সারাদেশে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৬ জন
সম্প্রতি অজ্ঞাত রোগে মারা যাওয়া ছয় জনই নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান।
তিনি জানান, ঢাকা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, নওগাঁ, নাটোর ও গাইবান্ধায় ৮ জন নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাঁদের মধ্যে ছয় জনই মারা গেছেন। মারা যাওয়া ৫ জনের মধ্যে নাটোরে আট মাসের সন্তান রেখে একজন মারা যান। নিপা ভাইরাসের মৌসুম চলছে। দেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে মানুষ নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তদের শতকরা ৮০ ভাগের মৃত্যু ঘটেছে।অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এটি একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাদুড়ে খাওয়া কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে ওই সময় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় অনেক মানুষ। এ বছর এখন খেজুরের রস সংগ্রহ চলছে। সাবধানতা অবলম্বন না করলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড়ে খাওয়া ফলমূলের অংশবিশেষ না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আইইডিসিআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মুস্তাক হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, প্রতিবছরই কিছু লোক নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসকরা খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেয়া ছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর কিছু করতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। শীতের সময় খেজুর গাছে বাঁধা রসের হাঁড়িতে বাদুড় মুখ দেয়। বাংলাদেশে এভাবেই রোগটি মানুষে ছড়ায় বলে চিকিৎসকদের ধারণা। এ রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কে ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয়। নিপা একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ, যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এর প্রধান লক্ষ্মণগুলো হচ্ছে জ্বরসহ মাথাব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়াসহ কোন কোন ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট। চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে বাদুড় রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। আর সেই বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আবার আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা এক পর্যায়ে সংজ্ঞা হারায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু ঘটে।
অন্যদিকে, বিশ্বে ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। তবে বর্তমানে বালাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করা হয়। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানব দেহে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ২০০১ সালে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫২ জনের মধ্যে ১১৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এর রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার শতকরা ৭৩ ভাগ। নিপা ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে, ২০০৪ সালে ফরিদপুরে এক পরিবারের একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ওই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয় এ রোগে। এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার রিকশাচালকও নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝিনাদহ থেকে জানান, পুরো জেলায় নিপা ভাইরাস আতঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার শৈলকুড়া উপজেলার দুধসর গ্রামের রাব্বুল হোসেনের ছেলে রিংকু (১১) এ রোগে হয়ে গত ১৭ জানুয়ারি মারা যায়। এছাড়া প্রিয়ন্তি নামে তিন বছরের এক শিশু আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে এলাকাবাসীদের সচেতন করে তুলতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। জেলার ৬টি উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল টিম গঠনসহ একটি র্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২২ জানুয়ারি সাগর নামের আট বছরের শিশুর মৃত্যু ঘটে। শিশুটি নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের মনোরঞ্জন দাসের ছেলে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর।
এটি কেন নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সংক্রমিত হয় এবং কেন নতুন জায়গায় ছড়ায় সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তবে যেসব এলাকায় খেঁজুর গাছ রয়েছে কেবল সেসব এলাকাতেই এর সংক্রমণ হয়। তবে, যশোরে অনেক খেঁজুর গাছ থাকা সত্ত্বেও সেখানে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়নি। যশোরের বাদুড় এ ভাইরাস বহন করে না বলে এমনটি হতে পারে বলে মনে করে আইইডিসিআর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যদিও দাবি করছেন, ভারতীয় সীমান্ত এলাকার জেলাগুলো থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, তবে ভারতে এ ধরনের কোন সংক্রমণের কথা নিশ্চিত করেনি দেশটি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সকালবেলা খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যেখানে গাছ থেকে রস সংগ্রহে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছে আইসিডিডিআরবি। তারা বলেছে, বাদুড়ের খাওয়া ফল রসের হাঁড়িতে পড়ে গিয়ে কিংবা রস পান করার সময় বাদুড়ের লালায় থাকা ভাইরাস রসে মিশে যায়।
এছাড়াও, রসের পাত্রে বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করলে তার মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
নিপা ভাইরাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। তাই সংগৃহীত রস জ্বাল দিয়ে পান করা হলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না।
বাংলাদেশে সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দেখেছে, এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং খুব কম সংস্পর্শের কারণেও এটি এক ব্যক্তি থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে। রোগীর সেবাযতেœর সময় সতর্ক না থাকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুয়ে নিলে এবং আলাদা আলাদা খাবার গ্রহণ করলে এর সংক্রমণ ঠেকানো যায় বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
No comments