?
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, কোথায় সভা-সমাবেশ করা যাবে তা প্রশাসন নির্দিষ্ট করে করতে পারে। ঘোষণা করতে পারে যে, ওইসব এলাকায় সমাবেশ করা যাবে না। আর কখনও সেখানে যদি আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয় তবে কি তা অবৈধ সমাবেশে পরিণত হবে? আসলে প্রশাসনিক নির্দেশের চেয়ে বড় মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, সেই অধিকার সমুন্নত রাখতে প্রশাসনকে এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। যেমন_সংসদ এলাকায় যখন সাংসদরা মিছিল-সমাবেশ করবেন, যতক্ষণ সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটছে, ততক্ষণ তা মেনে নেওয়াই যৌক্তিক। কোনো পেশাজীবীরা পুলিশের বিনা অনুমতিতে সভা-সমাবেশ করলেও কি তাদের ওপর পেপার স্প্রে করা যায়?
আমি নিশ্চিতভাবে জানি, সরকারদলীয় নেতারা এসব অভিযোগের জবাবে বিএনপি আমলের ডজন ডজন অপকর্মের ফিরিস্তি দিতে পারবেন। বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী অনেক দায়িত্বহীন উক্তি করেছেন। আর তাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর কত ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। একইভাবে এটি সত্য যে, সেসব খারাপ কাজের জন্য বিএনপি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বাবরদের কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে। কারাগারে ঢুকতে হচ্ছে। আর সেই অপকর্মের অবসান ঘটাতে বিগত নির্বাচনে জনগণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে বিজয়ী করেছে। এখন ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ যদি খারাপ দৃষ্টান্তই অনুসরণ করে, তবে জনগণ কোথায় যাবে?
এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মহোদয়রা বলতে পারেন, আমরা খারাপ কাজ করলে জনগণ আমাদের প্রত্যাখ্যান করবে। অতএব, নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করুন। না, গণতন্ত্র তা বলে না। গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিত সরকার ও জনগণের মধ্যে সার্বক্ষণিক জবাবদিহির প্রক্রিয়া। প্রতিটি কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে, যুক্তি দিতে হবে। বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের অভিযোগ খণ্ডন করতে হবে, আর ভুল হলে ক্ষমাও চাইতে হবে। জনগণের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো হুঙ্কার ছাড়বেন, কুযুক্তি দেবেন, যা খুশি তা-ই করবেন, তা জনগণ আশা করে না।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.