ঝরে পড়ছে ৮০%- মাধ্যমিকের আগেই শিৰার বেহাল অবস্থা ॥ কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না by বিভাষ বাড়ৈ
নকলমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়েই চলছে এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পরীা। এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত পরীৰার্থীর কম সংখ্যা সকলের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে।
কিন্তু কমছে না ফরম পূরণ করেও পরীার হলে অনুপস্থিত শিৰার্থীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত মোট ৬ পরীক্ষায় বহিষ্কৃত হয়েছে মাত্র ৪১০ জন। কিন্তু পরীক্ষায় নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে পড়ায় হলে উপস্থিত হয়নি ২০ হাজার শিৰার্থী। প্রতিটি পরীক্ষাতেই ঝরে পড়ছে ৩ হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে একাদশ শ্রেণীতে নিবন্ধন করলেও আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে মাধ্যমিক পরীৰার আগেই ঝরে পড়েছে আরও ৫ লাখ ছাত্রছাত্রী। প্রতিবারই পরীৰায় ফেল করার পর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশ শিৰার্থীর। জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরের যত শিশু ভর্তি হয় তাদের ৮০ শতাংশই মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করার আগেই ঝরে পড়ে। অথচ ১০০ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করতে সক্ষম হচ্ছে মাত্র ২০ জন।উচ্চ মাধ্যমিক শিৰা নিয়ে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শিৰা থেকে ঝরে পড়ার এই উদ্বেগজনক চিত্র। সরকারের সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারাসহ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাধারণত ঝরে পড়া বলতে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করা শিৰার্থীদের মধ্যে ফরম পূরণ না করা শিৰার্থীদেরই বলা হচ্ছে। এই সংখ্যা উদ্বেগজনক এ কথা সত্য। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীৰা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে অৰম ঝরে পড়া শিৰার্থীর সংখ্যাও উদ্বেগজনক পর্যায়েই। গত কয়েক বছরের মতো এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃতদের সংখ্যা অনেক কম, কিন্তু কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না হলে অনুপস্থিত শিৰার্থীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কেবল নকল কমালেই শিার ল্য পূরণ হবে না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করে রোধ করতে হবে শিার্থীদের ঝরে পড়ার হার। জানা গেছে, দেশের ৮টি সাধারণসহ দশটি শিৰা বোর্ডের অধীনে গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে শুরম্ন হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীার প্রথম দিনে বাংলা প্রথমপত্র পরীায় বহিষ্কৃত শিার্থীর সংখ্যা কম হলেও ফরম পূরণ করেও পরীা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি ৪ হাজার ১০৮ শিার্থী। আর অসদুপায় অবলম্বন ও সহায়তার দায়ে ১০ বোর্ডে বহিষ্কৃত হয়েছিল মাত্র ৬৪ জন। প্রথম পরীৰায় ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত শিার্থীর সংখ্যা ৫৫১ জন, গত বছর ছিল ১ হাজার ২১৫। রাজশাহীতে ২০৮ জন, গতবছর ছিল ৬৪৯। যশোরে ৪০৭ জন, গত বছর ছিল ৬৮২। বরিশালে ৯৭ জন, গত বছর ছিল ২৪৫। সিলেটে ৬৯ জন, আগের বছর ছিল ২৩৯। কুমিলায় ২৫৩ জন, আগের্ র্র্ির্ছল ৪৮১। চট্টগ্রামে ১০২ জন, আগে ছিল ৪২৯ এবং দিনাজপুরে ১০৩ জন, আগের বছর অনুপস্থিত ছিল ৩৬১ জন। কারিগরি বোর্ডে এবার অনুপস্থিত ৩৫৬ জন, গত বছর ছিল ২৬০ জন। আর মাদ্রাসা বোর্ডে এবার অনুপস্থিত ১ হাজার ৯২২ জন, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৭৩০ জন। দ্বিতীয় দিনে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছে মাত্র ২৯ শিার্থী। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীা কেন্দ্রে আসেনি ২ হাজার ৪৪৪ শিার্থী। ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত শিার্থীর সংখ্যা ৩৯৫ জন, রাজশাহীতে ১২১ জন, যশোরে ৩২৮, বরিশালে ৯০, সিলেটে ৭১ জন, কুমিলায় ২৩৪, চট্টগ্রামে ১৪১ এবং দিনাজপুরে ৬১। কারিগরি বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ৩৬১ এবং আর মাদ্রাসা বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ৭৪২ শিৰার্থী।
এরপর ১৬ ফেব্রম্নয়ারি পরীার তৃতীয় দিনে ইংরেজী প্রথম পত্র পরীায় ২ হাজার ৮৮২ শিার্থী অনুপস্থিত ছিল। পরীায় নকলের দায়ে ৭২ শিার্থীকে বহিষ্কার করা হয় এদিন। যাদের মধ্যে-
ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত শিার্থীর সংখ্যা ৫৮৮, রাজশাহীতে ২৭৩, যশোরে ৩৩৮, বরিশালে ১২৬, সিলেটে ৮৩, কুমিলায় ১৭৯, চট্টগ্রামে ১৩৮ এবং দিনাজপুরে ১৭৬। কারিগরি বোর্ডের ইংরেজী-দ্বিতীয় পার্ট পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৪০২ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের হাদিস শরিফ পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৫৭৯ শিৰার্থী। ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পরীৰায় হলে আসেনি ২ হাজার ৮৮৭। বহিষ্কৃত হয় ৫৫ শিৰার্থী। অনৃুপস্থিত শিৰার্থীদের ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত শিার্থীর সংখ্যা ৫৮৮, রাজশাহীতে ২৭৩, যশোরে ৩৩৮, বরিশালে ১২৬, সিলেটে ৮৩, কুমিলায় ১৭৯, চট্টগ্রামে ১৩৮ এবং দিনাজপুরে ১৭৬। কারিগরি বোর্ডের ইংরেজী-দ্বিতীয় পার্ট পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৪০২ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের হাদিস শরিফ পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৫৭৯ শিৰার্থী। ২২ ফেব্রম্নয়ারি সাধারণ গণিত পরীৰায় এসব বহিষ্কৃত শিৰার্থীর সংখ্যা প্রথমবারের মতো এক শ' অতিক্রম করে। বহিষ্কৃত হয় ১০১। হলে আসেনি ২ হাজার ৭০৩। এদের মধ্যে-ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত শিার্থীর সংখ্যা ৫০৯, রাজশাহীতে ১৭৩, যশোরে ৩২২, বরিশালে ৯৬, সিলেটে ৮৮, কুমিলস্নায় ১১৭, চট্টগ্রামে ১৫২ এবং দিনাজপুরে ৬১। কারিগরি বোর্ডের গণিত-দ্বিতীয় পার্ট পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৪৭৮ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের আরবী দ্বিতীয়পত্র পরীৰায় অনুপস্থিত ছিল ৬৭৭ শিৰার্থী। সর্বশেষ সোমবার অনুষ্ঠিত উচ্চতর গণিত পরীৰায় অনুপস্থিত শিৰার্থীর সংখ্যা অনেক কম ছিল বলে জানা গেছে। তবে এই পরীৰায় মোট পরীৰার্থী কম থাকায় হলে অনুপস্থিতির স্যংখ্যাও কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশিস্নষ্টরা।
এ তো গেল ঝরে পড়ার এক দিকের চিত্র। জানা গেছে, ২০০৮-২০০৯ শিৰাবর্ষে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করা প্রায় ৫ লাখ শিৰার্থী এবারের পরীৰার আগেই শিৰা থেকে ঝরে পড়ছে। মোট শিৰার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার এই হার ৩৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। কেবল ঢাকা বোর্ডেই শিৰার্থীর সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি। ঝরে পড়া শিৰার্থীদের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে ৩৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ২৯ দশমিক ১১ শতাংশ, কুমিলস্নায় ৪১ দশমিক ২৯, যশোরে ৩৯ দশমিক ৪৫, চট্টগ্রামে ৩৮ দশমিক ৩৭, বরিশাল বোর্ডে ৩৭ দশমিক ৪৩, সিলেট বোর্ডে ঝরে পড়েছে ৪৪ দশমিক ৩৪, দিনাজপুরে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ ঝরে পড়ছে। এ ছাড়া কারিগরি বোর্ডে ৬ দশমিক ৮৬ এবং মাদ্রাসা বোর্ডে ঝরে পড়েছে ২৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিৰার্থী। কেবল এই বছরই নয়, পরিস্থিতি ভাল নয় পেছনের কোন বছরেরই।। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাথমিক সত্মরের যত শিশু ভর্তি হয় তাদের ৮০ শতাংশই মাধ্যমিক সত্মর অতিক্রম করার আগেই ঝরে যায়। গত ২০০৬-২০০৭ শিৰা বর্ষ থেকে চলতি শিৰা বর্ষ পর্যনত্ম নবম ও দশম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার চিত্রের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জানা গেছে, ২০০৬-২০০৭ শিৰাবর্ষে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১২ লাখ ৫৯ হাজার ১০৫ নিয়মিত শিৰার্থী। তাদের লৰ্য ছিলো, এসএসসি পরীৰায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু ২০০৮ সালের এসএসসি পরীৰায় এসে দেখা গেছে, এদের মধ্যে মাত্র ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৯ ফরম পূরণ করেছে। পরীৰার আগেই মাত্র দুই বছরের মধ্যে ঝরে পড়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৩০৬ শিৰার্থী। এর আগে শিৰা বর্ষের তুলনায় ঐ বছর ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায়। ২০০৫-২০০৬ শিৰাবর্ষে ছিল ৫৩ দশমিক ১৯ আর ২০০৬-২০০৭ শিৰাবর্ষে ঝরে পড়ার হার ৫৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর আগে ২০০৭-২০০৮ শিৰাবর্ষ। ঝরে পড়ার হার কিছুটা কমলেও পরিস্থিতি সুখকর নয় মোটেই। ২০০৭-২০০৮ শিৰাবর্ষে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করেছিল ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৪ শিৰার্থী। কিন্তু ২০০৯ সালে এসএসসি পরীৰার জন্য ফরম পূরণের আগেই ঝরে পড়ে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৩১০। ঝরে পড়ার হার ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৪ জনের মধ্যে পরীৰায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৪ জন।
এদিকে প্রাথমিক সত্মরে ৪৮ শতাংশ শিৰার্থী ঝরে পড়ার পর মাধ্যমিক সত্মরের নানা কারণে শিৰার্থীদের এই অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতিকে সবার জন্য মানসম্মত শিৰা নিশ্চিত করার পথে অনত্মরায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যক্তিগতভাবে বিশেষজ্ঞরা তো বটেই ঝরে পড়ার বিষয়টিতে অত্যনত্ম গুরম্নত্বের সঙ্গে নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশকিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। মাধ্যমিকে শিৰার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা নির্ধারণ ও এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করার দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে বিভিন্ন শিৰা বোর্ড। অন্যদিকে সবার জন্য মানসম্মত শিৰা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার বাসত্মবায়নের জন্য শিৰাথীদের ঝরে পড়া রোধে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করেছে জাতীয় শিৰানীতি প্রণয়ন কমিটি।
No comments